আজ বিশ্ব স্বাস্থ্যদিবস। এ বছরের প্রতিপাদ্য‘নগরজীবনে স্বাস্থ্যসেবা’ (আরবানাইজেশন অ্যান্ড হেলথ)। বিশ্বের সবচেয়েজনবহুলনগর ঢাকা। আমাদের নগরজীবনে নিরাপদ পানি ও পরিকল্পিত পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থা অপ্রতুল। তাই পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব হয়অহরহ। বর্তমানে ডায়রিয়ার প্রকোপ একটি জনস্বাস্থ্যসমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। আজ বিশ্ব স্বাস্থ্যদিবসের প্রতিপাদ্য সামনে রেখেতাই শিশুর ডায়রিয়া নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন
দুই বছরের নিচের শিশুদের পাতলা পায়খানা মাঝেমধ্যেই হতে পারে। তবে বছরের এই সময়টায় ডায়রিয়ার প্রকোপ অনেক বেড়ে যায়। এর ৬০ শতাংশই ভাইরাসজনিত (রোটা ভাইরাস)। এই ডায়রিয়া সাধারণত তিন থেকে নয় দিন পর্যন্ত থাকতে পারে। এরপর ভালো হয়ে যায়, তেমন কোনো ওষুধেরও প্রয়োজন হয় না।
দিনে একবার বা দুবার শিশুদের পাতলা পায়খানা হলে, পায়খানা সবুজ রঙের হলে বা পায়খানার সঙ্গে মিউকাস গেলে মা-বাবা অনেক সময় ঘাবড়ে যান, চিকিৎসককে ফোন করেন বা সরাসরি তাঁর কাছে নিয়ে আসেন। জানতে চান কী ওষুধ দেবেন। আসলে ২৪ ঘণ্টায় তিনবার বা এর বেশি পাতলা বা পানির মতো পায়খানা হলেই ডায়রিয়া বলা হয়। পায়খানার সঙ্গে রক্ত গেলে বলা হয় আমাশয়।
এ ছাড়া কখনো কখনো পায়খানার সঙ্গে পিত গেলে পায়খানা গাঢ় সবুজ বর্ণের হতে পারে এবং পায়খানার সঙ্গে মিউকাসও যেতে পারে, এর জন্য চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। বেশির ভাগ সময় জীবাণু সংক্রমণের জন্য ডায়রিয়া হয়, কিন্তু কখনো কখনো কোনো খাবারের অ্যালার্জি হলেও ডায়রিয়া হতে পারে। আমাদের দেশে প্রতিবছর অনেক শিশু ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয় এবং পানিশূন্যতায় মারাও যায়। আমাদের শিশুদের অপুষ্টির প্রধান কারণও ডায়রিয়া।
ডায়রিয়া কেন হয়
ডায়রিয়া একটি খাদ্য ও পানিবাহিত রোগ। অর্থাৎ রোগজীবাণু খাদ্য ও পানির মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে।
সংক্রমণের কারণ অনেক
জন্মের পর প্রথম শিশুকে শুধু বুকের দুধ দিতে হয় এবং জন্মের পরপরই শালদুধ দিতে হয়। যদি না দেওয়া হয়, তাহলে শিশুর রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে যায় এবং সহজেই বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়।
শিশুকে বোতলের দুধ খাওয়ালে বোতলের মাধ্যমে জীবাণু শিশুর পেটে যেতে পারে। বোতল ঠিকমতো পরিষ্কার না করলে, মুখ খোলা রাখলে, দুধ বানিয়ে অনেকক্ষণ রেখে দিলে বা একবার খাবারের পর কিছু দুধ থেকে গেলে তার সঙ্গে নতুন করে দুধ মিলিয়ে খাওয়ালেও দুধের মাধ্যমে শিশু আক্রান্ত হতে পারে।
