যেখানে প্রেম যেখানে ভালোবাসা, সেখানেই নিরাপত্তা ও আশা। এই তো সেদিন বসেছিলাম। হঠাৎ মনে এল একটি প্রশ্ন। কেন বলো তো বড় বড় প্রতিষ্ঠান ক্রমে ধসে পড়ে? কেন পরিবার ভেঙে যায়? আমার পাশে বসা অনুজ সহকর্মী বলল, ‘ভালোবাসার অভাব।’ ভালোবাসার ফুল শুকিয়ে গেলে সবকিছু শুকিয়ে যায়, মরে যায়। সত্যি তাই।
মাঝেমধ্যে ভালোবাসার প্রকাশ দেখি। তখন মনে আনন্দ হয়। এ রকম একদিন দেখলাম, ওরা দুজন বসে আছে মুখোমুখি, ক্যাফের জানালার পাশে। ওদের বয়স ৩০-৪০ যা-ই হোক, সত্যি বলতে কি, তারা যেন সময়কে অতিক্রম করে বসে আছে। দুজনের কারও মুখে কোনো কথা নেই। তবু ওরা দুজন ভালোবাসায় মগ্ন। যুগল প্রেমের স্রোতে ওরা ভাসে। ওদের মন ভালো, আনন্দে ভরপুর।
কী করে জানলাম? তাদের ভালোবাসার আলোর বিকিরণ এত জোরালো ছিল যে একটি নিয়ন সাইন যেন তাদের ওপর আলোকময় হয়ে জানাল, ‘ভালোবাসায়’ আছি। ভালোবাসায় পড়ি কেন?
হ্যাঁ, ভালোবাসা। প্রেম।
অমর প্রেম। রোমান্টিক প্রেমের একটি কবিতা লেখা হয়েছিল, পড়েছিলাম তরুণ বয়সের কথা। এক দম্পতি দাঁড়িয়ে ছিল সেতুটির রেলিং ধরে। এরপর হেঁটে এসে পায়ে চলা পথে পড়ল; মুখোমুখি হলো একটি তরুণ গাছের।
প্রথমবারের মতো ওরা পরস্পর চুম্বন করল। কয়েক বছর পর আজ গাছটি অনেক বড় হয়েছে, দম্পতি সেই বৃক্ষের চেয়ে খাটো। তবু তাঁরা ভালোবাসা বিনিময় করল, যা উভয়ের আত্মাকে স্পর্শ করল।
সেই কবিতাটি এভাবে শেষ হয়েছিল···
‘মনে আছে কি কখন,
আমার প্রিয়,
শেষ আমরা এখানে ছিলাম,
তুমি বলেছিলে, ‘ভয় হয়, যদি
এটি স্থায়ী না হয়?
কিন্তু দেখো, এই প্রেম আবার এসেছে ফিরে···’
বৃক্ষটি টিকেছিল। টিকেছিল প্রেমও। ক্যাফেতে বসা সেই জোড়াকে পেরিয়ে যেতে যেতে ভাবি, ওদের প্রেম টিকবে তো? কামনা করি, অমর হোক ওদের প্রেম। আমরা কেন তাহলে প্রেমে পড়ি?
