আমি হেপাটাইটিস বি। বিশ্বের ৩৫০ থেকে ৪০০ মিলিয়ন মানুষকে আক্রান- করেছি। এর মধ্যে ৭৫% ই এশিয়া মহাদেশে বসবাস করে। আমার আক্রমণের ফলে বিশ্বে প্রতি বছর এক মিলিয়ন মানুষ মারা যায়। পুরুষ মানুষ আমার দ্বারা আক্রান্ত হলে মৃত্যুর ঝুঁকি বেশী, কিন্তু মহিলাদের ক্ষেত্রে এই ঝুঁকি কিছুটা কম।
আমার কথা হয়ত অনেকেই শুনে থাকবেন। আমাকে দেখে সবাই ভয় পায়। আমি আপনাদের অতি পরিচিত হেপাটাইটিস বি ভাইরাস। আমার নাম শুনলে নিশ্চয়ই আপনি চমকে উঠবেন। চমকানোরই কথা, কারণ আমি অক্টোপাসের মত আপনাদের শরীরে একবার ঢুকলে আর বের হতে চাই না। আমার স্বভাবটাই এরকম মানুষের রক্তের গন্ধ পেলে আমার সাহস ও শক্তি বেড়ে যায় এবং বংশবৃদ্ধি করার ইচ্ছে জাগে। আমাকে প্রথম আবিস্কার করে ১৯৬৫ সালে ডঃ ব্লুমবার্গ ও তাঁর বৈজ্ঞানিক দল। তাঁরা অস্টেলিয়ার আদিবাসী এবওরিজিনালদের রক্তে আমার দেহের বাইরের আবরণের একটি বিশেষ অংশ আবিস্কার করে ফেলে। যার নাম হল ঐইংঅম, এই নামেই প্রথম আমি বিশ্বে প্রকাশ লাভ করি। আমাকে আবিস্কারের জন্য ডঃ ব্লুমবার্গ নোবেল পুরস্কার লাভ করেন ১৯৭৫ সালে। আমার আত্ম প্রকাশের পর আমি মানুষের জ্বালা যন্ত্রণায় আর টিকতে পারছি না। আমার প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গই এই মানুষেরা খুড়ে খুড়ে আবিস্কার করে ফেলেছে। আমি যে কি দিয়ে গঠিত তা আপনাদের নিশ্চয় জানতে ইচ্ছে হচ্ছে। তাহলে শুনুন, আমার শরীরের একেবারে অভ্যন-রে থাকে কোর এনটিজেন, উঘঅ (ডি, এন, এ), পলিমারেজ এবং ই (ব) এনটি জেন। আপনারা হয়তোবা এই কথাগুলো বেশী বুঝতে পারছেন না। কিন্তু বৈজ্ঞানিকগণ এমনই চতুর যে সবকিছুই বের করতে তারা সফল হয়েছে। আমার দেহের বাইরের আবরণতো প্রথমেই বের করে ফেলেছে। এবার আমি বলব, আমার দেহের অভ্যন-রে ডি.এন.এ কিভাবে গঠিত হয়। উঘঅ গঠিত হয় দুই স-রে। গোলাকার ভিতরে আবরণের সাথে সিংগেল স্ট্রানডেড ফাকা স্থান যেগুলো ৬০০-২১০০ নিউক্লিও টাইড দিয়ে পুরা করা হয়।
এবার নিশ্চই বিশ্বে আমার প্রাদুভার্ব কি রকম এ বিষয়ে জানতে ইচ্ছে হয়। বিশ্বে আমি ৩৫০ থেকে ৪০০ মিলিয়ন মানুষকে আক্রান- করেছি। এর মধ্যে ৭৫% ই এশিয়া মহাদেশে বসবাস করে। আমার আক্রমণের ফলে বিশ্বে প্রতি বছর এক মিলিয়ন মানুষ মারা যায়। পুরুষ মানুষ আমার দ্বারা আক্রান্ত হলে মৃত্যুর ঝুঁকি বেশী, কিন্তু মহিলাদের ক্ষেত্রে এই ঝুঁকি কিছুটা কম। বিশ্বে আমার প্রাদুভার্বের পর এবার শুনুন বাংলাদেশে আমার প্রকোপ কতটুকু। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত দেখা গেছে, আমি ১০%-৩৫% ক্ষেত্রে স্বল্প মেয়াদী যকৃতের প্রদাহের সৃষ্টি করি। ৩৫.৭% ক্ষেত্রে খুবই কম সময়ের মধ্যে যকৃতকে নষ্ট করে মানুষকে মেরে ফেলতে পারি। ৩৩.৩% – ৪০.