বিশ্ব হেপাটাইটিস অ্যালায়েন্স ২০০৮ সালে যকৃতের রোগ নিয়ে যে উদ্যোগ নিয়েছিল এরই ধারাবাহিকতায় ২০১০ সালের ১৯ মে পালিত হচ্ছে তৃতীয় বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস। রোগীদের কল্যাণে রোগীবান্ধব এই উদ্যোগ হলো বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস। এই দিবস পালনের মূল লক্ষ্য হলো হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ সম্বন্ধে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা। এ ছাড়া এ ব্যাপারে রাজনৈতিক সমর্থন আদায় করাও এ দিবসের উদ্দেশ্য।
বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবসের দীর্ঘ মেয়াদি উদ্দেশ্য হলো নতুন সংক্রমণ রোধ করা এবং হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’তে আক্রান্ত লোকদের স্বাস্থ্যের সুপরিণতি নিশ্চিত করা।
এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য বিশ্ব হেপাটাইটিস অ্যালায়েন্স বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের বিশেষজ্ঞ যাদের হেপাটাইটিস ও জনস্বাস্থ্য বিষয়ে তাৎপর্যপূর্ণ অভিজ্ঞতা রয়েছে এদের মধ্যে কয়েকজনকে নিয়ে গঠন করেছে জনস্বাস্থ্য প্যানেল।
এই জনস্বাস্থ্য প্যানেল বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস অভিযান সম্বন্ধে তথ্য বিতরণ ও পরিচালনার ক্ষেত্রে উপদেষ্টা পরিষদ ও বিশেষজ্ঞ রেফারেন্স দল হিসেবে কাজ করবে।
বাংলাদেশে বারডেম হাসপাতালের হেপাটো-বিলিয়ারি-প্যানক্রিয়েটিক সার্জারি ও লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট সার্ভিসের প্রধান অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী এই প্যানেলের সদস্য হওয়ার বিরল সম্মান অর্জন করেছেন। ১২ সদস্যের এই প্যানেলে রয়েছেন নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ব্লুমবার্গের মতো বিজ্ঞানী। যিনি সংক্রামক রোগের উৎস ও সম্প্রচারের নতুন দিক বিশেষ করে হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাস আবিষ্কারের জন্য ১৯৭৬ সালে পান নোবেল পুরস্কার।
হেপাটাইটিস বলতে সোজাভাবে বোঝায় যকৃতের প্রদাহ, নানা কারণে যা ঘটে থাকে। ক্রনিক (দীর্ঘস্থায়ী) হেপাটাইটিসের অন্যতম প্রধান কারণ হলো ভাইরাস সংক্রমণ।
এমন দুটি গুরুত্বপূর্ণ ভাইরাস হলো হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ যা একত্রে প্রতি বছরে পৃথিবীতে প্রায় ১০ লাখ মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বজুড়ে এখন পাঁচ কোটি মানুষ ক্রনিক হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’তে আক্রান্ত এবং তিনজনের মধ্যে একজন এদের একটি বা উভয় ভাইরাসের সংক্রমণের মুখোমুখি হয়েছেন। হেপাটাইটিস ‘বি’ কার্যকরী টিকা দিয়ে প্রতিরোধ করা সম্ভব। সন্দেহ হলে পরীক্ষা করে জেনে নেওয়া ভালো।
দুটি ভাইরাসই নীরব ভাইরাস, তেমন কোনো উপসর্গ থাকে না অনেকের, কোনো জানান না দিয়ে এই ভাইরাস থেকে যায় শরীরে দীর্ঘদিন। চিকিৎসা না হলে দুই ধবনের ভাইরাস ঘটাতে পারে সিরোসিসের মতো লিভারের বড় অসুখ।
সিরোসিস হলে রক্তক্ষরণ, পেটের ভেতর তরল জমা (অ্যাসাইটিস), সংজ্ঞালোপ, লিভারের ক্যানসার, নিষ্ক্রিয় ও মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে।