অনেক মা বুকের দুধ বোতলে ভরে খাওয়ান। এতে করে শিশু মায়ের দুধ টানতে চায় না। ফলে মায়ের দুধ কমে যায়। শিশু যখন বোতলে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, তখন তাকে কৌটার দুধ দেওয়া হয়। এর ফলেও শিশুর ডায়রিয়া হয়। আবার অনেক সময় মায়েরা রাতে ঘুমানোর আগে বোতলে দুধ ভরে রাখেন এবং ঘুমন্ত শিশুকে ওই দুধ খাওয়ান। কখনো বোতলের সেই দুধও নষ্ট হয়ে যায়, যা থেকে শিশুর ডায়রিয়া হতে পারে। এ ছাড়া ঘুমের মধ্যে শরীরের অনেক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কাজ করে না। খাদ্যনালিতে রক্ত সরবরাহ কমে যায়। ফলে খাদ্য হজমও হয় না।
খাবার বা পানি খোলা পাত্রে রাখলে বা ময়লা পাত্রে রাখলে।
পানি না ফুটিয়ে খেলে, বিশেষ করে শহরের সরবরাহের পানিতে অনেক সময় সহনীয় মাত্রার বেশি জীবাণু থাকে, সে জন্য খাওয়ার পানি কমপক্ষে ৩০ মিনিট ফুটিয়ে পান করা জরুরি। তবে টিউবওয়েলের পানি ফোটানোর প্রয়োজন নেই।
ফ্রিজে রাখা খাবার সামান্য গরম করে খাওয়ালে, বাসি খাবার বা বাইরের খাবার খেলে।
খাওয়ার আগে আপনার ও শিশুর হাত না ধোয়ালে, বিশেষ করে পায়খানা করার পর হাত না ধুয়ে শিশুকে খাওয়ালে।
শিশুর অপুষ্টি বা হাম হলে তার রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে যায়। ফলে সহজেই জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হয়, বিশেষ করে ডায়রিয়ায়। ডায়রিয়ায় সাধারণত দুই বছরের নিচের শিশুরাই বেশি আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে ছয় থেকে ১১ মাস বয়সী শিশুদের বাড়তি খাবার খাওয়ানো শুরু করা হয় বলে এ সময় শিশুদের মধ্যে ডায়রিয়ার প্রকোপ বেশি থাকে। ডায়রিয়ার সবচেয়ে বড় জটিলতা হলো, পানিশূন্যতা। পানিশূন্যতা হলে শিশু দুর্বল হয়ে পড়ে, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, প্রস্রাব বন্ধ হয়ে যায়। এমনকি শিশু অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারে। কোনো শিশুর ডায়রিয়া হলে সব সময় খেয়াল রাখতে হবে, শরীরে পানিশূন্যতা আছে কি না।
কীভাবে বোঝা যাবে শিশুর পানিশূন্যতা আছে
অস্থির ভাব, খিটখিটে মেজাজ বা নিস্তেজ হয়ে যাওয়া।
চোখ গর্তে ঢুকে যাওয়া।
তৃষ্ণার্ত ভাব বা একেবারেই খেতে না পারা।
শিশুর ত্বক ঢিলা হয়ে যাওয়া।
পানিশূন্যতার মাত্রাভেদে শিশুর চিকিৎসা নির্ধারণ করা হয়। যদি পানিশূন্যতার লক্ষণগুলো থাকে, তাহলে শিশুকে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে আর যদি না থাকে, তাহলেও আমাদের কিছু করণীয় আছে।
তরল খাবার দিন
