ক্রায়ো শব্দের অর্থ বরফশীতল। প্রায় শত বছর আগে থেকেই ত্বকের বিভিন্ন ক্ষতের চিকিৎসায় এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা হচ্ছে। ত্বকের ক্ষেত্রে খুবই কার্যকর হওয়ায় বর্তমানেও ত্বকের বিভিন্ন অসুস্থতা যেমন—তিল, আঁচিল, এ্যাকনি, মেছতা, বিভিন্ন ধরনের টিউমার ও ক্যানসার চিকিৎসায় এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া পাইলস, মুখের ক্যানসার, প্রোস্টেট, যকৃত্ এবং কোনো কোনো হাড়ের ক্যানসার, রেটিনোব্লাসটোমা, জরায়ুর মুখের ক্যানসারসহ বিভিন্ন অঙ্গের চিকিৎসায়ও এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে।
ক্রায়োপ্রোব পৌঁছাতে পারে শরীরের এমন সব অঙ্গের চিকিৎসাই এই পদ্ধতিতে করা সম্ভব। তবে সাধারণত আঞ্চলিকভাবে সীমাবদ্ধ এবং এক সেন্টিমিটারের চাইতে বড় শক্ত টিউমারের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি বেশি কার্যকর হতে দেখা যায়। বয়স্ক অথবা যেসব রোগীর পক্ষে অপারেশন বা রেডিওথেরাপির ধকল সহ্য করা সম্ভব নয়, তাদের ক্ষেত্রে এবং কোনো কোনো অঙ্গের ক্যানসারের পূর্বাবস্থায় বিদ্যমান কোষকলা ধ্বংসের উদ্দেশ্যে (যেমন জরায়ুর মুখের ক্যানসার) এই থেরাপি প্রয়োগ করা হলেও বিস্তৃত ক্যানসারের চিকিৎসায় এই পদ্ধতি তেমন কার্যকর হয় না।
বরফশীতল তাপমাত্রার কোষকলা ধ্বংস করার ক্ষমতাকে ক্রায়োসার্জারি পদ্ধতিতে কাজে লাগানো হয়।
এ ক্ষেত্রে অত্যন্ত শীতল তাপমাত্রায় কোষকলার অভ্যন্তরে বলের আকৃতিবিশিষ্ট ছোট ছোট বরফের কৃস্টাল তৈরি হয়ে এগুলোকে ধ্বংস করে ফেলে। তবে অসুস্থ অঙ্গের কোষকলায় রক্ত সরবরাহকারী ধমনিগুলোকে হিমায়িত করে তুলতে পারলে চিকিৎসা অধিক কার্যকর হয়ে ওঠে।
সাধারণত, শীতলকারী হিসেবে তরল নাইট্রোজেন অথবা আরগন গ্যাস ব্যবহার করা হয়। শরীরের বাইরের দিকে অবস্থিত অঙ্গের ক্ষেত্রে অত্যন্ত শীতল এই পদার্থ আক্রান্ত স্থানের কোষকলার ওপরতলা জড়ানো শলাকা বা স্প্রে করার কোনো যন্ত্রের সাহায্যে সরাসরি প্রয়োগ করা হয়। এ ক্ষেত্রে কখনো কখনো একটি নলের মধ্যে কার্বন ডাই-অক্সাইডের অত্যন্ত ছোট ছোট বরফের টুকরো তৈরি করে অথবা এসিটোনের সঙ্গে মিশ্রিত অবস্থায় মণ্ডের মতো তৈরি করেও ব্যবহার করা হয়ে থাকে। প্রয়োগপদ্ধতি এবং ঠান্ডার মাত্রা ক্ষতের আয়তন, কোষকলার ধরন, গভীরতা ও অবস্থানের ওপর নির্ভর করে নির্ধারণ করা হয়। শরীরের অভ্যন্তরে টিউমারের ক্ষেত্রে আক্রান্ত স্থানের ওপর স্থাপিত ক্রায়োপ্রোব নামক ফাঁপা নলটির মধ্য দিয়ে শীতল পদার্থ সঞ্চারিত করে চতুষ্পার্শ্বস্থ্থ এক-দুই ইঞ্চি পরিমাণ জায়গায় অবস্থিত সুস্থ কোষকলাসহ টিউমারটি হিমায়িত করে তোলা হয়। কখনো কখনো টিউমারের বিভিন্ন অংশের জন্য একের অধিক প্রোব ব্যবহার করা হয়। এরপর প্রোবগুলো সরিয়ে নিয়ে হিমায়িত কোষগুলো গলে যেতে দেওয়া হয়। একইভাবে কয়েকবার এই পদ্ধতির পুনরাবৃত্তি ঘটানো হয়। কাঙ্ক্ষিত অবস্থায় পৌঁছে যাওয়ার পর এই কোষগুলোকে হয় স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় শরীরে শোষিত হয়ে যেতে দেওয়া হয় অথবা এগুলো শরীরের উপরিভাগে বের হয়ে এসে শক্ত আবরণবিশিষ্ট ফুসকুড়ির সৃষ্টি করে। এই পদ্ধতির একটি বিশেষ সুবিধা হলো এই যে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য এই প্রক্রিয়া বারবার প্রয়োগ করা যায়। বিনাইন ক্ষতের ক্ষেত্রে মাইনাস ২০ থেকে মাইনাস ৩০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা ফলপ্রসূ হয়ে থাকে। কিন্তু ক্যানসার কোষকলা ধ্বংসের জন্য সাধারণত মাইনাস ৪০ থেকে মাইনাস ৫০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা প্রয়োগ করা হয়।
