সাইফুল আর শাহানার একমাত্র ছেলে দীপ্ত (কল্পিত নাম)। বয়স প্রায় তিন। মা -বাবা হঠাৎ খেয়াল করলেন, তাঁদের ছেলেটির নাম ধরে ডাকলে সাড়া দেয় না। এমনকি মা-বাবা বা অন্য কারও চোখে চোখ রেখে তাকায় না। সমবয়সীদের সঙ্গে মেশে না। কোলে চড়া বা আদর করাও পছন্দ করে না। দীপ্তর বয়সী অন্য শিশুরা যেসব শব্দ উচ্চারণ করতে পারে, দীপ্ত তাও পারে না। খেলনার প্রতি তার কোনো আগ্রহ নেই। হঠাৎ হঠাৎ সে খেপে ওঠে, রাগ করে—তবে সে রুটিন মেনে চলতে খুবই পছন্দ করে। প্রতি রাতে সে চায় একই নিয়মে, একই জামা পরে ঘুমাতে। প্রথম দিকে সাইফুল আর শাহানা বিষয়টিকে আমলে নিলেন না। কিন্তু একপর্যায়ে অফিসের একজন সহকর্মীর পরামর্শে শিশুটিকে নিয়ে গেলেন একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে। চিকিৎসক জানালেন, দীপ্ত এমন একজন শিশু, যার অটিজম আছে। পত্রপত্রিকা আর ইন্টারনেটের কল্যাণে সাইফুল আর শাহানা মোটামুটি জানেন অটিজম কী আর এর জন্য কোথায়, কীভাবে সাহায্য পেতে হবে।
কিন্তু সাইফুল আর শাহানার মতো অটিজমে আক্রান্ত সব শিশুর মা-বাবা বিষয়টি সম্পর্কে জানেন না। তাঁরা জানেন না যে শিশুর অটিজম আছে, তার জন্য দরকার বিশেষায়িত স্কুল। এসব শিশুর মা-বাবা বেশির ভাগই পর্যায়ক্রমে শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ এমনকি ঝাড়ফুঁকের আশ্রয়ও নিয়ে থাকেন শিশুর মঙ্গলের জন্য। তার ওপর অটিজম নিয়ে নানা বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণা তো রয়েছেই। কী করতে পারেন এমন একজন শিশুর অভিভাবক। কেবল চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া বা বিশেষায়িত স্কুলে ভর্তি করেই শেষ নয়, করার আছে অনেক কিছু—
কোনো বিভ্রান্তি নয়: ‘অটিজম নিয়ে কোনো বিভ্রান্তিতে থাকা উচিত নয়। যদি কেউ মনে করে থাকেন যে কোনো শিশুর মধ্যে অটিজমের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, তবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে দেখতে হবে যে সত্যিই তার অটিজম আছে কি না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ইন্টারন্যাশনাল ক্লাসিফিকেশন অব ডিজিজ, যা চিকিৎসাবিজ্ঞানের সব রোগের পূর্ণাঙ্গ তালিকাগ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত, সেখানে সুস্পষ্টভাবে শিশুর অটিজমকে একটি রোগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর কোড নম্বর ‘এফ ৮৪.০’। তাই ‘অটিজম কোনো রোগ নয়’ বা ‘অটিজম আছে এমন শিশুর জন্য কিছুই করার নেই’—এমন কোনো প্রচারণায় বিভ্রান্ত হওয়া চলবে না।
