স্ট্রেস কী জানুন এবং মোকাবিলা করুন
আপনি কি চাপে আছেন?
স্ট্রেস কী
‘স্ট্রেস’ প্রকৃতির একটা সত্য বিষয়। আপনার চারপাশের একধরনের চাপ, যা আপনাকে প্রভাবান্বিত করে। সাধারণভাবে স্ট্রেস দেহের বাইরের ও ভেতরের উভয় ফ্যাক্টরের সঙ্গে সম্পর্কিত। বাইরের ফ্যাক্টরগুলো হচ্ছে ভৌত পরিবেশ, যেমন—আপনার কর্ম, অন্যের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক, আপনার বাসা প্রভৃতি। এ ছাড়া প্রতিদিন যে সমস্যাগুলো আপনি মোকাবিলা করেন, যেমন—অবস্থা, চ্যালেঞ্জ, সমস্যা ও প্রত্যাশা। ভেতরকার ফ্যাক্টরগুলো হচ্ছে আপনার দেহের স্ট্রেস প্রবৃত্তকারী ফ্যাক্টরগুলো।
স্ট্রেসের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
ফ্রান্সের শরীরবিদ্যা বিশারদ ক্লড বার্নার্ড সর্বপ্রথম এ বিষয়ে একটা ধারণা দেন যে আমাদের শরীরের ভেতরে একটি পরিবেশ আছে, যেটি স্থিতি অবস্থায় থাকার চেষ্টা করে, যা আমাদের বেঁচে থাকার জন্য অত্যাবশ্যক। বেঁচে থাকতে হলে শরীরের বাইরের ও ভেতরকার পরিবেশের মধ্যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া হওয়ার পর পরিপূরকতা হয়। বাইরের ফ্যাক্টরগুলোর উদাহরণ হচ্ছে তাপমাত্রা, বাতাসে অক্সিজেনের ঘনত্ব, শক্তির ক্ষয় ও আক্রমণকারীর উপস্থিতি। এ ছাড়া অসুখবিসুখও স্ট্রেস প্রবৃত্তকারী হিসেবে কাজ করে, যা আমাদের দেহের ভেতরকার পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
স্ট্রেস যথেষ্ট আয়ত্তের ভেতরে না থাকলে কী কী লক্ষণ ও উপসর্গ দেখা দিতে পারে
অতিরিক্ত স্ট্রেসের লক্ষণগুলো বিভিন্নভাবে প্রকাশ পায়, যা মানসিক, আচরণগত ও শারীরিক হতে পারে। স্ট্রেসের লক্ষণগুলো ব্যক্তিবিশেষে ভিন্ন হতে পারে। স্ট্রেস সহনশীলতা একেক জনের একেক রকম।
ক) শারীরিক (ফিজিক্যাল) লক্ষণগুলো হচ্ছে—
ঘুমের ব্যাঘাত
মাংসপেশিতে টান (টেনশন)
মাথাব্যথা
পরিপাকতন্ত্রে সমস্যা (কোষ্ঠকাঠিন্য, ডায়রিয়া বা বদহজম)
ক্লান্তি
ব্যাক পেইন
শ্বাসকষ্ট
ঘাড় বা চোয়াল শক্ত বোধ করা
দেহের ওজন বাড়া বা কমা
খ) মানসিক ও আচরণগত লক্ষণগুলো হচ্ছে
স্নায়ুবিক দুর্বলতা
দুশ্চিন্তা
খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন, যেমন—অতিরিক্ত খাওয়া
অনাগ্রহতা
উদ্যমহীনতা বা কর্মচাঞ্চল্যের অভাব
পরিবর্তিত মেজাজ (মুডি)
বিষণ্ন্নতা
অন্যের সঙ্গে সম্পর্কে সমস্যা
স্কুলে খারাপ ফলাফল
কারা স্ট্রেসের জন্য সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ?
স্ট্রেস বিভিন্নভাবে দেখা দেয় এবং সব বয়সের ও সব ধরনের মানুষ এতে আক্রান্ত হয়। স্ট্রেসের মাত্রা আমাদের জীবনে ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হতে পারে। ব্যক্তিগত ফ্যাক্টরগুলো হচ্ছে নিজের স্বাস্থ্য, আন্তব্যক্তিক সম্পর্কের মান, আমাদের কমিটমেন্ট ও দায়িত্বের সংখ্যা, আমাদের ওপর অন্যদের নির্ভরশীলতার মাত্রা, আমাদের প্রত্যাশা, অন্যদের কাছ থেকে কতটা সহায়তা আমরা পাই এবং কতটা পরিবর্তন বা কতটা বেদনাদায়ক ঘটনা আমাদের জীবনে ঘটেছে।
যারা অপুষ্টিতে ভোগে, যাদের ঘুম অপর্যাপ্ত, যারা শারীরিকভাবে অসুস্থ, তাদের প্রাত্যহিক চাপ এবং স্ট্রেস আয়ত্তে আনার ক্ষমতা কম এবং তারা সাধারণত উচ্চমাত্রার স্ট্রেস অনুভব করে। কিছু কিছু স্ট্রেস বয়সভেদে অনুভবিত হয়। যেমন—শিশু, টিনএজ, কর্মজীবী মা-বাবা ও প্রবীণ লোকদের স্ট্রেস তাদের বয়সের পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত।
টিন স্ট্রেস
শিশু থেকে কৈশোরে পদার্পণের সঙ্গে সঙ্গে কিশোর-কিশোরীরা একধরনের স্ট্রেসের মুখোমুখি হয় বাড়তি চাপের কারণে। এ বয়সে অতিরিক্ত স্ট্রেস পরবর্তী সময়ে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে, যেমন—বিষণ্নতা ও আত্মহত্যার ঝুঁকি। উপযুক্ত স্ট্রেস-ব্যবস্থাপনা তাদের নেতিবাচক পরিণতি কমাতে পারে।
স্বাভাবিক স্ট্রেস রেসপন্স
