এখনো ম্যালেরিয়া পৃথিবীজুড়ে একটি ঘাতকরোগ হিসেবে পরিচিত। প্রতিবছর প্রায় ১০ লাখ লোক এ রোগে প্রাণ হারায়। আর ৮৫ ভাগ মৃত ব্যক্তিই হলো পাঁচ বছরের নিচের শিশু। এ রোগ যদিও আফ্রিকা মহাদেশের প্রধান রোগ, তবু এখনো এশিয়া ও ল্যাতিন আমেরিকার বড় অংশজুড়ে রয়েছে ম্যালেরিয়া।
সেই প্রাচীনকাল থেকে মানবজাতির জন্য আতঙ্ক হয়ে ছিল আর এখনো এই গ্রহের ১০৯টি দেশের ৩৩০ কোটি মানুষ রয়েছে ম্যালেরিয়ার ঝুঁকিতে। অনুমান হলো প্রতিবছর ৩৫০ থেকে ৫০০ মিলিয়ন লোক পৃথিবীতে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়। আর গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশগুলোয় বেড়াতে আসা লোকদের মধ্যে ৩০ হাজার ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়।
ম্যালেরিয়ার পেছনে রয়েছে ‘প্লাজমোডিয়াম’ নামে এক পরজীবী; ম্যালেরিয়া আক্রান্ত লোকের রক্ত যখন শুষে নেয় স্ত্রী অ্যানোফিলিশ মশা, আর সেই মশা যখন অন্য লোককে কামড়ায়, তখন ওই পরজীবী স্থানান্তরিত হয় সুস্থ মানুষের দেহে, এভাবে ঘটে ম্যালেরিয়ার আক্রমণ। এই পরজীবী প্রথম পরিচিত হয়ে ওঠে বিজ্ঞানীদের কাছে ১৮৮০ সালে, যখন চালর্স লুই আলফোন লাভারেন প্রথম একে শনাক্ত করেন সেনাদের সংক্রমিত রক্তে। এই পরজীবীর রয়েছে চারটি প্রজাতি। প্রতিটির সংক্রমণে দেখা দেয় উপসর্গ, তবে সবচেয়ে মারাত্মক প্রজাতি হলো ‘প্লাজমোডিয়াম ফ্যালসিপেরাম’।
ম্যালেরিয়া নিরাময়যোগ্য রোগ অথচ এ রোগে লাখ লাখ লোক মারা যায়, রুগ্ণ হয় অসংখ্য মানুষ
ম্যালেরিয়া যেমন প্রতিরোধসাধ্য, তেমনি নিরাময়যোগ্য। আবার যথাযথ চিকিৎসা না হলে রোগের পরিণতি হয় মারাত্মক। আগেই বলেছি, প্রতিবছর এ রোগে পৃথিবীতে মারা যায় ১০ লাখ মানুষ, বেশির ভাগ হলো শিশু আর গর্ভবতী নারী। সাব সাহারান আফ্রিকায় লোকের মধ্যে রক্তশূন্যতা, শিশুর কম জন্ম ওজন, অকাল প্রসব, নবজাতকের মৃত্যু ও মাতৃমৃত্যুর বড় কারণ হলো ম্যালেরিয়া।
ম্যালেরিয়া জ্বরে যেমন কাবু হয় মানুষ, রুগ্ণ হয়ে ওঠে, কমে যায় উত্পাদনশীলতা, দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়ে ওঠে স্থবির, ১.৩ শতাংশ হানি হয় অর্থনীতিতে, এমন এক অনুমান রয়েছে। জনস্বাস্থ্য খাতে এ জন্য ব্যয় বাড়ে ৪০ শতাংশ, হাসপাতালে ভর্তি বাড়ে ৩০ শতাংশ, আউটডোরে রোগী বাড়ে ৫০ শতাংশ—এ অনুমান ম্যালেরিয়া অধ্যুষিত দেশগুলোতে। নিম্ন আয় ও মধ্য আয়ের দেশগুলোয় এ রোগের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি।
অথচ সাশ্রয়ী প্রতিরোধ ব্যবস্থা ও চিকিৎসা রয়েছে
যেসব অঞ্চলে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ বেশি, এদের কীটনাশকে সিক্ত মশারির নিচে রাতে নিদ্রা যেতে পরামর্শ দেওয়া হয়; ম্যালেরিয়া ছড়ায় যে মশা তা সাধারণত রাতে বেশি কামড়ায়।
সেসব অঞ্চলে ম্যালেরিয়ার স্থানিক প্রাদুর্ভাব, সেখানে কীটনাশক (মশার ওষুধ) স্প্রে করে ম্যালেরিয়ার বিস্তার বেশ রোধ করা সম্ভব।