পানিশূন্যতা রোধ করার জন্য খাওয়ার স্যালাইন ও অন্যান্য তরল খাবার বারবার দিন। যেমন—পানি, ভাতের মাড়, চিঁড়ার পানি, ডাবের পানি, টকদই, মাঠা, ফলের রস ও লবণ-গুড়ের শরবত। অনেকে মনে করেন, স্যালাইন খাওয়ালেই ডায়রিয়া বন্ধ হয়ে যাবে। আসলে তা সত্য নয়। শরীর থেকে যে পানি ও লবণ বের হয়ে যায়, তা পূরণ করে স্যালাইন ও অন্যান্য তরল খাবার। কতটুকু খাওয়ার স্যালাইন দিতে হবে, এর পরিমাণ নির্ভর করে শিশুর বয়সের ওপর।
শিশুর জন্য প্রতিবার স্যালাইনের পরিমাণ
দুই বছরের কম ১০-২০ চামচ
দুই থেকে ১০ বছর ২০-৪০ চামচ
১০ বছরের বেশি যতটুকু খেতে পারে
কীভাবে স্যালাইন খাওয়াবেন
এক প্যাকেট স্যালাইন আধা সের পানিতে গোলাবেন। অল্প অল্প করে গোলাবেন না, এতে করে লবণের মাত্রা কমবেশি হতে পারে এবং এর ফলে শিশুর মারাত্মক সমস্যা হতে পারে। প্রতিবার পায়খানার পর ওপরে উল্লিখিত পরিমাণ স্যালাইন দিন এবং তা ধীরে ধীরে দিতে হবে। যেমন, এক বা দুই মিনিট পর পর। একবারে বেশি দিলে শিশু বমি করতে পারে এবং পায়খানাও বেড়ে যেতে পারে। ধীরে ধীরে দেওয়ার পরও যদি বমি করে, তাহলে ১০ মিনিট অপেক্ষা করুন, পুনরায় আরও ধীরে ধীরে সমপরিমাণ স্যালাইন দিন।
অন্যান্য খাবারও দিতে হবে
শিশুর বয়স যদি ছয় মাসের কম হয়, তাহলে তাকে বারবার বুকের দুধ খেতে দিন; সঙ্গে খাওয়ার স্যালাইন অবশ্যই দেবেন। শিশুর বয়স ছয় মাসের বেশি হলে বুকের দুধের পাশাপাশি পরিবারের অন্যান্য খাবার দিতে ভুলবেন না। অনেক পরিবারের মুরব্বিরা মনে করেন, শিশুর ডায়রিয়া হলে শিশুকে মাছ,
মাংস, ডাল, ডিম, কলা, শাকসবজি খাওয়ানো যাবে না। শুধু চালের গুঁড়া, বার্লি বা জাউভাত খেতে দিয়ে থাকেন। সাধারণত পরিবারের অন্যান্য খাবার যদি না দেওয়া হয়, তাহলে ডায়রিয়া তাড়াতাড়ি ভালো হয় না এবং পরে শিশুর অপুষ্টি দেখা দিতে পারে। পরিবারে যেসব খাবার রান্না হবে, যেমন—খিচুড়ি, ডাল-ভাত, মাছ, মাংস, ডিম, পাকা কলা, তাজা ফলের রস—সবকিছুই শিশুকে দেওয়া যাবে। প্রথম দিকে মনে হতে পারে, খাবার হজম হচ্ছে না। তাই অনেক মা আর খাবার দিতে চান না। মায়েদের বলছি, খাবার দিতে থাকুন, আস্তে আস্তে খাবার হজম হবে এবং ডায়রিয়া ভালো হয়ে যাবে। অন্যান্য খাবারের সঙ্গে কাঁচকলা সেদ্ধ করে নরম ভাতের সঙ্গে চটকিয়ে দিন বা খিচুড়ির সঙ্গে কাঁচকলা দিন, ডায়রিয়া কমে যাবে। খাবার রান্না করায় তেল দিতে ভুলবেন না। প্রতিদিনের খাবার প্রতিদিন তৈরি করুন। সারা দিনে কমপক্ষে ছয়বার খাবার দিন (তিন-চার ঘণ্টা পর পর)। অল্প অল্প করে বারবার দিলে শিশুর পক্ষে তা হজম করা সহজ হবে।
১৫ দিনের জন্য জিংক সিরাপ বা ট্যাবলেট দিন।