৫% দীর্ঘ মেয়াদী যকৃতের প্রদাহের সৃষ্টি করতে পারি। ২৫-৫০% ক্ষেত্রে আমি যকৃতের ক্যান্সারের সৃষ্টি করতে পারি। আমি আমার সন্বন্ধে এত কিছু আপনাদের বলতে চাই না তবুও বলতে বাধ্য হচ্ছি। কারণ আমি কিভাবে ছড়াই এবং মানুষের শরীরে প্রবেশ করে যকৃতের প্রতিটি কোষকে ধ্বংস করার চেষ্টা করি তা মানুষ জেনে আমাকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করছে। আমার দ্বারা আক্রান্ত মানুষের শরীরের সমস্ত কোষকেই আমি আক্রান- করে থাকি। আমি সাধারণত রক্ত ও রক্তরসের মাধ্যমে সংক্রমিত হই। এছাড়া মানুষের লালা, শরীরের যেকোন ধরনের নিঃসরণের মাঝে আমি বিদ্যমান থাকি। দৈহিক মিলনের ফলেও আমি নারী, পুরুষ ও একে অপরের মাঝে ছড়াতে পারি। আর একটি মজার কথা গর্ভবতী মা যদি আমার দ্বারা আক্রান্ত হয় তাহলে সেই মা হতে আমি তার শিশুতেও স্থানান্তরিত হতে পারি। আমি মানুষকে আক্রান্ত করার পর তার শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে গিয়ে বাসা বাধি। যদি আমার দ্বারা আক্রান্ত মানুষের শরীরের যে কোন অঙ্গ কোন সুস্থ মানুষে প্রতিস্থাপন করা হয় তাহলে আমি সেই সুস্থ মানুষকেও আক্রান্ত করতে পারি।
তবে আমার পছন্দের অঙ্গ হলো মানুষের যকৃত এতে আমি বাসা বাধি। মানুষরা গুণে পরিসংখ্যান করে ফেলেছে যে, আমি মানুষ হতে মানুষে এবং ৯০% ক্ষেত্রে আমি গর্ভবর্তী মা হতে তার শিশুতে সংক্রমিত হতে সক্ষম।
অনেক দেশে মানুষ নিজের চামড়া নকশা আঁকতে ভালবাসে, শরীরটা বিদঘুটে করে ফেলে। তারা মনে করে, যে এতে তাদের সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায়। আসলে এর সাথে তার দেহে যে জম ঢুকছে তা তাদের খেয়াল থাকে না। কারণ দূষিত মেশিন ও সুই এর মাধ্যমে ট্যাটু করা হলে আমি তার মধ্য দিয়ে মানুষের শরীরের মধ্যে প্রবেশ করি। ট্যাটু করার এই সুঁইগুলো একের পর এক মানুষে ব্যবহার করা হয় যার কারণে এগুলো আমার দ্বারা দূষিত হয়। এছাড়া চাইনিজ পদ্ধতিতে চিকিৎসা যেমন আকুপাংচার সুই এর মাধ্যমেও আমি ছড়িয়ে পড়তে পারি। আমি মানুষের দেহের কি কি ক্ষতি করতে পারি, তা মানুষ তাদের দীর্ঘ দিনের প্রচেষ্টার মাধ্যমে আবিস্কার করে ফেলেছে। জন্ডিসে আক্রান্ত বাংলাদেশের ২২ শতাংশ মানুষকে শুধুমাত্র আমিই আক্রমণ করে থাকি। এটাতো শুধু বাংলাদেশের কথা। পৃথিবীব্যাপী আমার বিস্তৃতি। সারা পৃথিবীতে মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ আমার দ্বারা আক্রান্ত । আমি লিভার আক্রান্ত করে চুপি চুপি দীর্ঘ সময় ধরে যকৃতের ক্ষতি সাধন করে থাকি।
এখন আমি আপনাদের বলব কিভাবে আমি যকৃতে ঢুকার পর পর্যায়ক্রমে ক্ষতি সাধন করে থাকি। কখনও আমি কোন কিছুই করি না। মানুষ আমাকে নিয়ে বয়ে বেড়ায় সুস্থ অবস্থায়। কোন কোন সময় আমি আমার সবাত্মক প্রচেষ্টায় আক্রমণ করে খুবই দ্রুত যকৃতের ধ্বংসের কারণ হই। মাঝে মাঝে আমি স্বল্পমেয়াদী যকৃত প্রদাহের সৃষ্টি করে থাকি এবং মানুষ পুনরায় ভাল হয়ে যায়। এক্ষেত্রে জন্ডিস দেখা দিতে পারে অথবা নাও দেখা দিতে পারে। দীর্ঘ মেয়াদী সমস্যার কথা চিন্তা করলে আমি যকৃতের সিরোসিস এবং ক্যান্সারের সৃষ্টি করি। বয়স্ক মানুষকে আক্রমণ করলে ৮৫ ভাগ ক্ষেত্রেই তারা ভাল হয়ে যায়। বাকি ১৫ ভাগ ক্ষেত্রে দীর্ঘ মেয়াদী সমস্যাগুলো