শতাব্দীর রোগ এইডস অ্যাকোয়ার্ড ইমিউন ডেফিসিয়েন্সি সিনড্রোম।
এর মূলে রয়েছে এইচআইভি। হিউম্যান ইমিউন ডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস।
যে বিজ্ঞানীরা এই ভাইরাস আবিষ্কার করেছিলেন তাঁরা পেলেন মেডিসিনে নোবেল, তবে অংশীদার হলেন আরও একজন বিজ্ঞানী, যিনি হিউম্যান পেপিলোমা ভাইরাসকে (এইচপিভি) জরায়ুগ্রীবার ক্যানসারের সম্পর্ক আবিষ্কার করেন।
ফরাসি বিজ্ঞানী দাল ফ্রাঁকোয়েজ বেরে সাইনোসি ও লাক মনতেনিয়ারকে এইডস রোগের ভাইরাস আবিষ্করে দুনিয়াকাঁপানো কর্মের জন্য স্বীকৃতি দেওয়া হলো।
জার্মানির বিজ্ঞানী হেরাল্ড জুর হাওসেন এইচপিভির সঙ্গে জরায়ুগ্রীবার ক্যানসারের সম্পর্ক আবিষ্কার করে পেলেন নোবেল পুরস্কার সাইনোসি ও মনতেনিয়ারের সঙ্গে।
১৯৮১ সাল থেকে এ পর্যন্ত এইচআইভি বা এইডসে মারা গেছে দুই কোটি ৫০ লাখ মানুষ।
এইচআইভি আবিষ্কার সম্বন্ধে নোবেল পুরস্কার কমিটির মন্তব্য, ‘এর আগে কখনো একটি নতুন রোগের উৎস চিহ্নিত করা, চিকিৎসা বের করা এবং এই রোগকেও আবিষ্কার করা এত দ্রুত ঘটেনি বিজ্ঞান ও চিকিৎসাবিদ্যায়।’
বিশ্বজুড়ে এইচআইভি নিয়ে বেঁচে আছেন তিন কোটি ৩০ লাখ মানুষ। ১৯৮১ সালে প্রথম একটি নতুন ইমিউন ডেফিসিয়েন্সি সিনড্রোমের খবর পাওয়ার পর ফ্রান্সের পাস্তুর ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক বেরে সাইনোসি ও ওয়ার্ল্ড ফাউন্ডেশন ফর এইডস রিসার্চ অ্যান্ড প্রিভেনশনের ডিরেক্টর মনতেনিয়ার প্রথম আবিষ্কার করলেন এই রোগের মূলে রয়েছে এইচআইভি।
নোবেল কমিটির উদ্ধৃত বাক্যে আরও যা ছিল—‘বিশ্বজুড়ে যে ভাইরাসটি একটি বিশাল জনস্বাস্থ্য হুমকি হয়ে রয়েছে এর অন্তর্গত রহস্য, বায়োলজি উপলব্ধি করতে এ আবিষ্কারটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল।’
বড় রকমের অগ্রগতি
এঁদের কাজকর্ম ও গবেষণা থেকে সংক্রমিত রোগী নির্ণয়ের পদ্ধতি, রক্ত ও উপজাতদ্রব্য স্ক্রিন করার পদ্ধতি বের হলো, আর এতে বিশ্বমারির বিস্তাররোধ হ্রাস পাওয়ার সুযোগ হলো।
এ থেকে এল নতুন চিকিৎসাপদ্ধতিও।
ইমপিরিয়াল কলেজ লন্ডনের চিকিৎসক আদ্রিয়ানো বাসো বলেন, ‘হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসের (এইচপিভি) বিরুদ্ধে টিকা আবিষ্কার এখন দিবালোকের মতো সত্য। এই ভাইরাসের মূল আবিষ্কারের জন্য ধন্যবাদ হেরল্ড জুর হাওসেনকে। এখনো এইচআইভির কোনো নিরাময় নেই। তবুও এখন আর রোগটি অনেকের জন্যই সাক্ষাত্ মৃত্যুদূত হয়ে নেই। সাম্প্রতিককালে গবেষণা ও ওষুধ আবিষ্কারের ক্ষেত্রে বড় রকমের অগ্রগতির জন্যও ধন্যবাদ।
