চিকিৎসক ও নার্সের জীবনে একটি অভিজ্ঞতা হয়। তাঁদের সামনে অনেক সময় মানুষের মৃত্যু ঘটে যায়। অনিচ্ছা সত্ত্বেও এ করুণ পরিণতি দেখতে হয়। অনিবার্য হলেও করুণ। এমন হয় যে মৃত্যুর সঙ্গে দীর্ঘ লড়াই চলে—আধুনিক চিকিৎসায় যা সম্ভব, করা হয়, তবু অনেকের জীবন বাঁচানো সম্ভব হয় না।
দেহের কোনো কোনো অঙ্গ, ফুসফুস, নয়তো হৃৎপিণ্ড অথবা যকৃৎ এত দুর্বল হয়ে যায় যে এগুলো কাজ করতে পারে না। তবে এ ধরনের মৃত্যু এত আচমকা হয়তো আসে না, পরিবার-পরিজনের উপস্থিতিতে, তাঁরা জানে কী ঘটতে যাচ্ছে। সব মৃত্যুর মতো, এ মৃত্যুও কঠিন, তবে বেশ নিয়ন্ত্রণে ঘটে, অতটা বিস্ময়ের ব্যাপার হয় না, ভবিতব্য কিছুটা বোঝা যায়।
আবার অন্য রকমের মৃত্যুও আছে, দ্রুত, অতটা সচরাচর নয়, প্রাণ শরীরকে ছেড়ে যায় মুহূর্তের মধ্যে। হাসপাতালে একে বলে ‘Condition A’ A মানে Arrest. যেমন কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট। এ ক্ষেত্রে রোগীর হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায় এবং একে আবার শুরু করার প্রচেষ্টা নিতে হয়।
ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট বা আইসিইউতে এ ধরনের অভিজ্ঞতা হয় নার্স ও ডাক্তারদের। হাসপাতালে কর্মরত একজন নার্স যে ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হন, তাই বলি। নামধাম সব কাল্পনিক, বাকি ঘটনা সত্য।
সেই নার্সটি নতুন যোগদান করেছেন হাসপাতালে, তাঁকেই প্রথমই মুখোমুখি হতে হয়েছিল Condition A রোগীর।
বয়স্ক মহিলা, ফুসফুসের ক্যানসার। তেমন সমস্যা ছিল না প্রথমে কম কম জ্বর—কয়েক দিন ধরে হচ্ছিল। হঠাৎ করে কাশির সঙ্গে রক্ত পড়ল, তাই তিনি ভর্তি হয়েছিলেন। একে মোকাবিলা করা হয়েছিল, সেই বিকেলে ছেড়ে দেওয়া হবে, এমনও স্থির করা ছিল। সকালে রোগীর রুটিন পরীক্ষা শেষে বেশ আশ্বস্ত, স্টুডেন্ট নার্সের হাতে তাঁকে দিয়ে আরও গুরুতর রোগীর প্রতি নজর দিলেন তিনি। ভাবলেন, আজ দিনটা নিরুপদ্রব যাবে। আধা ঘণ্টা পর ফোন এল, ‘শর্মিলা, ১০২২ নম্বরে তোমাকে চাই।’ সেই রোগী ১০২২ নম্বরে। হাতের কাজ থেমে গেল শর্মিলার। তিনি ঘরে গেলেন। সহকর্মী রেজিনা রোগীর কাছে ছিলেন, বেরিয়ে যেতে যেতে বললেন, ‘রোগী রক্তবমি করছেন।’ রেজিনা নার্সিং স্টেশনের দিকে যাচ্ছেন ডিউটি চিকিৎসককে ডাকতে। শর্মিলা বললেন, ‘রোগীর কক্ষে ঢুকে দেখলাম তাঁর নাক, মুখ দিয়ে রক্ত পড়ছে অবিরাম।’
হাতে গ্লাভস পরা ছিল, মুখে মাস্ক পরে নিলেন শর্মিলা, কাছে এসে তাঁর কাঁধে হাত রাখলেন। ‘ব্যথা করছে খুব?’ মনে হলো, তাঁর অন্ত্রনালি থেকে রক্ত ঝরল কি না। রোগী মৃদু স্বরে বললেন, ‘না।’
রোগীর চোখে কী ছিল? আতঙ্ক? ভয়? হতাশা? তার নিজের রক্ত গলায় ঘড় ঘড় করছে, একে বের করার জন্য সাকশন পাম্প লাগানো প্রয়োজন…
রোগী উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করলেন, রক্তবমি করে পাশের পাত্রে ফেলার জন্য, কিন্তু…
শর্মিলা বললেন, ‘না, উঠে দাঁড়াবেন না।’
তিনি আবার বসে পড়লেন, কাঁপতে লাগলেন তিনি। এরপর পেছন দিকে বিছানায় ধপাস করে পড়ে গেলেন। ‘ডাকুন আইসিইউ টিমকে’ শর্মিলা উচ্চস্বরে বললেন।
রোগীর নাড়ি দেখলেন শর্মিলা। নেই। সিপিআর শুরু করলেন তিনি। Condition A। সেই ফ্লোরে অন্য নার্স, নিয়ে এলেন বোর্ড। নরম বিছানায় সিপিআর ঠিক হয় না।
