গত ৩১ মে ছিল বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য ছিল ‘তামাকের আগ্রাসী বিপণন থেকে নারীর স্বাস্থ্যসুরক্ষা’। বাংলাদেশে জর্দা, সাদাপাতা, গুল, খৈনি ইত্যাদি ধোঁয়াবিহীন তামাক নারীরা বেশি সেবন করেন। নারী-ধূমপায়ীর সংখ্যাও বাড়ছে। বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস উপলক্ষে এবারের আয়োজন
৩১ মে ছিল বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারিত ছিল জেন্ডার এবং তামাক। এবার নারীদের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। তামাক-বাজার থেকে এবং তামাক পান থেকে নারীদের বিরত রাখা ও সুরক্ষার জন্য জোর তাগিদ জানানো হয়।
তামাকের ব্যবসায়ীরা অবিরাম সন্ধান করছেন নতুন তামাক-ব্যবহারকারীদের, যাঁরা তামাক পান ও সেবন ছেড়ে দিচ্ছেন তাঁদের স্থান পূরণের জন্যই এই আগ্রাসী অনুসন্ধান।
এসব তামাকসেবী অকালে মৃত্যুবরণ করতে পারেন হার্ট অ্যাটাক, ক্যানসার, স্ট্রোক, এমফিসিমা ও তামাক সেবন থেকে উদ্ভূত অনেক রোগে; অথচ ব্যবসায়ীদের বাজার সম্প্রসারণের আগ্রহ মোটেও কমেনি।
নানা প্রলোভনের জাল বিস্তার করে তাঁরা বাজারকে আরও বাড়াতে চাইছেন।
তামাকশিল্পের মালিকেরা খুঁজছেন নতুন সুযোগ, তাঁদের বৃহত্তর লক্ষ্য হলো নারী। কারণ, পুরুষের চেয়ে অনেক কম নারী ধূমপান করেন বা তামাক চেবান। যেখানে তামাক সেবন করে ৪০ শতাংশ পুরুষ, সেখানে নয়শতাংশ নারী তামাক সেবন করে। বিশ্বের ১০০ কোটি তামাকসেবীর মধ্যে মাত্র ২০০ মিলিয়ন নারী। তাই তামাক-বাজারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লোকদের নতুন লক্ষ্য নারী-ধূমপায়ী তৈরি করা। আরেকটি কথা, কোনো কোনো দেশে যখন পুরুষ-ধূমপায়ীর সংখ্যা ধীরে ধীরে কমে আসছে, সেখানে তখন বাড়ছে নারী-তামাকসেবীর সংখ্যা।
বিশ্বজুড়ে তামাক সেবনের যে চিত্র, এর মধ্যে নারী-তামাকসেবীদের অবস্থান উল্লেখযোগ্য হয়ে উঠছে। ১৫১টি দেশে তরুণদের মধ্যে তামাক সেবনের যে সমীক্ষণ করা হয়েছে, এর মধ্যে অর্ধেকই তরুণী।
কোনো কোনো দেশে তরুণদের চেয়ে তরুণীরা বেশি ধূমপান করে। যেমন টিনএজাররা ধূমপান শুরু করে, পূর্ণবয়স্ক হলে চেইন স্মোকারে পরিণত হয়।
প্রতিবছর তামাক ব্যবহারের জন্য পৃথিবীতে মৃত্যুবরণ করে ৫০ লাখ মানুষ। এর মধ্যে নারী ১৫ লাখ। জরুরি ব্যবস্থা না নিলে ২০৩০ সালে তামাক সেবনের কারণে মৃত্যুবরণ করবে ৮০ লাখ মানুষ। এর মধ্যে ২৫ লাখ নারী। এ কারণে নারীমৃত্যুর আনুমানিক তিন-চতুর্থাংশ ঘটবে নিম্ন-আয় ও মধ্য-আয়ের দেশগুলোতে। এসব অকালমৃত্যুর প্রতিটিই প্রতিরোধযোগ্য।
কোনো কোনো দেশে, অন্যদের ধূমপান, বিশেষ করে পুরুষ-ধূমপায়ীর সিগারেটের ধোঁয়া সেবন করে বেশির ভাগ নারী ঝুঁকির মুখোমুখি হচ্ছে। যেমন, চীন দেশে ধূমপায়ীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি, প্রায় সবাই পুরুষ-ধূমপায়ী, নারীরা এদের সিগারেটের ধোঁয়া সেবন করে পরোক্ষভাবে, অথচ চীনে তিন শতাংশের কম নারী ধূমপান করে। এই সেকেন্ড-হ্যান্ড স্মোক বা অন্যের ধূমপানের জন্য ধোঁয়া সেবন করে পৃথিবীজুড়ে ছয় লাখ লোকের মৃত্যু ঘটছে, এর মধ্যে ৬৪ শতাংশ নারী।
বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস ২০১০, তামাক বাজারজাতকরণ ও তামাক সেবন নারীদের যে ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে সেদিকে দৃষ্টিপাত করেছে। একই সঙ্গে যেসব নারীর সঙ্গে তাঁরা থাকেন বা বসবাস করেন, সেসব পুরুষকে নারীদের সামনে ধূমপান থেকে বিরত থাকার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে।
