ক্রিস্টিনা তাঁর ছেলেকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। ছেলেটি লেখাপড়ায় ভালো। ক্লাসে প্রথম হয়। ছেলের নাম রেখেছেন চেতনা। চেতনা পরীক্ষার পড়া ছাড়াও অন্যান্য বই পড়ে। পত্রপত্রিকার প্রতিও রয়েছে তার যথেষ্ট টান।
পরীক্ষা আসার সময় হলে ছেলের মাথাব্যথা বাড়ে। দূরের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে। ক্রিস্টিনা ছেলের জন্য টিউটর রেখেছেন। ছেলেকে কোচিং সেন্টারেও দিয়েছেন। পরীক্ষার ঠিক আগে তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হয়। ডাক্তার পরিচিত, চোখের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। প্রতিবারই চেতনাকে গ্লাস বদল করতে হয়। চেতনা চতুর্থ শ্রেণীতে অধ্যয়নকালে চশমা নিয়েছিল। ওই সময় ছেলের লেন্সের পাওয়ার ছিল -০.৫০ ডিএস। সে এখন ক্লাস সেভেনে পড়ছে। ইতিমধ্যে চোখের চশমার পাওয়ার বেড়ে তা দাঁড়িয়ে -৭.০ ডিএসে। চশমার পাওয়ারের এ ধরনের ক্রমাগত বাড়তিভাব দেখে ক্রিস্টিনা খুব টেনশনে রয়েছেন। স্বামীকে তাঁর দুশ্চিন্তার কথা জানিয়েছেনও। স্বামী ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। সময় নেই ছেলেকে নিয়ে চিকিত্সকের পরামর্শের জন্য চেম্বারে যাওয়ার। ক্রিস্টিনা সমস্যার কথা বললেই বলেন, ‘চিকিত্সকের কাছে যাও। চোখের পাওয়ার পরীক্ষা করিয়ে নাও।’
চশমার পাওয়ার বৃদ্ধির পর কয়েক দিন ছেলে ভালো থাকে। দূরের দৃষ্টি বাড়ে। মনের প্রসন্নতায় পড়াশোনাটাও বেড়ে যায়। কিন্তু দিন কয়েকের ভেতর আবার সেই একই সমস্যা। দূরে কিছুই দেখতে পারছে না, মাথাব্যথা হচ্ছে।
কাছে পড়তে গিয়েও চোখ সামান্য সময়ের ভেতর ঝাপসা হয়ে আসে। চশমা বদলের ধারাবাহিকতায় এখন চেতনার চোখের চশমার কাচ বেশ পুরু হয়েছে। চশমার দিকে তাকালেই বোঝা যায়, চোখের পাওয়ার অনেক। ক্রিস্টিনা ছেলেকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ছেন। ছেলের পাওয়ার ক্রমাগত বাড়তে থাকলে তা কোথায় গিয়ে যে দাঁড়াবে কে জানে? ক্রিস্টিনা শুনেছেন চোখের পাওয়ার ক্রমাগত বেড়ে চোখের রেটিনা নাকি নষ্ট হয়ে যায়, চোখ নাকি অন্ধ হয়ে যায়। ওপরের চিত্রে একজন মায়ের দুশ্চিন্তার বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। একই সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে স্কুলগামী কৃতী ছাত্রের ক্রমাগত দৃষ্টি-হ্রাসের চিত্র। এবার দেখা যাক, আসলেই কি চেতনার চোখ দিন দিনই কথিত মাত্রায় খারাপ হয়েছে?