কঠিন বোর্ডে ঠিকমতো হয়। শর্মিলা ও ডিউটি চিকিৎসক মিলে তাকে ওঠালেন হার্ডবোর্ডে। বেশ ভারী শরীর। সিপিআর চলতে লাগল। ইতিমধ্যে কনডিশন টিম পৌঁছে গেল। খুবই দ্রুত এল তারা। ইনটেনসিভ কেয়ারে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, আইসিইউ নার্স, রেসপিরেটরি থেরাপিস্ট, পালমোনলজিস্ট, অ্যানেসথেশিয়ার চিকিৎসক—বড় একটি টিম পৌঁছে গেল রোগীর কাছে। রেসপিরেটরি থেরাপিস্ট সিপিআরে হাত দিলেন, শর্মিলা ছেড়ে দিলেন। সহকর্মী আইসিইউ নার্স নবনী তাঁর আইভি পাম্পে লাগালেন বাড়তি চ্যানেল, কী ঘটছে তা রেকর্ড করা হচ্ছিল। প্রায়ই বলছিল, ‘পেশেন্ট আবার অ্যাসিসটোলে…’ হৃদস্পন্দন নেই…।
আইসিইউ টিম রোগীর ওপর চেষ্টা চালাল প্রায় আধা ঘণ্টা। গলা দিয়ে একটি নল ঢোকানোর চেষ্টা। যদি কিছু দেওয়া যায় অক্সিজেন। কিন্তু এত রক্ত, কিছু দেখা গেল না। শেষ পর্যন্ত শ্বাসযন্ত্রে ছিদ্র করে দেওয়া, তবু এত রক্তে পরিপূর্ণ…।
তরল দেওয়া হলো, শিরাপথে ওষুধও দেওয়া হলো, হৃৎপিণ্ড পুনরায় শুরু করার চেষ্টা। হূদছন্দে অনিয়ম হলে একেও নিয়মিত করার জন্য ওষুধও প্রয়োগ করা হলো। ‘সঠিক কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট’ হলে সমস্যা হলো ওষুধে তেমন কাজ হয় না। কারণ হৃৎপিণ্ড ছন্দে ছন্দে স্পন্দিত হয় না বলে উদ্দীপিত হওয়ার ক্ষমতা থাকে না। ওষুধের ভান্ডার যা ছিল ওয়ার্ডে, তাও উজাড় হলো, কাজ হলো না। জরুরি চিকিৎসায় যা যা করার তা হলো। অ্যাসিসটোলকে ফ্ল্যাট লাইনিং বলে জানি আমরা। একেবারে সরলরেখা। স্পন্দনহীন। তবে সে রোগীর ঠিক যে স্বাভাবিক হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন হঠাৎ করে সরলরেখা হয়েছিল, তাও নয়। শর্মিলার ভাষ্য, তাঁর সে রোগীর হৃদস্পন্দরেখা টলমল করছিল, ঠিকমতো গঠিত হচ্ছিল না, মাঝেমধ্যে ছন্দহীন স্পন্দনের উঁচু-নিচু রেখা স্বল্প সময়ের জন্য, আবার হঠাত্ নিয়মিত স্পন্দন… কারণ রোগী জীবনের ওপারে চলে গেলেও সিপিআরের ফলে বুকের সংচাপনে মনিটরে প্রকৃত হৃত্ছন্দ তৈরি করছিল অকস্মাত্…। প্রাণবায়ু বেরিয়ে গেল রোগীর। তিনি যখন পেছনে বিছানায় ধপাস করে পড়ে গেলেন, তখনই হয়তো প্রাণপাখি বেরিয়ে গেল তাঁর… তাঁকে বাঁচানোর সব চেষ্টা করা হলো… ফেনা ফেনা রক্ত বেরিয়ে এল… ফুসফুস থেকে উগলে ওঠা জিনিস সাকশন পাম্পকে রোধ করল… সব করেও তাঁকে বাঁচানো গেল না।
চিকিৎসকেরা বলাবলি করছিলেন: টিউমারটির অংশবিশেষ ভেঙে গিয়ে পালমোনারি ধমনিকে দীর্ণ করেছে অথবা হৃৎপিণ্ডে বড় প্রতিরোধ স্পষ্ট করেছিল। আপাতদৃষ্টে ফুসফুসের ক্যানসার রোগীর ক্ষেত্রে এমন ঘটতে পারে সতর্ক সংকেত ছাড়াই। তবে অটোপসি না করলে প্রকৃত কারণ জানা যাবে না।
শর্মিলা নার্সিংয়ে এসেছিলেন শখের বশেই। John Donne-এর একটা কথা তাঁর জানা ছিল না—
Death be not proud, though some have called thee
Mighty and dreadful, for thou art not so.
কিন্তু সে রোগীর মৃত্যু দেখে তা মনে হবে না।
কী করা যায় তাহলে? ফিরে যান ঘরে, সন্তানদের আদর করুন, কলহ আর নয়, ভালো খাবার খান। হাঁটুন ঘনঘোর বরষায়। মুখের ওপর রোদের আলো পড়লে ঘরে যাবেন না। হাসুন, খুব জোরে, যতদূর সম্ভব কখনো কখনো নিজের প্রতিও হাসুন। কারণ মৃত্যুর প্রতিষেধক তো কবিতা নয়, নাটকও নয়, জাদু ওষুধও নয়, ঘরভর্তি প্রযুক্তিও নয়। সদিচ্ছাও নয়। মৃত্যুর প্রতিষেধক হলো জীবন। কেবলই জীবন। ‘চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে’—জীবনের কি এই নাম!’
অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরীর কলম থেকে
পরিচালক, ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস, বারডেম হাসপাতাল
সাম্মানিক অধ্যাপক, ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ, ঢাকা।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ১৭, ২০১০
Leave a Reply