দেখা দেয়। কিন্তু আমি শিশুদের আক্রমণ করে তাদের বেশী ক্ষতি করতে পারি। ৯৫ ভাগ শিশুরা সাধারণত দীর্ঘমেয়াদী সমস্যার সম্মুখীন হয় এবং শুধুমাত্র পাঁচ ভাগ শিশু ভাল হয়ে যায়। অনেক মানুষ চিন্তা করে যে আমি শুধু মাত্র লিভারকেই আক্রান- করতে পারি। আসলে তাদের এই চিন্তা ভুল। আমি শুধু যকৃতই নয় বরং এছাড়া দেহের বিভিন্ন অংশে আমি নানাভাবে ছড়িয়ে পড়ি এবং আক্রমণ করে থাকি। মানুষের শরীরের যে রক্তনালী রয়েছে যেমন ছোট, মাঝারি এবং বড় আকারের, সবধরনের রক্তনালীতেই আমি আক্রমণ করে থাকি এবং প্রদাহের সৃষ্টি করি। একে ইংরেজীতে বলে পলিআরটারিটিস। আমিতো আগেই বলেছি, আমার শরীরে বিভিন্ন ধরনের এনটিজেন রয়েছে। আমি যখন মানুষের শরীরের রক্তনালীগুলোতে প্রবেশ করি তখন রক্তের মাঝে যে সৈনিক থাকে (মানুষের নিজস্ব প্রতিরোধের জন্য থাকে। একে বলে এনটিবডি) তাদের সাথে আমার এনটিজেন মিলিত হয়ে একটি যৌগ তৈরী করে থাকে যার নাম এনটিজেন এনটিবডি কমপ্লেক্স। এই যৌগটি রক্তনালীতে জমা হয় এবং ক্ষতি সাধন করে।
আপনারা ভাল করেই জানেন মানুষের শরীরের আর একটি অন্যতম অঙ্গ হচ্ছে কিডনি বা বৃক্ক। একটি কিডনির কাজ হচ্ছে মানুষের দেহের বর্জ্য পদার্থ বের করে দেওয়া। আমি এতই ভয়ংকর যে, যে কোন সময় কিডনিকে আমি আক্রান্ত করতে পারি। আক্রান্ত করে আমি কিডনিতে প্রদাহের সৃষ্টি করে থাকি। ইংরেজীতে চিকিৎসার ভাষায় একে বলে গ্লোমেরুলোনেফ্রাইটিস।
বর্তমানে মানুষেরা আমাকে প্রতিরোধ করার জন্য টিকা বের করেছে। সময় মত এই টিকা তিনটি ডোজ দিলে এবং একটি বুস্টার ডোজ দিলেই মানুষের দেহে আমার বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার সৃষ্টি হয়। এছাড়া আমি যেভাবে ছড়িয়ে থাকি সেই সব সম্পর্কে সচেতন হলে আমাকে প্রতিরোধ করা সম্ভব। মানুষ তাদের রক্তে বিভিন্ন পরীক্ষা করে আমার উপস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে থাকে। যেমন প্রথমে ঐইংঅম পরীক্ষা করে নিরুপন করে আমি উপস্থিত আছি বা নেই। যদি থাকি তবে সেক্ষেত্রে ঐইবঅম পরীক্ষা করে দেখে আমার কার্যক্ষমতা। রক্তের মধ্যে উঘঅ পর্যবেক্ষন করে তারা আমার বংশ বৃদ্ধির মাত্রা নিরুপন করে এবং আমার বিরুদ্ধে চিকিৎসার ব্যবস্থা নিয়ে থাকে।
আজকালের আধুনিক যুগে মানুষ বিভিন্ন ধরনের ঔষধ আবিস্কার করেছে। সেগুলো আমার বিরুদ্ধে খুবই কার্য্যকর। এর মধ্যে রয়েছে ইন্টারফেরন ইনজেকসন, এছাড়া রয়েছে, মুখে খাওয়ার – ল্যামিভুডিন, ট্যালবিভুডিন, এডেফেবির, টেনোফেভির এবং এন্টেকাভির ইত্যাদি। এই ঔষধগুলোর মাধ্যমে মানুষ আমাকে যকৃতের ক্ষতি সাধন থেকে বারন করছে এবং এক সময় অক্ষম করে দিচ্ছে। কোন কোন সময় আমাকে মৃত্যুর মুখে ধাবিত করে দেয়।
অতএব আমার সংক্রমণের হাত হতে সাবধান হউন। যদিও এতে আমার জীবন হানি হবে আর মানুষের হবে উপকার।
অধ্যাপক ডা. মবিন খান
পরিচালক, দি লিভার সেন্টার, ধানমন্ডি আ/এ
ঢাকা-১২০৯
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, মে ০৮, ২০১০
Leave a Reply