চিকিৎসা দিলে এইচআইভি সংক্রমিত রোগী বেঁচে থাকেন বেশ কয়েক বছর। তবে এইচআইভির ওষুধ পৃথিবীর দরিদ্র অনেক দেশে এত ব্যাপকভাবে পাওয়া যায় না এবং তা সুলভও নয়। আর্থিক সংগতির মধ্যেও নেই। সফল রেট্রোভাইরাসরোধী চিকিৎসার ফলে এইচআইভি সংক্রমিত লোকের গড় প্রত্যাশিত আয়ু বাড়ার সুযোগ ঘটেছে। অনেক অনেক বেশি, প্রায় অসংক্রমিত লোকের আয়ুর কাছাকাছি। এইচআইভি চ্যারিটি টেরেন্স হিগিনজ ট্রাস্টের নিক প্যাট্রিজ বলেন, ‘ফ্যাঙ্কোয়ে ব্যারে সাইনোসে এবং লাক মনতেনিয়ার মেডিসিনে নোবেল পুরস্কারের অত্যন্ত উপযুক্ত বিজয়ী। তাঁদের গবেষণা বিশাল তাৎপর্যপূর্ণ, এতে এইচআইভি সম্বন্ধে উপলব্ধি ও চিকিৎসার পথে এল বড় রকমের অগ্রগতি।’
মনতেনিয়ার ও আমেরিকান বিজ্ঞানী রবার্ট গ্যালো, দুজনই এইচআইভি-এইডস ঘটার এই আবিষ্কারের জন্য যুক্তভাবে কৃতিত্বের দাবিদার, যদি এ নিয়ে ফ্রান্স ও আমেরিকার মধ্যে অনেক বছর চলেছে আবিষ্কারের দাবি, এ থেকে আইনি ও কূটনৈতিক দ্বন্দ্ব পর্যন্ত গড়িয়েছে।
নোবেলজুরির এ উদ্ধৃতিতে রবার্ট গ্যালো সম্বন্ধে কোনো উচ্চবাচ্য নেই। অধ্যাপক বোরে সাইনোসি বলেন, ‘পুরস্কারটি হলো বিশাল সম্মান, প্রত্যাশার বাইরে।’
আবিষ্কার হলো টিকা
ডুসেলডর্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জুর হাওসেনেক নোবেল কমিটি প্রশংসা করেছেন এ জন্য যে তিনি ‘প্রচলিত মতবাদের বিরুদ্ধে’ গিয়ে আবিষ্কার করলেন এইচপিভি সংক্রমণ ঘটায় জরায়ুগ্রীবার ক্যানসার।
জরায়ুগ্রীবার ক্যানসার রয়েছে এমন সব নারীর ৯৯ দশমিক ৭ শতাংশের মধ্যে চিহ্নিত করা যায়, এইচপিভি এবং এই ভাইরাসের অটল সংক্রমণ বিশ্বজুড়ে সব ক্যানসারের পাঁচ শতাংশের জন্য দায়ী বলে অনুমান।
অধ্যাপক জুর হাওসেনের গবেষণার ফলে এইচপিভির বিরুদ্ধে টিকা আবিষ্কারে অন্যদের সাহায্য হলো, যা বিশ্বের অনেক দেশে টিনএজ মেয়েদের মধ্যে জরায়ুগ্রীবা ক্যানসার প্রতিরোধের জন্য দেওয়া হয়।
ইমপিরিয়াল কলেজ ও ওয়েলকাম ট্রাস্টের রিসার্চ ফেলো আদ্রিয়ানো বোয়াসো বলেন, ‘একটি সংক্রামক রোগের পেছনে যে জীবাণু, এর আবিষ্কার হলো এর বিরুদ্ধে টিকা আবিষ্কারের পথে একক সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।’
‘এইচপিভির বিরুদ্ধে টিকাপ্রাপ্তির জন্য এই ভাইরাসের মূল আবিষ্কারক হেরাল্ড জুর হাওসেন সত্যি ধন্যবাদের পাত্র।’
এইচআইভির বিরুদ্ধে টিকা আবিষ্কারের জন্য গবেষণা কিছুটা ব্যাহত হলেও, কোনো ক্ষেত্রে ব্যর্থ হলেও ফ্রাংকোসে বেবে সাইনোসি ও লাকমনতেনিয়ার কর্তৃক এইচআইভি আবিষ্কার নিঃসন্দেহে এমন একটি স্তম্ভ হয়ে দাঁড়াল যার ওপর একটি কার্যকর টিকা নির্মাণ হবে ভবিষ্যতে। ৭২ বছর বয়স্ক অধ্যাপক জুর হাওসেন পেলেন পুরস্কারের অর্ধেক অর্থ, বাকি অর্ধেক পেলেন ৬১ বছর বয়স্ক অধ্যাপক বেরে সাইনোসি ও ৭৬ বছর বয়স্ক মনতেনিয়ার।
অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরীর কলম থেকে
পরিচালক, ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস, বারডেম হাসপাতাল
সাম্মানিক অধ্যাপক, ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ, ঢাকা।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ২৪, ২০১০
Leave a Reply