খেয়াল করুন, শিশুর অবস্থান বেশি খারাপ হয়ে যাচ্ছে কি না। তাহলে শিশুকে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে যান।
কখন শিশুকে হাসপাতালে নিতে হবে
খুব বেশি পরিমাণ পানির মতো পাতলা পায়খানা হলে। বারবার বমি হলে, স্যালাইন খেয়ে রাখতে না পারলে। স্যালাইন বা অন্যান্য খাবার না খেতে পারলে। অতিরিক্ত তৃষ্ণাভাব থাকলে। জ্বর থাকলে। পায়খানার সঙ্গে রক্ত গেলে। ডায়রিয়ার মেয়াদ ১৪ দিনের বেশি হলে।
মনে রাখা জরুরি
ডায়রিয়া চিকিৎসায় সাধারণত ওষুধের তেমন প্রয়োজন হয় না।
জ্বর থাকলে প্যারাসিটামল দিন।
বমি থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ‘ডমপেরিডন’-জাতীয় ওষুধ দিন। অনেকে ডায়েরিয়া শুরু হলেই অ্যান্টিবায়োটিক বা মেট্রোনিডাজল-জাতীয় ওষুধ শিশুকে খাওয়াতে শুরু করেন বা চিকিৎসকের কাছে জানতে চান, কী ওষুধ দেবেন। আসলে পায়খানার সঙ্গে রক্ত গেলে বা কলেরা সন্দেহ হলেই শুধু অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োজন হয়। পায়খানা বন্ধ করার জন্য কোনো ওষুধ নেই। ডায়রিয়া আস্তে আস্তে ভালো হয়ে যায়। তাই ধৈর্য ধরুন। পানি কমপক্ষে আধা ঘণ্টা ফুটিয়ে নিন। ফোটানো পানি ঠান্ডা করে শিশুর হাত-মুখ ধোয়ান, গোসল করান, বাটি-চামচ ধুয়ে রাখুন, কলা, আপেল ও অন্যান্য ফল ধুয়ে নিন। শিশু যেহেতু বারবার আঙুল মুখে দেয়, সে জন্য তার হাত ফোটানো পানি দিয়ে মাঝেমধ্যে ধুয়ে দিন। তার ব্যবহারের খেলনা সম্ভব হলে ধুয়ে রাখুন। আপনার বা বাসার অন্যান্য সদস্যের কাপড় পরিষ্কার রাখুন। বাসি বা বাইরের খাবার বা দীর্ঘদিন ফ্রিজে রাখা খাবার শিশুকে কোনোভাবেই খেতে দেবেন না। জন্মের পরপরই শিশুকে শালদুধ দিন এবং ছয় মাস শুধু বুকের দুধ দিন।
শিশুকে নিয়মিত টিকা দিন।
ডায়রিয়া হলে কোনো খাবার বন্ধ করবেন না। খাবার ও পানি ঢেকে রাখুন। শিশুকে ফাস্টফুড খেতে দেবেন না। খাবারের আগে শিশুর হাত ধুয়ে দিন, আপনার হাতও ভালোভাবে ধুয়ে নিন। অনেক মা ঘরে চাল গুঁড়ো করে ভেজে রাখেন এবং এই চালের গুঁড়ো দুধ বা পানি দিয়ে জ্বাল দিয়ে শিশুকে খাওয়ান।
এমনকি তাঁরা চালের গুঁড়ো এক মাস পর্যন্ত রেখে দেন। ঘরে রাখা চালের গুঁড়ো জীবাণু সংক্রমণে সাহায্য করে, শিশু বারবার ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়। চালের গুঁড়ো খাওয়াবেন না।
টিনজাত খাবার খাওয়াবেন না।
ছয় মাস বয়স থেকে ঘরে রান্না করা পরিবারের সব খাবার খেতে দিন।
শিশুকে কখনোই বোতল দিয়ে দুধ খাওয়াবেন না।
তাহমীনা বেগম
অধ্যাপক, শিশু বিভাগ, বারডেম ও ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ, ঢাকা
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, এপ্রিল ০৭, ২০১০
Leave a Reply