অনেক বছর ধরেই আমরা জানি, ধূমপান ধূমপায়ীকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, ধূমপায়ীরা অধূমপায়ীদের চেয়ে ২২ বছর আগে মারা যেতে পারেন। ধূমপান কতটা ক্ষতিকর, এটা পুরোপুরি জানা না গেলেও মানবদেহে এমন কোনো অঙ্গ নেই, যা ধূমপানের মাধ্যমে পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। প্রতিদিনই ধূমপানের কারণে নতুন নতুন রোগের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। ধূমপানের স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি—দুই রকম ক্ষতিকর প্রভাব আছে। স্বল্পমেয়াদি ক্ষতিকর প্রভাবের মধ্যে হার্ট বেড়ে যাওয়া, হার্টের অক্সিজেন-চাহিদা বেড়ে যাওয়া, রক্তে কার্বন মনোক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার ফলে রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যাওয়া, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদি অন্যতম। ধূমপানের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবের বিবরণ দিয়ে শেষ করা যাবে না। ধূমপান হার্ট অ্যাটাকের একটি মুখ্য কারণ। ধূমপায়ীদের হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা অধূমপায়ীদের চেয়ে ছয় গুণ বেশি, ধূমপান রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয়। যাঁদের একবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে, তাঁরা যদি ধূমপান বন্ধ না করেন, তবে তাঁদের দ্বিতীয়বার হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা অধূমপায়ীদের চেয়ে দ্বিগুণ।
ধূমপান শারীরিক, মানসিক পরিশ্রমের ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। বিভিন্ন অঙ্গ—যেমন হার্ট, ব্রেন ইত্যাদিতে রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে। ধূমপানসংক্রান্ত ক্যানসারের কথা সবাই জানে। ধূমপান মহিলাদের হূদরোগ, রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণও বাড়িয়ে দেয়। যাঁদের বয়স ৫০ বছরের নিচে, তাঁদের ওপর ধূমপানের প্রভাব বয়স্কদের চেয়ে বেশি হয়।
বাংলাদেশে প্রায় ৫০ শতাংশ পুরুষ ও তিন শতাংশ মহিলা ধূমপান করেন। এর বাইরেও ১৬ শতাংশ পুরুষ ও ৩১ শতাংশ মহিলা ধূম্রবিহীন তামাক সেবন (অনেক সময় পানের সঙ্গে) করে থাকেন। সাধারণত ৩৫ থেকে ৪৯ বছর বয়স্ক লোকজনকে ধূমপানে বেশি আসক্ত থাকতে দেখা যায়। ধনীদের তুলনায় স্বল্প আয়ের লোকজন বেশি ধূমপান করে থাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতিবছর দুনিয়ায় ৫০ লাখ লোক ধূমপানজনিত রোগের কারণে মারা যায়। বর্তমান দুনিয়ায় অল্পবয়স্ক লোকজনের মৃত্যুর অন্যতম কারণ ধূমপান। ২০২০ সালে ধূমপানের কারণে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়াবে এক কোটি। ‘টানে সুখ পাওয়া’ ধূমপায়ীরা কি জানেন, তাঁরা কী পান করছেন? ধূমপানের সঙ্গে তাঁরা চার হাজার ধরনের কেমিক্যাল পান করছেন, যার সবই শরীরের জন্য বিষস্বরূপ। সিগারেট কোম্পানিগুলো নিজেদের স্বার্থে ক্রেতাদের কাছে এগুলো প্রকাশ করে না, বা লুকিয়ে রাখে এবং তারা চাকচিক্যপূর্ণ লোভনীয় বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে তাদের ব্যবসা বাড়িয়ে চলছে। উন্নত বিশ্বে যখন ধূমপায়ীর সংখ্যা কমছে, তখন তারা বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে তাদের ব্যবসা বাড়ানোর চেষ্টা করছে। জীবনের বিনিময়ে আমাদের বোকা বানিয়ে তারা তাদের ব্যবসা করছে পুরোদমে। পরোক্ষ ধূমপায়ীরাও ধূমপানের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মুক্ত নন, বরং তাঁরাও ধূমপায়ীদের মতোই সমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। সাধারণত ২৫ শতাংশ লোক প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ৭৫ শতাংশ লোক ক্ষতিগ্রস্ত হন ধূমপানের পরোক্ষ প্রভাবে, এমনকি অধূমপায়ীরা ধূমপায়ীদের সঙ্গে বসবাস করলে হূদরোগের ঝুঁকি ২৫ শতাংশ বেড়ে যায়।
নিজের স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে, পরিবারের কথা চিন্তা করে, শিশুদের কথা চিন্তা করে প্রত্যেক বিবেকবান মানুষের ধূমপান ছেড়ে দেওয়া উচিত এবং ধূমপানের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা উচিত। ধূমপান ছেড়ে দেওয়ার নির্দিষ্ট কোনো নিয়ম নেই। এর জন্য দরকার মানসিক প্রস্তুতি। চিন্তা করে দেখুন, আপনার ধূমপানের কারণে শুধু লাভবান হচ্ছে তামাক প্রস্তুতকারী ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান আর ক্ষতি হচ্ছে আপনার। ধূমপান একেবারে ছেড়ে দিন, বেশি দিন বাঁচুন। হূদরোগের আশঙ্কা কমে যাবে, সুস্থ থাকবেন, স্বাদ বেড়ে যাবে, টাকা বাঁচবে—সর্বোপরি মানসিক ও শারীরিকভাবে সুস্থ থাকবেন।
এম এইচ মিল্লাত
সিনিয়র কনসালট্যান্ট,
কার্ডিও থোরাসিক সার্জারি,
ইব্রাহিম কার্ডিয়াক সেন্টার।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ০২, ২০১০
Leave a Reply