যাদের বয়স ৬৫ এর উর্দ্ধে, যাদের অন্যান্য হৃদঝুঁকি রয়েছে যেমন উঁচুমান কোলেস্টেরল বা উচ্চ রক্তচাপ, স্থূলতা, ধূমপান, ডায়াবেটিস বা হৃদরোগের পারিবারিক ইতিহাস রয়েছে, বিশেষ করে এর কখনই সাহায্য চাইতে বিলম্ব করা ঠিক নয়।
হৃদরোগ যেমন আমেরিকায় এক নম্বর ঘাতক রোগ, আমেরিকার মোট মৃত্যুর হার ৪০%। তবে উন্নয়নশীল দেশেও হৃদরোগ ক্রমে ক্রমে একটি প্রধান ঘাতক রোগ হিসেবে আসছে।
কেন হৃদরোগ এত ভয়ানক? : একটি কারণ হলো উপসর্গ দেখা দেবার পরও অনেক ধীরে সাড়া দেন রোগীরা, সাহায্যও চান দেরীতে। হঠাৎ বুকে প্রচণ্ড ব্যথা হলে অনেকে জানেন কার্ডিয়াক জরুরীতে ফোন করতে হবে, তবে হৃদরোগের উপসর্গ বিচিত্র রকমের। সব সময় তীব্র বা স্পষ্ট ব্যথা হয়ে আসে না। ব্যক্তি ভেদে, জেন্ডার ভেদেও এর হয় ভিন্নতা। যেহেতু হার্টের এসব উপসর্গ চিনতে পারা, বুঝতে পারা বেশ কঠিন সেজন্য বিশেষজ্ঞরা সম্ভাব্য সতর্ক সংকেতগুলোকে অবহেলা করতে নিষেধ করেছেন। এসব উপসর্গ ‘তেমন কিছু নয় বলে’ অবহেলা, ব্যথা চলে যায় কিনা তা অপেক্ষা করে দেখা, বুকজ্বলা, বেশি ব্যথা-বলে এড়িয়ে যাওয়া-কোনও সময়ই ঠিক নয়। ঝুঁকি নেওয়া বা বিলম্ব করা বিপজ্জনক হতে পারে। যাদের বয়স ৬৫ উর্দ্ধে, যাদের অন্যান্য হৃদঝুঁকি রয়েছে যেমন উঁচুমান কোলেস্টেরল বা উচ্চ রক্তচাপ, স্থূলতা, ধূমপান, ডায়াবেটিস বা হৃদরোগের পারিবারিক ইতিহাস রয়েছে, বিশেষ করে এর কখনই সাহায্য চাইতে বিলম্ব করা ঠিক নয়। ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিকের কার্ডিওলজিস্ট ডা: ডেভিড ফ্রিড বলেন, “যাদের যত বেশি হৃদঝুঁকি থাকবে, তাঁদের ক্ষেত্রে এমন উপসর্গ হৃদরোগের উপসর্গ হওয়ার সম্ভাবনা তত বেশি।” “অনেকে অনেক সময় স্বীকার করতে দ্বিধা করেন যে হৃদরোগের উপসর্গ তাদের হতে পারে, মনে করেন হৃদরোগ হবার মত বয়স তাঁদের হয়নি”। অন্যান্য চিকিৎসা সমস্যার জন্য ডাক্তারের পরামর্শ নিতে একটু দেরি করা তত সমস্যা নাও করতে পারে, তবে গুরুতর হৃদ সমস্যা মানে প্রায়ই হতে পারে আকস্মিক মৃত্যু। বরং দ্রুত হাসপাতালে যাওয়া এবং চেক আপ করানো অকাল মৃত্যুর চেয়ে অনেক ভালো, নয়কি?