এ রোগে বেশি আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা ছোট শিশু ও গর্ভবতী মহিলাদের। যেখানে ভয়ানক প্লাজমোডিয়াম ফ্যালসিপেরামের প্রাদুর্ভাব, সেসব অঞ্চলে গর্ভবতী মহিলাদের ম্যালেরিয়ার ওষুধ প্রতিরোধক হিসেবে দেওয়া বিবেচনা করা হয়।
রক্তের স্লাইড পরীক্ষা বা ‘র্যাপিড ডায়াগনস্টিক কিটের’ সাহায্যে চিহ্নিত হয় ম্যালেরিয়া পরজীবী ও নির্দিষ্ট প্রজাতির উপস্থিতি ও ঘনত্বের (পরিমাণগত বিচার) ওপর নির্ভর করে দেওয়া হয় চিকিৎসা। রোগীর স্বাস্থ্যের অবস্থা পর্যালোচনা করা হয়। ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব যেসব অঞ্চলে, সেখানে সাম্প্রতিক একটি বড় সমস্যা হলো বেশির ভাগ ম্যালেরিয়া পরজীবী ম্যালেরিয়ার সহজ ওষুধ ক্লোরোকুইনের প্রতি রেজিস্ট্যান্ট হয়ে উঠছে। নতুন সম্মিলিত চিকিৎসা আর্টিমিসিন বেস্ড কমবিনেশন থেরাপি (ACT) বেশ কার্যকর, তবে তা প্রচলিত ওষুধ থেকে ব্যয়বহুল। ভয়ানক ম্যালেরিয়ার বিরুদ্ধে প্রথম সারির চিকিৎসা হলো, এখনো আর্টিমিসিন বেস্ড কমবিনেশন থেরাপি বা ACT।
আর্টিমিসিন ওষুধ হিসেবে যে কার্যকর এবং মলদ্বার দিয়ে আর্টিমিসিন প্রয়োগ করে ভয়ানক ম্যালেরিয়া নিরাময়ের ক্ষেত্রে বিশ্বের যেসব গবেষক অবদান রেখেছেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক বিজ্ঞানী এম এ ফয়েজ, অধ্যাপক ইমরান বিন ইউনুস, অধ্যাপক রেদওয়ান ও Malaria Research Group-এর অন্যরা। বাংলাদেশে ম্যালেরিয়া হলো বড় রকমের জনস্বাস্থ্য সমস্যা। বিশেষ করে চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলে ভয়ানক ফ্যালসিপেরাম পরজীবীর প্রাদুর্ভাব রয়েছে। চট্টগ্রামের ম্যালেরিয়া রিসার্চ গ্রুপ এ ব্যাপারে ব্যাপক গবেষণা করেছে।
একটি পরিসংখ্যান রয়েছে, মোট জনগোষ্ঠীর ৩৩.৬ শতাংশ অর্থাত্ ৫১ মিলিয়নের মতো মানুষ রয়েছে ঝুঁকিতে এ দেশে আর এর মধ্যে ১০.৯ মিলিয়ন লোকের রয়েছে উঁচু থেকে মাঝারি ঝুঁকি এবং ৩৯.৭ শতাংশ মিলিয়নের রয়েছে নিম্ন ঝুঁকি। দেশের ৬৪টি জেলার ১৩টি থেকে বেশি ম্যালেরিয়া রোগী পাওয়া যায়। এ ১৩টি জেলার ২৪ মিলিয়ন লোকের ক্ষেত্রে ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি ক্রমে শোচনীয় হচ্ছে, বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড় ও বনাঞ্চলে, সীমান্তবর্তী এলাকায় রয়েছে ১১টি ম্যালেরিয়া-দুর্গত জেলা। সেসব অঞ্চলে ক্লোরোকুইন ও ফেনসিডার রেজিস্ট্যান্ট ম্যালেরিয়াও বেশ পাওয়া যাচ্ছে।
তবে অবস্থার উন্নতি হয়েছে, বিশ্বের নানা সংস্থা, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এদের সহযোগিতায় নজরদারি বেড়েছে, কীটনাশক সিক্ত মশারি বিতরণ ও এসিটির সাহায্যে চিকিৎসা দিয়ে ২০০৮ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী অবস্থা অনেক আয়ত্তের মধ্যে এসেছে। ম্যালেরিয়া শনাক্ত করার মতো ল্যাব প্রযুক্তি সুলভ হয়েছে, প্রশিক্ষিত জনবলও বেড়েছে। ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি এখন বেশ জোরদার।