দায়িত্বটা দিতে হবে চিকিৎসককে: কোনো বই পড়ে, পত্রিকার স্বাস্থ্য পাতা পড়ে নিজে নিজে কোনো শিশুর অটিজম নির্ণয় করা যাবে না। কোনো শিশুর মধ্যে অটিজম আছে কি না, সেটা নির্ণয়ের দায়িত্ব দিতে হবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে।
মেনে নিতে হবে: যদি সত্যিই দেখা যায় শিশুটির মধ্যে অটিজম আছে, তবে অযথা ভেঙে না পড়ে তার রোগটিকে মেনে নিতে হবে এবং উপযুক্ত পরিচর্যার জন্য সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়ার কথা ভাবতে হবে।
বিজ্ঞানভিত্তিক সিদ্ধান্ত: অটিজম নিয়ে শিক্ষিত-অশিক্ষিত অনেকের মধ্যে নানা অবৈজ্ঞানিক ও অপবৈজ্ঞানিক ধারণা রয়েছে। কোনো মিথ্যা ধারণা দ্বারা পরিচালিত হওয়া চলবে না। মনে রাখতে হবে, কেবল বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতেই এ ধরনের শিশুর পরিচর্যায় সুফল পাওয়া সম্ভব।
পরিবারের সব সদস্যকে সাধারণ সিদ্ধান্তে আসতে হবে: দেখা যায়, অটিজম রয়েছে এমন শিশুর মা চান শিশুটিকে বিশেষায়িত স্কুলে দিতে। কিন্তু বাবা মানতেই নারাজ যে তাঁর সন্তানের কোনো সমস্যা আছে। আবার মা-বাবা হয়তো শিশুর সমস্যা মেনে নিয়ে উপযুক্ত সহায়তা নিতে রাজি হলেন, কিন্তু বেঁকে বসলেন শিশুটির দাদা বা সংসারের মুরব্বি কেউ। তিনি মিথ্যে লোকলজ্জার ভয়ে শিশুটিকে কোনো চিকিৎসকের কাছে বা বিশেষায়িত স্কুলে দিতে রাজি হলেন না। তাই শিশুটির মঙ্গলের জন্য পরিবারের প্রায় সব সদস্যকে একটি ইতিবাচক সাধারণ সিদ্ধান্তে আসতে হবে।
নিজেদের দায়ী করা যাবে না: অটিজমের কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। কেন শিশুটির এ সমস্যা হলো, তা নিয়ে নিজেদের বা একে অপরকে দায়ী করা যাবে না।
চিকিৎসকদের দোষারোপ করা চলবে না: অটিজম যে ধরনের সমস্যা, সে ধরনের সমস্যা সমাধানের কোনো রাতারাতি চিকিৎসাপদ্ধতি নেই, রয়েছে দীর্ঘমেয়াদি পরিচর্যার পরিকল্পনা। এই দীর্ঘমেয়াদি পরিচর্যার মাধ্যমে এ সমস্যায় আক্রান্ত শিশু ফিরে আসতে পারে সমাজের মূল স্রোতে। তাই অযথা ধৈর্যহারা হওয়া ঠিক নয়, চিকিৎসকের পর চিকিৎসক পরিবর্তন করলেও কোনো সুফল বয়ে আনবে না। সমস্যাটির স্বরূপ বোঝার চেষ্টা করতে হবে। চিকিৎসকদের অযথা দোষারোপ করা উচিত নয়। এতে আক্রান্ত শিশুর মা-বাবার মধ্যেও তৈরি হতে পারে হতাশা।
শেখাতে হবে সামাজিকতা: পরিবার থেকেই সামাজিকতা শেখাতে হবে সব শিশুকে। আর অটিজম আছে এমন শিশুর ক্ষেত্রে তো বটেই। বড়দের সম্মান করা, হাসির প্রত্যুত্তরে হাসা, সামাজিক ও ধর্মীয় রীতিনীতি ফেলতে হবে শিশুকে।
সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ: বিভিন্ন দাওয়াত, সামাজিক অনুষ্ঠান, বড় আয়োজনে শিশুটিকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে হবে। লোকলজ্জার ভয়ে এসব অনুষ্ঠানে শিশুটিকে ঘরে বন্দী করে রেখে গেলে চলবে না।