এক ডজন হৃদউপসর্গ যা অবহেলা করার নয়ঃ ১। দুশ্চিন-া বা উদ্বেগ: হার্ট এটাক হলে হতে পারে তীব্র দুশ্চিন-া বা মৃত্যু ভয়। হার্ট এটাক থেকে ফিরে আসা অনেকে প্রলয়ের মুখোমুখি হবার অভিজ্ঞতা পরে বর্ননা করেন। ২। বুকে অস্বসি-: নারীদের মধ্যে হৃদরোগ নিয়ে একজন বড় গবেষক এবং আরকানমাস বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী ডক্টর জিন. সি. ম্যাকসুইনি বলেন, হার্ট এটাকের একনম্বর ও বৈশিষ্টসূচক উপসর্গ হিসেবে আমরা মনে করি ‘বুকে ব্যথা’ তবে সব হার্ট এটাকে বুক ব্যথা নাও হতে পারে এবং হার্ট থেকে নয় অন্যযন্ত্র থেকেও বুক ব্যথা অনেক সময় হতে পারে। হৃদরোগ জনিত বুক ব্যথা হয় সাধারনত: বুকের মধ্যখানে, কেন্দ্রের সামান্য বামেও হতে পারে। “এমন ব্যথা যে মনে হতে পারে, একটি বিশাল হাতি পা দিয়ে বুক গুড়িয়ে দিচ্ছে বা হাতি বুকে বসে আছে।”
আবার এমনও হতে পারে যে-বুকে চাপ, বা বুকে মোচড় বা বুক ভরাট এমন অস্বসি-র অনুভূতি। মেয়েরা হার্টের ব্যথা অনুভব করেন অনেক সময় সামান্য একটু ব্যথা হিসেবে। ব্যথার জন্য আমেরিকায় খুব বেশি ব্যবহৃত হয় টাইলেনল। তাই ম্যাকসুইনি বলেন, “নারীরা এমনও বলেন, কি এমন ব্যথা, সামান্য, টাইলেনল খাবার মত ব্যথাও হয়নি।” অথচ এ হয়ত হার্টের জন্য ব্যথা। পুরুষদের চেয়ে একটু ভিন্ন উপসর্গ হতে পারে মহিলাদের। যেমন বুকজ্বলা, বুকে ব্যথা বা অস্বসি- নয়। বুকজ্বলা হতে পারে হার্টের অসুখের জন্য। নারীদের হার্টের অসুখ সম্বন্ধে অপর বিশেষজ্ঞ নিউইউক সিটির ল্যাঙ্গোন মেডিকেল সেন্টারের বিশেষজ্ঞ ডা: নাইকা গোল্ডবার্গ বলেন, “পাকস্থলীর ব্যথা বলে ভ্রম করেন অনেকেই। ৩। কফ কাশ: অবিরাম কাশ বা বুকে শোশোঁ শব্দ হার্টের বিকল হবার উপসর্গ হতে পারে। ফুসফুসে জমে তরল। অনেক সময় হৃদনিস্ক্রিয়ার রোগী রক্তকাশও করতে পারেন। ৪। মাথা ঝিম ঝিম : হার্ট এটাক হলে মাথা হালকা লাগা বা চেতনা লোপ পাওয়ার মত ঘটনা ঘটতে পারে। হৃদছন্দে বড় রকমের অনিয়ম হতে পারে যাকে চিকিৎসার ভাষায় বলে “এবিদমিয়া”। ৫। ক্লানি-, অবসন্নতা: বিশেষ করে নারীদের মধ্যে অস্বাভাবিক ক্লানি- ঘটতে পারে হার্ট এটাকের সময় তবে কয়েক দিন, কয়েক সপ্তাহ ধরে ক্লানি- বোধ হতে পারে একসময় ঘটতে পারে হার্ট এটাক। সব সময় ক্লান- অবসন্ন থাকা হৃদযন্ত্র বিকল হবার লক্ষণ হতে পারে। সময় অপচয় তাই বিপজ্জনক, বলেন গোল্ডবার্ন। শরীর মন যদি ভালো না লাগে, পালে যদি হাওয়া না লাগে একটুও তাহলে কালক্ষেপন ঠিকনা, ডাক্তারের পরামর্শ চাই চটজলদি। ৬। বমি ভাব বা ক্ষুধামান্দ্য: বমিভাব বা বমি হওয়া হতে পারে হার্টের অসুখের