ক্রনিক হেপাটাইটিস ‘বি’ থাকলে সিরোসিস হওয়ার আগেই যকৃতের ক্যানসার ঘটে যেতে পারে।
কোনো সময় রোগনির্ণয় হয় খুব দেরিতে, এ জন্য একমাত্র বিকল্প হয় যকৃতের প্রতিস্থাপন (ট্রান্সপ্ল্যান্ট)। ঝুঁকি আছে মনে হলে তাই যত দ্রুত সম্ভব পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া ভালো। রোগ নির্ণয় হলে চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনা কৌশল মেনে চলতে হবে।
হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাস সংক্রমণকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বর্তমান দুনিয়ার বড় বড় রোগের অন্যতম হিসেবে চিহ্নিত করেছে। সবচেয়ে সচরাচর ভাইরাল সংক্রমণ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমান ২০০ কোটি মানুষ হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাসে সংক্রমিত এবং আনুমানিক সাড়ে তিন লাখ মানুষ ক্রনিক হেপাটাইটিস নিয়ে বেঁচে আছে—হেপাটাইটিস ‘বি’ সংক্রমিক হয়ে প্রতিবছর মারা যায় পাঁচ থেকে সাত লাখ মানুষ।
অত্যন্ত সংক্রমণক্ষম ভাইরাস হলো হেপাটাইটিস ‘বি’ এইচআইভি থেকে ৫০-১০০ গুণ বেশি সংক্রামক। দশজন পূর্ণবয়স্কদের মধ্যে নয়জনের ক্ষেত্রে তীব্র হেপাটাইটিস বি সংক্রমণ প্রথম ছয় মাসে এমনিতেই শরীর থেকে সরে যায়, কিন্তু ভাইরাস ক্রনিক হয়ে গেলে ক্রমে ক্রমে কারও কারও ক্ষেত্রে হতে পারে সিরোসিস।
সংক্রমিত লোকের দেহতরল যেমন রক্ত, বীর্য, ঘর্ম, অশ্রু এমনকি বুকের দুধেও থাকতে পারে হেপাটাইটিস ‘বি’। বেশির ভাগ লোকের থাকে না উপসর্গ।
তবে সংক্রমণরোধের জন্য রয়েছে টিকা। ঝুঁকি থাকতে পারে মনে হলে সত্বর টিকা নেওয়া উচিত। হেপাটাইটিস ‘সি’ ‘বি’ থেকে একটু ভিন্ন। এই ভাইরাস বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শরীরে থাকে ছয় মাসের বেশি, এরপর হয়ে যায় ক্রনিক। পাঁচজনের মধ্যে চারজনের হতে পারে ক্রনিক সংক্রমণ ১৫-৩০ বছরের মধ্যে সিরোসিস, ক্যানসারের মতো বড় অসুখ। বিশ্বজুড়ে প্রায় হেপাটাইটিস ‘সি’র ক্রনিক সংক্রমণে আক্রান্ত রয়েছে ১৭০ মিলিয়ন মানুষ।
দূষিত রক্তের সঙ্গে রক্তের সংস্পর্শে এ রোগ ছড়ায় হেপাটাইটিস বির মতোই। কোনো উপসর্গ ছাড়াই নীরবে থাকতে পারে এ রোগ।
হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাস দূষিত দেহতরল যেমন রক্ত, বীর্য, এসবের সরাসরি সংস্পর্শে এবং হেপাটাইটিস ‘সি’ দূষিত রক্তের সংস্পর্শে ছড়ায়। সংক্রমণের প্রধান পথগুলো হলো।
স্ক্রিননাকরা রক্ত বা রক্ত উপজাত দ্রব্য ভরণ করলে (Unscৎeened / Blood Tৎansfusion) বড় ঝুঁকি। তাই রক্তভরণের আগে রক্তে কোনো দূষিত সংক্রমণ আছে কি না তা যাচাই করে নিতে হবে।
নিবীর্জন না করে যন্ত্রপাতি দ্বারা শল্যচিকিৎসা বা দাঁতের সার্জারি করলে।
শিশু জন্মের সময় সংক্রমিত মা থেকে শিশুতে।
ওষুধ ইনজেকশনের সুচ সিরিঞ্জ শেয়ার করলে।
রেজর, টুথব্রাশ শেয়ার করলে।
নিবীর্জন না করা যন্ত্র দিয়ে ট্যাটু করলে।
সংক্রমিত লোকের সঙ্গে অনিরাপদ শারীরিক মিলনে হেপাটাইসি ‘বি’ সংক্রমণ ঘটার সম্ভাবনা থাকে।
হেপাটাইটিস ‘বি’ সংক্রমণের/প্রতিরোধের শ্রেষ্ঠ উপায় হলো টিকা নেওয়া। হেপাটাইটিস সির কোনো টিকা এখনো নেই।
রোগ নির্ণয়