খেলতে হবে শিশুর সঙ্গে: মা-বাবাকে সময় করে শিশুটির সঙ্গে প্রতিদিন কিছুটা সময় খেলতে হবে। কাটাতে হবে খানিকটা মানসম্পন্ন সময়।
খেলতে দিতে হবে: অটিজম রয়েছে এমন শিশুকে সমবয়সী শিশুদের সঙ্গে খেলার সুযোগ করে দিতে হবে। একা একা খেলা যায় এমন খেলা যেমন কম্পিউটার গেম, মনোপলি ইত্যাদির প্রতি নিরুৎসাহিত করে অনেকে মিলে খেলতে পারে এমন খেলা যেমন—বল খেলা, ছোঁয়াছুঁয়ি, গঠনমূলক কিছু খেলা ইত্যাদি খেলতে উৎসাহিত করতে হবে।
শেখাতে হবে ভাষা: অটিজম আছে এমন শিশুর অন্যতম প্রধান সমস্যা তার ভাষা শিখতে না পারা। ভাষা শেখানোর জন্য তাকে একটা করে জিনিস নিয়ে সেগুলোর নাম স্পষ্ট করে শেখাতে হবে বার বার। ছোট ছোট শব্দ আগে শেখাতে হবে। তার সঙ্গে বেশি করে কথা বলতে হবে।
ননভার্বাল কমিউনিকেশন বোঝাতে হবে: কেবল মৌখিক ভাষা নয়। ইশারা-ইঙ্গিতের তাৎপর্য ও এর ব্যাখ্যা বোঝানোর জন্য প্রতীকের সাহায্যে শিশুকে ‘ননভার্বাল কমিউনিকেশন’ কীভাবে করা যায় তা বোঝাতে হবে। মনের ভাব প্রকাশের নানাবিধ ধরন শিশুর সঙ্গে প্রয়োগ করতে হবে।
শব্দভান্ডার ব্যবহার করতে হবে: শিশুর শব্দভান্ডার যাই হোক না কেন, সেগুলোর সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। যেসব শব্দ সে ভালো পারে, সেগুলো দিয়ে পূর্ণাঙ্গ বাক্য তৈরি করা শেখাতে হবে, পাশাপাশি নতুন শব্দ শেখানোর জন্য ছবি, প্রতীক ইত্যাদি ব্যবহার করতে হবে।
ব্যক্তিগত কাজ শেখানো: শিশুর নিজের ব্যক্তিগত কাজ যেমন—দাঁত ব্রাশ করা, জামাকাপড় পরা, নিজের যত্ন নিজে নেওয়া—এগুলো আস্তে আস্তে অভ্যাস করাতে হবে। অতিমাত্রায় স্নেহের বশবর্তী হয়ে শিশুটিকে পরনির্ভরশীল করে গড়ে তোলা যাবে না।
শখকে প্রাধান্য দেওয়া: শিশুকে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে। গান গাইতে চাইলে সেটা শেখানো, ছবি আঁকতে চাইলে উৎসাহ দেওয়া প্রয়োজন।
প্রশিক্ষণ নিতে হবে মা-বাবাকেও: যে শিশুর অটিজম রয়েছে, তার সঠিক পরিচর্যা এবং তার সর্বাঙ্গীণ কল্যাণের জন্য মা-বাবা এবং প্রয়োজনে পরিবারের অন্য সদস্যদেরও প্রশিক্ষণ নেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে।
গ্রুপ তৈরি ও গ্রুপে প্রশিক্ষণ: বিশেষায়িত স্কুলের পাশাপাশি যেসব শিশুর অটিজম আছে, তাদের অভিভাবকেরা নিজেরাও গঠন করতে পারেন ‘সেলফ হেলপ গ্রুপ’। এতে করে নিজেদের সাধারণ সমস্যাগুলো শেয়ার করার পাশাপাশি সমাধানের পথও খুঁজে পেতে পারেন।
কাঙ্ক্ষিত আচরণের জন্য পুরস্কার: শিশু যদি কাঙ্ক্ষিত আচরণ করে, তবে এর জন্য তাকে ছোটখাটো পুরস্কার দিতে হবে। দিতে হবে উৎসাহ।
