শিশুর জন্মের আগেই মাতৃগর্ভে থাকা অবস্থায় জন্মগত ত্রুটি/রোগ শনাক্ত শুরু হয়েছে সেই দেড় যুগ আগে, নতুন প্রযুক্তির আবির্ভাব এবং তার সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে। নতুন নতুন প্রযুক্তি ও পদ্ধতির আগমনে চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নয়ন ও অগ্রগতি ঘটছে অতি দ্রুত।
আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে অনেক আগেই শুরু হয়েছে এই প্রযুক্তির প্রয়োগ। দেড় যুগ পরও এখনো আমরা হাঁটি হাঁটি পা পা করছি এই ক্ষেত্রে।
যেহেতু দেশীয় সুনির্দিষ্ট কোনো সমীক্ষা আমার হাতে নেই, তাই একটি ভারতীয় অধুনা সমীক্ষার প্রসঙ্গ উল্লেখ করছি। সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, প্রতিবছর চেন্নাই (মাদ্রাজ) শহরে ১৪০০ শিশু ডাউনস সিনড্রোম নিয়ে জন্মাচ্ছে। অন্যান্য জন্মগত ত্রুটি নিয়ে ১১ হাজার ২০০ শিশু পৃথিবীতে আসছে। প্রায় ৭৫ লাখ জনসংখ্যার শহর চেন্নাইতে এই চিত্র থাকলে, প্রায় সোয়া কোটি জনসংখ্যার ঢাকা শহরে নিঃসন্দেহে বেশি বই কম হবে না।
এই সমীক্ষায় আরও দেখা যায়, সমগ্র ভারতে প্রতিবছর জন্মগত ত্রুটি এবং এর পার্শ্ব-অসুবিধায় ২৪ হাজার শিশু মৃত্যুবরণ করে তার প্রথম জন্মদিন পালনের আগেই। আরও ৪০ হাজার মৃত্যুবরণ করে পরবর্তী এক বছরের মধ্যেই। এ থেকে অন্তত এটুকু উপলব্ধি করা যায়, একই অক্ষরেখায় অবস্থিত বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীতে চিত্রটি সুখকর হবে না।
প্রতিটি পরিবার তাদের জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়ের শুরুতে অর্থাৎ বিবাহিত জীবনের শুরুতে একটি সুস্থ ও সবল শিশুর স্বপ্ন দেখে। চিন্তায় আসে না এই পৃথিবীতে তিন হাজারের বেশি রকমের বিভিন্ন ধরনের জন্মগত (শারীরিক বা মানসিক) ত্রুটি নিয়ে শিশু জন্ম নিচ্ছে। যখন মায়ের কোলজুড়ে এই বিপত্তি আসে—তখন সেই দম্পতি বা পরিবারে নেমে আসে নতুন দুর্ভোগ। মা-বাবা হয়ে পড়েন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। অনেক সময় সামাজিক (এমনকি পারিবারিক!) অবজ্ঞার পাত্র-পাত্রী। অথচ তাদের দোষই বা কী? কারণই বা কী! এবং করণীয়ই বা কী! আমি দেখেছি, অনেক দম্পতিকে কী দুঃসহ, গ্লানিকর জীবনকে মেনে নিতে; শুধুই শারীরিক কিংবা মানসিক ত্রুটিযুক্ত সন্তানের মা-বাবা হওয়ার কারণে। এমনকি পরিবারের সদস্য ও বন্ধুরাও অদ্ভুত আচরণের বহিঃপ্রকাশ করে থাকে। ‘সব দোষ নন্দ ঘোষ’ শেষ পর্যন্ত সেই মা!
আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, আলট্রাসাউন্ড করাকালে প্রতিটি মা সজ্ঞানে না হলেও একটা প্রশ্ন করেই থাকে, ‘আমার বাচ্চা ভালো আছে তো? কোনো অসুবিধা নেই তো?’