প্রেম কি সব সময় স্থায়ী হয় না, তা জেনেও। কারণ প্রেম ভালোবাসার বিকল্প নেই। এ কি চিত্তের চাপল্য, নাকি লঘু মনের প্রকাশ? আত্মভোলা হয়ে মনের প্রবল তাগিদ আসে অন্য এক মানুষের সঙ্গী হওয়ার। যা-ই হোক, পৃথিবী রসাতলে যাক, ঠিক এখনই যা ইচ্ছে করা, যা খুশি বলা, লোকে যা বলুক না বলুক।
এই তরলমতি, মাথা ঝিমঝিম অবস্থা বেশি সময় থাকে না, সৌভাগ্য হলে এ থেকে আরও শক্তিশালী স্থিতিশীল অনুভূতি পালাক্রমে স্থায়ী হয় জীবনভর।
ভালোবাসার চেয়ে ভালো কাজ আর নেই। সন্তানদের ভালোবাসি, মা-বাবাকে ভালোবাসি, বন্ধুদের ভালোবাসি, সহকর্মীদের ভালোবাসি, দেশকে ভালোবাসি, ভালোবাসি মহান সৃষ্টিকর্তাকে।
সব ভালোবাসাই ্নরণীয়, তবে রোমান্টিক প্রেম সম্মোহনী প্রেম। এক রোমান্টিক যুগলের কথা বলি। আটপৌরে এক রেস্তোরাঁয় মুখোমুখি বসেছিলেন তাঁরা।
সাড়ে তিন ঘণ্টা পার হলো, একসময় রেস্তোরাঁর স্টাফ বিনয়ের সঙ্গে জানাল, রোস্তোরাঁ বন্ধ করার সময় হয়েছে।
রেস্তোরাঁ থেকে বের হওয়ার পরও গাড়ির পাশে আধঘণ্টা দাঁড়িয়ে বাকবাকুম পায়রা···। তাঁরা চলচ্চিত্রের তারকা ছিলেন না-ছিলেন নিতান্তই সাধারণ মানুষ। কিন্তু রোমান্টিক প্রেমের মধ্যে কি জাদু আছে?
এটি সাধারণ মানুষকে তাদের নিজস্ব চলচ্চিত্রের নক্ষত্র বানিয়ে ফেলে। সাধারণ জীবনকে অসাধারণ করে তোলে। ১৬ বছর পর সেই দম্পতির এখন তিনটি সন্তান, সংসারের ঝুটঝামেলা, প্রতিদিনের টানাপোড়েন।
জীবন খুব কঠিন, অনিশ্চিত ও বিপৎসংকুল। কিন্তু এখনো তাঁরা পরস্পর দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ। সেই আটপৌরে রেস্তোরাঁর ্নৃতি এখনো তাঁরা রোমন্থন করেন। রোমান্টিক প্রেমের মধ্যে যেমন আনন্দ আছে, তেমনি দুঃখও আছে; মিলন যেমন আছে, বিচ্ছেদও আছে। এ নিয়েই ভালোবাসার দিনরাত্রি। সেই দম্পতির জ্যেষ্ঠ সন্তানটিও প্রেমে পড়েছে। আমাদের জীবনের মধ্য দিয়ে সাঁতার কেটে ভেসে বেড়ায় যে শক্তি, তা-ই রোমান্টিক প্রেম।
মানুষ এর জন্য মরে। আবার বাঁচেও। যখন একে পায়, নিরাশও হতে হয় অনেক সময়। প্রেমের জন্য মানুষ কী যে পাগলামো করে! একজন মনোরোগ চিকিৎসক বলেছেন, ‘রোমান্টিক লাভ ইজ দ্য অনলি সোশিয়ালি একসেপটেবল ফরম অব ম্যাডনেস।’ সৌভাগ্যবান হলে এই পাগলামোকে বশে আনা যায়। এটি একটি শক্তিতে পরিণত হয়, যা প্রতিদিন আমাদের রক্ষা করে।
সেই রোমান্টিক যুগল এখন প্রবীণ হয়েছে। এখনো তাঁদের প্রেমময় বন্ধন রয়েছে একেবারে অটুট-সেই প্রথম দিনের মতোই।
মহান সৃষ্টিকর্তা ভালোবাসার মধ্য দিয়ে আমাদের সাক্ষাৎ দেন। যেখানে ভালোবাসা আছে-সত্য, সত্যিকার ভালোবাসা যেখানে আছে-সেখানে পরম করুণাময়ও আছেন।
সেখানে গমন করুন এবং আপনি থাকবেন নিরাপদ।
‘তুমি বলেছিলে, তোমার ভয়, যদি এটি স্থায়ী না হয়? কিন্তু দেখো, আবার এটি এসেছে ফিরে।’
পদার্থবিজ্ঞানের পণ্ডিত একে প্রমাণ করতে পারেননি এখনো, তবে এ কথা জেনে রাখবেন-এটি সত্য। ভালোবাসা হলো আমাদের একটি অংশ, যার কখনো মৃত্যু নেই।
অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরী
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো
Leave a Reply