হেপাটাইটিস ‘বি’ নির্ণয়ের জন্য রক্তকে এইচবি সারফেস এন্টিজেনের জন্য টেস্ট করতে হয় (HBsAg)। HBs এন্টিজেন হলো ভাইরাসের একটি অংশ যা সংক্রমণের ৬-১২ সপ্তাহের মধ্যে রক্তে দেখা দেয়। টেস্ট পজিটিভ হলে হেপাটাইটিস বি পজিটিভ বোঝা গেল। এমন হলে চিকিৎসক আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখবেন, হেপাটাইটিস ‘বি’ সংক্রমণটি নতুন না পুরাতন, শরীরের এটি ক্ষতি করেছে কি না, চিকিৎসা প্রয়োজন কি না। স্বাভাবিকভাবে যদি ভাইরাস শরীর থেকে সরে যায় তো হলো অথবা যদি টিকা দেওয়া থাকে, তাহলে রক্তে থাকবে হেপাটাইটিস ‘বি’ এন্টিবডি (anti-HBs)। ভাইরাসকে ধ্বংস করার জন্যই এদের সৃষ্টি। এন্টি HBs থাকলে ভালো, বোঝা গেল হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাসের ভবিষ্যৎ সংক্রমণ হলে শরীর পাবে সুরক্ষা। হেপাটাইটিস ‘সি’র জন্য প্রথমে চেক করা হবে এইচসিভি এন্টিবডি (anti-HCV) টেস্ট পজিটিভ হলে বোঝা গেল ভাইরাস অধুনা রয়েছে অথবা ভাইরাস ছিল সরে গেছে। হেপাটাইটিস ‘সি’ এন্টিবডিগুলোর রক্তে আবির্ভূত হতে সংক্রমণের পর সাত-নয় সপ্তাখানেক সময় লাগে। রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা বেশ দুর্বল থাকলে এইসিডি এন্টিবডি হাজির হতে বেশ সময় লাগে, কখনো হাজির হয়ই না। প্রথম টেস্ট পজিটিভ হলে আরও টেস্ট করতে হয় যেমন এইসিভি আরএনএ। এটিও পজিটিভ হলে হেপাটাইটিস ‘সি’ রয়েছে বুঝতে হবে।
হেপাটাইটিস ‘বি’ বা ‘সি’ নির্ণয় হলে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা প্রয়োজন হয়। অগ্রসর হতে হবে সাহসের সঙ্গে। এ রোগ যাতে অন্যদের শরীরে না ছড়ায় তা খেয়াল করতে হবে। চিকিৎসা কী কী রয়েছে এ নিয়ে ভারতে হবে, নিজের ব্যবস্থাপনা কৌশলও বেছে নিতে হবে।
২০১০ সালে বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস অভিযান যে লক্ষ্য নিয়ে এগুচ্ছে সেগুলো হলো—
বিশ্বজুড়ে ভাইরাস হেপাটাইটিস সংক্রমণের যে বিস্তৃতি এটি যেন জনগণ, গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
ভাইরাস হেপাটাইটিসের বিশ্বজুড়ে নানা রোগীর যে রোগভোগের কাহিনি, প্রকৃত জীবনে একে মোকাবিলা করার কাহিনি সম্প্রচার।
২০১০ সালে বিশ্ব হেপাটাইটিস এলায়েন্সের নতুন অভিযান শুরু করল ‘এই হলো হেপাটাইটিস’—এই রোগে যারা ভুগছেন এমন রোগীরা তুলে ধরবেন জীবনকাহিনি…।
এর মধ্য দিয়ে কিছু কথা মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করা হবে—
প্রতিরোধ। সুরক্ষা নিন—নতুন সংক্রমণ প্রতিরোধের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ এর ঝুঁকিগুলো জানা ও চেনা।
রোগ নির্ণয়। টেস্ট করিয়ে নিন— হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ আছে কি না তা টেস্ট করা সহজ-সরল, ঝুঁকি আছে মনে হলে সত্বর, টেস্ট করিয়ে নিন।
সুরক্ষা। টিকা নিয়ে নিন। হেপাটাইটিস ‘বি’ সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য রয়েছে টিকা।
চিকিৎসা। চিকিৎসা নিন। অনেক ক্ষেত্রে ‘বি’ ‘সি’ সংক্রমণে চিকিৎসা হয় ফলপ্রসূ।
অধ্যাপক ডা. শুভাগত চৌধুরী,
পরিচালক,ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস,
বারডেম হাসপাতাল, সাম্মানিক অধ্যাপক
ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ, ঢাকা।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ১৯, ২০১০
Leave a Reply