সৌভাগ্যবশত বেশির ভাগ শিশুই সুস্থ থাকে। কিন্তু প্রতি ১০০ শিশুর মধ্যে এক বা দুজন মারাত্মক অথবা সামান্য ত্রুটি নিয়ে জন্মায়। অনেক ত্রুটি শিশুর জন্মের আগেই নির্ধারণ করা যায় এবং অল্পসংখ্যক প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়ে প্রতিরোধ করা সম্ভব। কারণ যা-ই হোক, নতুন এই প্রিনেটাল ডায়াগনোসিস বা গর্ভস্থ অবস্থায় পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে শতকরা ৯৩ ভাগ সমস্যা নির্ণয় করা যায়। গর্ভাবস্থায় প্রথম তিন মাসের মধ্যেই গর্ভস্থ শিশুর কোনো শারীরিক সমস্যা আছে কি না অথবা আপাতত না থাকলেও পরবর্তী সময়ে ঝুঁকি আছে কি না, তা নির্ণয় করা যাবে দ্বিতীয় তিন মাসে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে। সমগ্র পরীক্ষা-নিরীক্ষার স্তর তিনটি—
(১) অতি আধুনিক আলট্রাসাউন্ড স্ক্যান।
(২) মায়ের রক্তরস স্ক্রিনিং ও
(৩) জেনেটিক পরীক্ষা
প্রথমত, প্রয়োজন নিখুঁত ছবি তোলার উপযোগী হাইরেজুলেশন আলট্রাসাউন্ড স্ক্যানার এবং অবশ্যই গর্ভস্থ শিশু চিকিৎসাবিজ্ঞানে অভিজ্ঞ চিকিৎসক।
দ্বিতীয়ত, প্রয়োজন মায়ের রক্তরসের বায়োকেমিক্যাল কিছু পরীক্ষা। এই দুই স্তরের সমন্বয়ে প্রায় ৯৩ শতাংশ জটিলতা নির্ণয় করা যায়। এই দুই স্তরে সমস্যা পেলেই কিছু ইনভেসিভ পরীক্ষা তৃতীয় ও শেষ স্তরে করতে হয়।
আলট্রাসাউন্ডের মাধ্যমে গর্ভস্থ শিশুর ঘাড়ের পেছনে পরীক্ষা (নিউক্যাল ট্রান্সলুসেন্সি) অথবা শিশুর মাথার বেড় (বিপিডি) এবং মায়ের রক্তরসের বিশ্লেষণের মাধ্যমে গর্ভস্থ শিশুর প্রায় ১০০টির ওপর গঠনগত শারীরিক ত্রুটি নির্ণয় করা অথবা ধারণা পাওয়া যায়।
তৃতীয়ত, যেসব গর্ভস্থ শিশুকে আলট্রাসাউন্ডের মাধ্যমে ত্রুটিযুক্ত হিসেবে নির্ণয় করা যায় অথবা নির্ণয় করা না গেলেও (মাইনর অথবা অকাল্ট ত্রুটি) গর্ভস্থ শিশুর ঝুঁকি হিসেবে নির্ণয় করা যায়। অর্থাৎ প্রথম স্তরের ত্রুটি অথবা দ্বিতীয় স্তরে ঝুঁকিযুক্তদের তৃতীয় স্তরে জেনেটিক টেস্টের মাধ্যমে চূড়ান্ত সমস্যা নির্ণয় করা সম্ভব। গর্ভস্থ শিশু বা ভ্রূণের জন্মগত ত্রুটি যেকোনো বয়সের মায়েদের মধ্যে দেখা যায়। তবে একটু বেশি বয়সী (৩৫ বছরের ঊর্ধ্বে) মায়েদের শিশুদের মধ্যে সম্ভাবনা বেশি। উল্লেখযোগ্য, শিশুর জন্মগত ত্রুটির মধ্যে অন্যতম একটি ডাউনস সিনড্রোম। সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০ বছর বয়সী মায়েদের ক্ষেত্রে প্রতি ৮০০ শিশুর মধ্যে একজন এবং ৩৫-ঊর্ধ্ব বয়সী মায়েদের ক্ষেত্রে প্রতি ১০০ শিশুর মধ্যে একজন এ রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকেন।
গর্ভাবস্থায় প্রথম তিন মাসে এ ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা মাকে দুশ্চিন্তামুক্ত করতে সাহায্য করে।
এই পরীক্ষার মাধ্যমে গর্ভাবস্থায়ই বিভিন্ন ঝুঁকি ও ত্রুটি সম্পর্কে জেনে নিয়ে প্রয়োজনীয় আগাম ব্যবস্থা নেওয়া যায়। মেরামতযোগ্য কিছু ত্রুটি সারিয়ে তুলতে প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা বা প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব।
পৃথিবীর কোনো দম্পতি শারীরিক ত্রুটিপূর্ণ অথবা মানসিক প্রতিবন্ধী শিশু কামনা করে না। প্রিনেটাল ডায়াগনোসিসের মাধ্যমে অনাগত মায়েদের মুখে হাসি ফোটানো সম্ভব। সমাজকে উপহার দেওয়া সম্ভব সুস্থ, সবল ভবিষ্যৎ নাগরিক।
ডা. মো. আজিজুল ইসলাম
ফেলো, ফিটাল মেডিসিন
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ০৫, ২০১০
Leave a Reply