২০০৮ সাল পর্যন্ত দৃঢ়ভাবে শনাক্ত রোগী, সম্ভাব্য ম্যালেরিয়া রোগী এবং এ কারণে মৃত্যুর সংখ্যা হলো যথাক্রমে ৮৪,৬৯০, ৮৩,৯৭২; ১৫৪। ফ্যালসিপেরাম ম্যালেরিয়া বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে ১৯৯৯ থেকে ২০০৫ সালে ৭৮.৫ শতাংশ এবং ২০০৮ সালে ৮৩ শতাংশ।
আর নজরদারি, তদারকি ও তথ্য সম্প্রচারের দুর্বলতার জন্য ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব বিষয়ে কম রিপোর্ট হয়েছে।
তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বিশ্বব্যাংক ও ব্র্যাকের সহযোগিতায় ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি গতিশীল হয়েছে।
রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা, কর্মসূচি বাস্তবায়নে দক্ষতা বৃদ্ধি, ১৩টি উপদ্রুত জেলায় মশারি ও ওষুধ বিতরণ জোরদার করা, নজরদারি বাড়ানো, স্বাস্থ্যকর্মী ও জনবল বাড়ানো এবং প্রশিক্ষণ দেওয়া, জনসচেতনতা—এসব ক্ষেত্রে উন্নতি হয়েছে।
সরকারও এ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির প্রতি বেশ মনোযোগ দিয়েছে।
কিছু কিছু ইস্যু ও চ্যালেঞ্জ রয়েছে: ডিডিটির ওপর নিষেধাজ্ঞা, বোনের ভেক্টর নিয়ন্ত্রণ, মশারিতে দেওয়ার জন্য ও স্প্রে করার জন্য ম্যালাথিওন, কোনো কোনো অঞ্চলে ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব; দুর্গম এলাকায়, প্রত্যন্ত অঞ্চলে চিকিৎসাসেবা পৌঁছানো; রোগ নির্ণয় আরও ব্যাপক অঞ্চলে করা, প্রশিক্ষিত জনবলের অভাব, দুর্বল তদারকি ও ব্যবস্থাপনা, প্রোগ্রাম ম্যানেজারের দ্রুত পরিবর্তন ও ফোকাল পয়েন্টে দুর্বল নজরদারি, সম্পদের অভাব।
এসব বাধাকে অতিক্রম করেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন হবে সবার সাহায্য ও সহযোগিতা। সরকারের সঙ্গে বৈশ্বিক সংস্থাসমূহ, বেসরকারি সংস্থা ও বিশেষজ্ঞরা মিলে কর্মসূচিকে সফল করে তুলবেন।
বিশেষ করে নিম্নআয়ের দেশগুলোয়, বিশ্বের প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী যেখানে রয়েছে ঝুঁকিতে, প্রতিবছর ৫০০ মিলিয়ন লোক হয়েছে সংক্রমিত, ১০ লাখ লোক মৃত্যুবরণ করছে। সাব সাহারান আফ্রিকা, এশিয়া, ল্যাতিন আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্যে প্রবল প্রাদুর্ভাব হচ্ছে, এ জন্যই একে নিয়ন্ত্রণ করা বড় জরুরি।
২০০৭ সালের মে মাসে বিশ্ব স্বাস্থ্য সম্মেলনের ৬০তম অধিবেশনে ঘোষিত হয়েছিল বিশ্ব ম্যালেরিয়া দিবস—সারা বিশ্ব যেন সাড়া দেয় বিশ্বের বড় সমস্যা ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণে।
অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরীর কলম থেকে
বিশ্ব ম্যালেরিয়া দিবস পরিচালক, ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস, বারডেম হাসপাতাল
সাম্মানিক অধ্যাপক, ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ, ঢাকা।
এপ্রিলে ২৫ আসে বিশ্ব ম্যালেরিয়া দিবস।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, এপ্রিল ২৮, ২০১০
Leave a Reply