চোখের মাইনাস পাওয়ার
দৃশ্যমান বস্তু থেকে অসংখ্য আলোকরশ্মি আমাদের চোখে আপতিত হয়। এ রশ্মি প্রতিসরিত হয়ে চোখের অভ্যন্তরে রেটিনায় প্রতিবিম্ব তৈরি করে। এই প্রতিবিম্ব দৃষ্টিস্নায়ুর সাহায্যে মস্তিষ্কে প্রেরিত হয়ে দৃশ্যমান বস্তু সম্পর্কে দৃষ্টির অনুভূতি তৈরি করে। এসব আলোকরশ্মি যখন রেটিনার সামনে প্রতিবিম্বিত হয় তখন তা স্বাভাবিক দৃষ্টির অনুভূতি তৈরি করে না। এ ক্ষেত্রে ‘মাইনাস’ লেন্স চোখের চশমায় লাগিয়ে আপতিত রশ্মিকে রেটিনায় ফেলা হলে তা সঠিক অনুভূতি তৈরি করে। মাইনাস লেন্সকে আমরা ‘মাইনাস পাওয়ার’ বলে থাকি। চোখের মাইনাস পাওয়ারের অবস্থানকে ‘মায়োপিয়া’ হিসেবে অভিহিত করা হয়।
ছদ্ম মায়োপিয়া
অনেক সময় স্বল্পমাত্রার চোখের পাওয়ারের অসুবিধা কাটিয়ে ওঠার ক্ষেত্রে চোখ নিজস্ব প্রয়াস চালায়। চোখের অভ্যন্তরে এক ধরনের মাংসপেশি রয়েছে, যা এ ক্ষেত্রে চোখের অভ্যন্তরে লেন্সের আকৃতি পরিবর্তন করে পাওয়ারজনিত সমস্যার নিরসন করে থাকে। চোখের অভ্যন্তরে মাংসপেশির সংকোচন এ কাজটি করে থাকে। অনেক সময় দেখা যায় পেশির সংকোচন দীর্ঘ সময়ব্যাপী ক্রিয়াশীল থাকলে তা চোখ ব্যথাসহ মাথাব্যথার উপসর্গ তৈরি করে। কেবল তাই নয়, তা দেখার ক্ষেত্রেও সমস্যা তৈরি করে। চোখ তখন দূরের জিনিস ঝাপসা দেখতে শুরু করে। এই যে চোখের অভ্যন্তরে পেশির সংকোচনের কারণে সমস্যাটির সৃষ্টি হলো, এটি প্রাথমিক পর্যায়ে নির্ণিত স্বল্প পাওয়ারের সমস্যাকে অধিক পাওয়ারের সমস্যায় রূপান্তরিক করে। পেশির অস্বাভাবিক সংকোচন সারিয়ে তুললে এ সমস্যাটি আর থাকে না। এ ক্ষেত্রে চোখের চিকিৎসক যদি তা না করে কেবল পাওয়ারের ত্রুটি নিরসনের জন্য চশমার পাওয়ার বদল করেন তাহলে সমস্যার মূল নিসরন হয় না। সাময়িক উপশমের মাধ্যমে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে নতুন সমস্যা তৈরি হয়। অর্থাত্ চোখের অভ্যন্তরে পেশির সংকোচন মাত্রাকে বাড়িয়ে দেওয়া হয়। এটি এক ধরনের দুষ্টচক্র তৈরি করে। এ রকম ক্ষেত্রে মাইনাস পাওয়ারের অস্বাভাবিক মাত্রায় বৃদ্ধি ঘটতে থাকে। এই অবস্থানকে ‘ছদ্ম মায়োপিয়া’ বলা হয়। অনেক সময় এ অবস্থা শিশুদের চোখের একটানা অতিরিক্ত ব্যবহার থেকেও ঘটতে পারে। আমাদের গল্পের ক্রিস্টিনার ছেলে চেতনার ক্ষেত্রে তাই ঘটেছে। চেতনার পাওয়ারের ত্রুটি ছিল প্রাথমিক পর্যায়ে কম। তার একটানা পড়ার অভ্যাস, চোখের বিশ্রাম না নিয়ে চিকিত্সকের কাছে গিয়ে পাওয়ার বদল তাকে ছদ্ম মায়োপিয়ার রোগীতে পরিণত করেছে।
এ ক্ষেত্রে যা করণীয়
ছেলেমেয়েদের কাছের কাজ (যথা পড়াশোনা, কম্পিউটার, গেম ইত্যাদি) একটানা বেশি সময় করতে দেওয়া যাবে না।
পড়াশোনার ফাঁকে চোখের প্রয়োজনীয় বিশ্রাম নিশ্চিত করতে হবে।
কম আলোতে পড়াশোনা করা থেকে বিরত রাখতে হবে।
চোখের চিকিত্সকের কাছে চোখ পরীক্ষার জন্য নেওয়ার আগে চোখের বিশ্রাম নিশ্চিত করতে হবে।
বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকেরও উচিত, রোগীকে সময় দিয়ে উপসর্গ শোনা ও চোখ পরীক্ষা করে ব্যবস্থাপত্র দেওয়া।
শেষ কথা
ছদ্ম মায়োপিয়া নিয়ে ভয় পাওয়ার মতো কিছু নেই। মনে রাখতে হবে, স্বল্প পাওয়ারজনিত সমস্যা, এমনকি স্বাভাবিক চোখেই সাধারণত ছদ্ম মায়োপিয়া হয়ে থাকে। পড়াশোনার চাপ কমার সঙ্গে ছদ্ম মায়োপিয়া এমনিতেই ভালো হয়ে যায়।
ডা. মো. শফিকুল ইসলাম
অলঙ্করণ: মাহফুজ রহমান অধ্যাপক, চক্ষু বিজ্ঞান বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
শাহবাগ, ঢাকা
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, এপ্রিল ২৮, ২০১০
Leave a Reply