অন্যান্য অঙ্গ বা কোষকলাকে অবাঞ্ছিত ঘনীভূত হওয়া থেকে মুক্ত রাখতে একটি থার্মোসেনসরের সাহায্যে নিকটবর্তী অঙ্গগুলোর তাপমাত্রার ওপর সতর্ক দৃষ্টি রাখা হয়। বর্তমানে প্রযুক্তিগত উন্নতির কারণে খুব সরু ক্রায়ো-সূঁচ (আলট্রা থিন) ব্যবহারের মাধ্যমে বরফ প্রয়োগের প্রক্রিয়া অত্যন্ত সুচারুরূপে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়ে ওঠায় জটিলতা দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা একেবারে কমিয়ে আনা সম্ভব হয়ে উঠেছে।
শরীরের অভ্যন্তরস্থ টিউমারের ক্ষেত্রে চিকিৎসা প্রদানের আগে ট্রান্সরেকটাল আলট্রাসাউন্ড অথবা ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স ইমেজিং পদ্ধতির সাহায্যে টিউমারের সঠিক অবস্থান ও আয়তন নির্ধারণ করে নেওয়া হয়। এ ধরনের ইমেজিং পদ্ধতির সাহায্যে ক্রায়োপ্রোবটির গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করে সুস্থ কোষকলাগুলোকে প্রভাবমুক্ত রাখা এবং চলমান প্রক্রিয়াটি পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করাও সম্ভব হয়। ক্রায়োসার্জারির জন্য আঞ্চলিক অথবা সাধারণ অবশ (জেনারেল অ্যানেসথেশিয়া) পদ্ধতির সাহায্য নেওয়া হয়। পূর্বপ্রস্তুতিমূলক ঝামেলা কম এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যেই চিকিৎসা সম্পন্ন করা যায়। খুব কম কাটাছেঁড়ার মাধ্যমে প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করা সম্ভব বিধায় সনাতন সার্জারির চাইতে ইনফেকশন হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কম এবং সেই সাথে কম ব্যয়বহুল। সাধারণভাবে খুব কম থেকে মধ্যম ধরনের ব্যথা অনুভূত হতে পারে, যা সাধারণ ব্যথার ওষুধ সেবনেই প্রশমিত হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ফুসকুড়ি সৃষ্টি হতে দেখা গেলেও অল্পতেই সেগুলো দূর হয়ে যায়। ত্বকের ক্ষেত্রে সাধারণত এক বৈঠকেই চিকিৎসা সম্পন্ন করা গেলেও কোনো কোনো ক্যানসারের বেলায় প্রায় দুই ঘণ্টা সময় লেগে যায় এবং চিকিৎসার পুনরাবৃত্তির প্রয়োজনীয়তাও দেখা দিতে পারে।
অধুনা বয়স্ক রোগীদের প্রোস্টেট ক্যানসারের চিকিৎসায় ক্রায়োসার্জারি খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। কারণ এ ক্ষেত্রে দুটি ভিন্নধারায় চিকিৎসা প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে। ক্ষুদ্রাকৃতির ক্যানসারের ক্ষেত্রে নার্ভ-স্পেয়ারিং পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে উত্তপ্ত করে তোলার ক্ষমতাসম্পন্ন একটি যন্ত্রের সাহায্যে রক্ত সরবরাহকারী স্নায়ুগুলো ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে অবস্থিত স্নায়ুগুলো উত্তপ্ত করে রেখে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব হয়। ফোকাল ক্রায়োসার্জারি নামক অপর পদ্ধতিতেও প্রোস্টেটের একপার্শ্বে বিদ্যমান ধীরগতিতে বৃদ্ধি পাওয়া ক্যানসারের চিকিৎসা প্রদান সম্ভব হচ্ছে। সমীক্ষায় দেখা গেছে, ক্রায়োসার্জারি পদ্ধতিতে চিকিৎসা গ্রহণের পর ৯৭ শতাংশ রোগী এক বছর পর্যন্ত এবং ৮২ শতাংশ রোগী পাঁচ বছর পর্যন্ত ক্যানসারমুক্ত থাকে।
জাকিয়া বেগম
চিকিৎসায় ক্রায়োসার্জারি প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা
বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, এপ্রিল ২১, ২০১০
Leave a Reply