তামাক নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সম্মেলনের মুখবন্ধে নারী ও পুরুষকে তামাকশিল্প বাজারজাতকরণ ও ধূমপানের প্রভাব থেকে সুরক্ষার যে কথা বলা হয়েছে, সেদিকে জোর দিয়েছে এবারের বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস। ২০০৫ সাল থেকেই বিশ্বজুড়ে নারী ও বালিকাদের মধ্যে তামাক সেবন বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। এ জন্য জেন্ডার নির্দিষ্ট কৌশল নির্ধারণের উপায় খোঁজা হচ্ছে।
দুর্ভাগ্যবশত বিশ্ব জনগোষ্ঠীর মাত্র নয় শতাংশ তামাকের বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধের আওতায় রয়েছে। নারীরা এখন বড় ঝুঁকিতে। এখন সময় কাজ করার। নারীদের লক্ষ্য করে বিজ্ঞাপনের জাল বিস্তারে রত তামাকের ব্যবসায়ীরা। নারীরা ক্রমেই অর্থনৈতিকভাবে সবল ও মুক্ত-স্বাধীন হচ্ছে, এতে তামাক সেবনে অর্থ ব্যয়ে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে, এও একটি কারণ।
তামাক কোম্পানিগুলোর মূল লক্ষ্য হলো নিম্ন-আয় ও মধ্য-আয়ের দেশগুলো। সেখানে নতুন নারী-ধূমপায়ী বেশি। অনেক দেশে ‘সেকেন্ড-হ্যান্ড স্মোক’ থেকে জনগণের সুরক্ষার বিধিবিধান নেই। অনেক নারী এই ক্ষতিকর দিকের কথা জানেও না। নারীদের মধ্যে তামাক ব্যবহারের প্রভাবও পুরুষের চেয়ে একটু ভিন্ন।
এমনও দেখা গেছে, তামাকের বিজ্ঞাপনে ধূমপান করাকে নারী মুক্তির উপায় হিসেবে উপস্থাপন করা অথবা ক্ষীণাঙ্গী থাকার উপায় হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করা হয়। এ ধরনের বিজ্ঞাপন বা প্রচার অনেক সময় প্রলুব্ধ করে নারীকে।
ধূমপায়ী বা তামাকসেবী নারীদের মধ্যে বন্ধ্যত্ব এবং দেরিতে সন্তানসম্ভবা হওয়ার আশঙ্কা বেশি। গর্ভধারণকালে ধূমপান করলে অকালপ্রসব, মৃতশিশু প্রসবের ঘটনা ঘটে বেশি। কমে যায় স্তনের দুধক্ষরণও। ধূমপানে নারীদের সার্ভিক্সের ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ে, বাড়ে স্তন ক্যানসারের ঝুঁকিও।
অনেক তামাক-নিয়ন্ত্রণ কৌশলের মধ্যে যেসব নারী তামাকপাতা, গুল, জর্দা চেবান, তাঁদের অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। ধূমপায়ীর মতো তাঁরাও সমভাবে ঝুঁকির মধ্যে থাকেন।
বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস ২০১০ নারীদের তামাক সেবন নিয়ন্ত্রণের ওপর জোর দিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক মার্গারেট চ্যানের বক্তব্য: স্বাস্থ্য ও প্রগতি দুটোর জন্যই নারীর স্বাস্থ্য রক্ষা ও স্বাস্থ্যের উন্নতি বিধান কেবল বর্তমান প্রজন্মই নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও এটি গুরুত্বপূর্ণ।
এ দিবসের অভিযানে নারীদের তামাক বাজারজাতকরণের গ্রাস থেকে উদ্ধার করার জন্য সচেষ্ট হতে বলা হলেও তরুণ ও পূর্ণবয়স্ক পুরুষদেরও এ থেকে সুরক্ষার জন্য বলা হয়েছে। নারী-পুরুষ সবার জন্য তামাক ব্যবহার ও তামাক বাণিজ্য—দুটোই ভয়ংকর বিপদ ডেকে আনবে। আর এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে সবাইকে।
আমাদের দেশের উঁচুতলার নারীদের অনেকের মধ্যে ধূমপানের অভ্যাস আছে, তবে নিম্ন-আয়ের নারীদের মধ্যে বিড়ি, সিগারেট, পান, তামাকপাতা ও জর্দা খাওয়ার চল রয়েছে। এসব বিষয়ে বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া দরকার।
এ দেশে তামাক ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে আইন হয়েছে। কিন্তু এর কঠোর প্রয়োগ নেই।
তরুণদের মধ্যে ধূমপান কমেনি।
আমাদের সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন তামাক নিয়ন্ত্রণের জন্য। অন্তত তামাক, সিগারেটের ওপর খুব ভারী কর বসানো তো যায়।
অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরী পরিচালক,
ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস,
বারডেম হাসপাতাল
সাম্মানিক অধ্যাপক,
ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ,
ঢাকা।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ০২, ২০১০
Leave a Reply