আর অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণের জন্য তিরস্কার করা চলবে না। অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণের জন্য পুরস্কার প্রত্যাহার করা এবং সেসব আচরণের দিকে মনোযোগ না দেওয়াই উচিত।
দিনলিপি সংরক্ষণ: একটি ডায়েরিতে শিশুর আচরণ ও অভ্যাসের তালিকাগুলো নিয়মিত সংরক্ষণ করতে হবে। এতে করে বোঝা যাবে তার আচরণের পরিবর্তন কতটুকু হচ্ছে এবং কী হারে হচ্ছে। এটা দেখে পরবর্তী চিকিৎসা ও আনুষঙ্গিক বিষয় সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে।
অটিজম রয়েছে এমন শিশুর জন্য প্রয়োজন সর্বস্তরের সচেতনতা আর অটিজম নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন।
আর এই সচেতনতা ও পরিবর্তনের প্রথম ধাপটি শুরু করতে হবে পরিবার থেকেই। অটিজমের চিকিৎসায় পরিবারের, বিশেষত মা-বাবার ভূমিকা সবেচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাই শিশুর অটিজমকে গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে, সেই সঙ্গে নিতে হবে মানসিক প্রস্তুতি। অভিভাবকদের ইতিবাচক ও গঠনমূলক আচরণই পারে অটিজম আছে এমন শিশুর বিকাশের পথকে অনেকখানি স্বাভাবিক ও সাবলীল করতে।
অটিজমের সাধারণ লক্ষণ: অটিজম রয়েছে এমন শিশুর চিকিৎসার প্রথম ধাপ হচ্ছে দ্রুত তার অটিজম শনাক্তকরণ। এ জন্য তিন বছর বয়সের শিশুর মধ্যে যে লক্ষণগুলো দেখলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন তা হচ্ছে:
শিশুর ভাষা শিখতে সমস্যা, যেমন—এক বছর বয়সের মধ্যে মুখে কোনো আওয়াজ করতে না পারা বা দুই বছর বয়সের মধ্যে এক-দুই শব্দ দিয়ে মনের ভাব প্রকাশ করতে না পারা।
শিশু যদি চোখে চোখ না রাখে
নাম ধরে ডাকলে যদি সাড়া না দেয়
অমিশুকে হয় এবং আদর করা পছন্দ করে না
হঠাৎ করে খেপে ওঠে
সামাজিক সম্পর্ক তৈরি ব্যাহত হচ্ছে
কোনো ধরনের আনন্দদায়ক বস্তু বা বিষয় সে অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে নেয় না
যদি একই শব্দ বা বাক্য বার বার উচ্চারণ করে বা তাকে বলা কোনো কথার পুনরাবৃত্তি করে
একই আচরণ বার বার করতে থাকে
আওয়াজ পছন্দ করে না
খুব বেশি রুটিন মেনে চলতে পছন্দ করে, আশপাশের কোনো পরিবর্তন সহ্য করতে পারে না
এসব লক্ষণ সাধারণত তিন বছর বয়সের মধ্যে দেখা যায়। তবে ক্ষেত্রবিশেষে আরেকটু পরেও দেখা দিতে পারে।
বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে যে ওপরের কোনো লক্ষণ অল্প সময়ের জন্য কোনো শিশুর মধ্যে থাকলেই ধরে নেওয়া যাবে না যে তার অটিজম আছে। অটিজম নির্ণয় করার জন্য অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
আহমেদ হেলাল
অটিজমের বিরুদ্ধে লড়াই করে আদিল এখন জয়ী মনোরোগবিদ্যা বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ৩১, ২০১০
Leave a Reply