স্ট্রেস রেসপন্স অবশ্যই সঙ্গে সঙ্গে হতে হবে। প্রয়োজনীয় ফলাফল পর্যন্ত বজায় থাকবে এবং বন্ধ হয়ে যাবে সর্বোত্কৃষ্ট ফলাফল নিশ্চিত করার জন্য। অতিরিক্ত রেসপন্স বা রেসপন্স বন্ধ না হলে শরীরের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। মানবদেহে সুস্থ স্ট্রেস রেসপন্সের তিনটি উপাদান আছে।
মস্তিষ্ক তত্ক্ষণাত্ রেসপন্স করে: এই রেসপন্স অ্যাড্রেনাল মেডোলাকে সংকেত দেয় এপিনেফ্রিন ও নর-এপিনেফ্রিনকে দেহে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য।
হাইপোথ্যালমাস (মস্তিষ্কের একটি কেন্দ্রীয় এলাকা) এবং পিটুইটারি গ্লান্ড সংকেত পাঠায় অ্যাড্রেনাল কর্টেক্সকে দেহে কর্টিসল এবং অন্যান্য হরমোন ছাড়ার জন্য, যার ফলে ধীর রেসপন্স বজায় থাকে।
অনেক স্নায়ুজাতীয় সার্কিট কাজ করে আচরণগত রেসপন্সের জন্য। এই রেসপন্স সতর্কতা বাড়ায়, অধিকতর মনযোগী করে, শারীরিক মিলন ইচ্ছাকে নিরুত্সাহিত করে, ব্যথা কম অনুভূত হয় এবং আচরণকে প্রভাবিত করে।
এই সম্মিলিত প্রয়াসগুলো দেহের অন্তভারসাম্য (হোমিওস্টেসিস) বজায় রাখে, শক্তি উত্পাদন ও এর ব্যবহার বাড়ায় এবং দেহের ইলেকট্রোলাইট (দেহের একধরনের রাসায়নিক উপাদান) ও তরলের ভারসাম্য পরিবর্তন করে। এগুলো দেহকে দ্রুত কাজ করার জন্য সিমপ্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেমকে উজ্জীবিত করে, যা প্রকাশ পায় দ্রুত হূত্স্পন্দন, উচ্চরক্তচাপ, রক্তকে হৃৎপিণ্ড, মাংসপেশি ও মস্তিষ্কের দিকে পুনর্ধাবিত করে, রক্তকে পরিপাকতন্ত্র থেকে সরিয়ে নেয় এবং দেহে জ্বালানি সরবরাহ করে। ওই ব্যক্তিকে বিপদে ‘লড়াই করো অথবা পালাও’ (ফাইট অথবা ফ্লাইট) কাজটি বেছে নিতে এই স্ট্রেস রেসপন্স সহায়তা করে।
স্ট্রেসের পরিণতির শেষ কথা
অনিয়ন্ত্রিত, অনভিপ্রেত ও নিরন্তর স্ট্রেস আমাদের শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থের ওপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে। যেমন—অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডার, বিষণ্নতা, উচ্চরক্তচাপ, কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ, ইন্টেসটিনাল ডিজিজেস, কিছু ক্যানসার ও দ্রুত বুড়িয়ে যাওয়া। স্ট্রেস মাইগ্রেন ও অ্যাজমার পুনঃপুনঃ হওয়ার হার ও ব্যাপ্তি বাড়ায় এবং ডায়াবেটিস রোগীর রক্তে শর্করার পরিমাণও ওঠানামা করায়।
মাদক বা নিকোটিনে আসক্ত হওয়ার আশঙ্কাও বেড়ে যায় আচ্ছাদিত দীর্ঘস্থায়ী স্ট্রেসে। অতিরিক্ত ও দীর্ঘস্থায়ী স্ট্রেস, বিশেষ করে, আমরা যখন তা আগে থেকে বুঝতে পারি না বা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না, সেটা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
কীভাবে স্ট্রেস নিয়ন্ত্রণে রাখবেন
সর্বপ্রথম আপনাকে শিখতে হবে, আপনি কখন স্ট্রেসড।
যেটা আপনার নিয়ন্ত্রণে নেই, সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তা করবেন না, যেমন—আবহাওয়া।
ছোট ছোট সমস্যা সমাধান করুন আগে, যা আপনাকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা আনতে সহায়তা করবে।
একসঙ্গে অনেক সমস্যা সমাধানে না নেমে একটা করে সমাধান করুন।
দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টান, পরিবর্তনকে ভীতিকর না দেখে ইতিবাচক চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখুন।
আপনার সমস্যার ব্যাপারে বিশ্বস্ত বন্ধু, পরিবারের সদস্য বা কাউন্সেলরের সঙ্গে কথা বলুন।
বাস্তবসম্মত লক্ষ্য ঠিক করুন, বাড়াবাড়ি রকমের শিডিউল করবেন না।
সময়মতো এবং সুষম খাবার খান।
নিয়মিত ব্যায়াম করুন।
ধ্যান (মেডিটেশন) করুন।
এমন কিছু করুন, যা আপনার কাছে স্ট্রেসফুল মনে হবে না, যেমন—স্পোর্টস, সামাজিক অনুষ্ঠান অথবা শখের কিছু করা (হবি)।
নিজেকে সর্বোত্তম বা শ্রেষ্ঠ করার জন্য সর্বদা ব্যস্ত থাকবেন না।
মো. ইফতেখার হাসান খান
ফ্যামিলি মেডিসিন ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ২৬, ২০১০
joni
pondamo