উপসর্গ। পেট ফোলা এবং হৃদযন্ত্র বিকল এদুটো একত্র হলে ক্ষুধামান্দ্য হতে পারে। ৭। শরীরের অন্যত্র ব্যথা বেদনা: অনেকের হার্ট এটাক হলে বুকে শুরু হয় ব্যথা, সেই ব্যথা সরতে সরতে যায়-ঘাড়, কাধ, বাহু, কনুই, পিঠ, পেয়াল ও পেটে। আবার কখনও বুকে ব্যথা হয়না। ব্যথা হয় শরীরের অন্যত্র। ব্যথা আসে আর যায়। পুরুষের হার্ট এটাকের ব্যথা অনেক সময় হতে পারে বাম বাহুতে। নারীদের ক্ষেত্রে ব্যথা হতে পারে দুই বাহুতে বা পিঠের দুই পাখনার মধ্যখানে। ৮। দ্রুত বা অনিয়মিত নাড়ি: চিকিৎসকরা বলেন, হঠাৎ মাঝে মধ্যে একটি হৃদস্পন্দন চ্যুতি ঘটলে ভাবনার কিছু নাই তবে দ্রুত নাড়ি বা অনিয়মিত নাড়ি সেসঙ্গে দুর্বলতা, মাথা ঝিম ঝিম শ্বাসকষ্ট থাকলে হার্ট এটাকের লক্ষণ হতে পারে। হার্ট বিকল হওয়া বা হৃদছন্দে অনিয়মের লক্ষণ হতে পারে। চিকিৎসা নাহলে, হৃদছন্দে অনিয়ম থেকে হতে পারে স্ট্রোক, হৃদনিষ্ক্রিয়া বা হঠাৎ মৃত্যু। ৯। শ্বাসকষ্ট: বিশ্রামের সময়ও যদি মনে হয় বুকের ভেতর কুন্ডলী পাকিয়ে উঠছে, বা সামান্য পরিশ্রমে শ্বাসকষ্ট হলে শ্বাসযন্ত্রের রোগ হতে পারে যেমন হাঁপানি বা সিওপিডি (ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ)। শ্বাসকষ্ট নির্দেশ করতে পারে হার্ট এটাক বা হৃদনিষ্ক্রিয়া। “কখনও কখনও হার্ট এটাক হলে লোকের বুকে চাপ বা ব্যথা থাকে না তবে প্রবল শ্বাসকষ্ট থাকে।” বলেন, গোল্ডবার্ন। এমন যেন ম্যারাথন দৌড় যেমন শারীরিক শ্রম হয় তেমন হয়েছে কিছু সে ব্যক্তি নিশ্চল থেকেছেন।” হার্ট এটাক হলে শ্বাসকষ্টের সঙ্গে থাকতে পারে বুকে অস্বসি- তবে বুকে অস্বসি- ছাড়াও এটি ঘটতে পারে। ১০। ঘাম হওয়া: হার্ট এটাকের একটি সাধারন উপসর্গ হলো কুলকুল ধীরে শীতল ঘাম হওয়া। হয়ত চেয়ারে বসে আছেন, হঠাৎ করে শীতল ঘামে অবিরল ঝরতে থাকে শরীর বেয়ে যেন কত কঠোর ব্যায়াম করে এলেন। ঘামে নেয়ে একশা। ১১। স্ফীতি: হৃদযন্ত্র বিকল হলে শরীরে তরল জমা হতে পারে। এতে পায়ে, গোড়ালিতে, পায়ের পাতা বা উদরে পানি জমা হতে পারে। হঠাৎ শরীরে ওজন বাড়তে পারে বা ক্ষুধামান্দ্য হতে পারে। ১২। দুর্বলতা: হার্ট এটাকের সময়, হার্ট এটাক হবার আগের দিনগুলোতে অস্বাভাবিক দুর্বলতা হতে পারে শরীরে। ম্যাকসুযেনি বলেন, “একজন মহিলা আমাকে বলেছিলেন এমন মনে হচ্ছিলো যে দু’আঙ্গুলের ফাঁকে একটুকরো কাগজ ধরে রাখতে পারছিলামনা।”
অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরী
পরিচালক, ল্যাবরেটরী সার্ভিসেস
বারডেম, ঢাকা।
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, মে ২২, ২০১০
Leave a Reply