এবারের বিশ্ব কিডনি দিবস বিশেষ গুরুত্ব নিয়ে আসছে।
ইন্টারন্যাশনাল নেফ্রোলজি সোসাইটি (আইএসএন) এবং ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব কিডনি ফাউন্ডেশন (আইএফকেএফ) যুক্তভাবে এ দিবসটি পালনের আয়োজন করছে।
বিশ্ব কিডনি দিবস পালনের উদ্দেশ্য হলো, আমাদের সার্বিক স্বাস্থ্যরক্ষায় কিডনির গুরুত্ব এবং বিশ্বজুড়ে কিডনি রোগের প্রভাব এবং আনুষঙ্গিক স্বাস্থ্যসমস্যা হ্রাস করার ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়া ও সচেতনতা বাড়ানো।
* বিস্ময়কর দুটো কিডনি সম্পর্কে জনগণকে জানানো।
* ক্রনিক কিডনি রোগের পেছনে ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ যে প্রধান ঝুঁকি, তা জোরালোভাবে উপস্থাপন করা।
* ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ যাদের আছে, তাদের ক্রনিক কিডনি রোগের চিহ্ন আছে কি না, তা স্ক্রিনিং করে দেখা।
* প্রতিরোধমূলক আচরণকে উত্সাহিত করা।
* ক্রনিক কিডনি রোগ (সিকেডি) নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় ও রাষ্ট্রের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা।
আগাম চিহ্নিত হলে ক্রনিক কিডনি রোগকে চিকিৎসা করে ভালো করা যায়। হ্রাস করা যায় অন্যান্য জটিলতা। বিশ্বজুড়ে ক্রনিক কিডনি রোগ ও হূদরোগে মৃত্যু ও অক্ষম অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব।
দেখা গেছে, প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর পাঁচ শতাংশের কোনো না কোনো কিডনি রোগ রয়েছে। প্রতিবছর লাখ লাখ মানুষের ক্রনিক কিডনি রোগের সঙ্গে সম্পর্কিত হূদরোগ ও রক্তনালি রোগে অকালমৃত্যু ঘটে।
ক্রনিক কিডনি রোগের সচরাচর কারণগুলোর মধ্যে আছে কিডনির প্রদাহ, মূত্রপথে অবরোধ, বংশপরম্পরায় রোগ। তবে উন্নত ও উন্নয়নশীল দুই বিশ্বেই ক্রনিক কিডনি রোগ, বিশেষ করে বয়স্কদের মধ্যে দেখা যায়। এর মূল কারণ হলো, ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ। হূদরোগেরও মূল কারণ এ দুটি সমস্যা।
ক্রনিক কিডনি রোগ শনাক্ত না হয়ে থাকলে প্রথম পরিণতি হলো কিডনির কাজকর্ম ক্রমান্বয়ে নষ্ট হয়ে যাওয়া, পরে এভাবে চলতে থাকলে ডায়ালাইসিস, এমনকি কিডনি প্রতিস্থাপনও প্রয়োজন হতে পারে। এ ছাড়া হূদরোগে অকালমৃত্যুও হতে পারে।
দেহের বিস্ময়কর যন্ত্র এ কিডনি। কিডনির মূল কাজ হলো মূত্র তৈরি করা ও রক্ত থেকে বর্জ্য ও বিষ শরীর থেকে অপসারণ করা, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা, লোহিত কণিকা তৈরি করা, হাড়কে মজবুত রাখা। মুষ্টির আয়তন এ যন্ত্রের আশ্রয় পেটের গভীরে, পাঁজরের খাঁচার নিচে।
কত যে কাজ করে কিডনি! রক্ত থেকে খনিজ, বিপাকদ্রব্য পরিষ্কার করে বের করে দেয় মূত্রের সঙ্গে বাইরে।
বিশ্বজুড়ে ২৮ কোটি মানুষেরও বেশি রয়েছে ডায়াবেটিস। এভাবে চলতে থাকলে ২০২৫ সালের মধ্যে ডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যা ৩৮ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। অনেকের অনুমান, ৪৪ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। জনসংখ্যা বিস্ফোরণ, নগরায়ণ, বসে বসে দিন কাটানো জীবন, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, স্থূলতা এসব কারণে বাড়ছে ডায়াবেটিস। ২০২৫ সালের মধ্যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যাবে। এমন ঘটবে মধ্যপ্রাচ্যে, পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে ও আফ্রিকায়। বিশ্বজুড়ে ৫০ শতাংশ মানুষ জানে না যে তাদের ডায়াবেটিস রয়েছে। প্রায় ৪০ শতাংশ ডায়াবেটিক রোগীর ক্রনিক কিডনি রোগ হয়ে যায়। স্থূলতাও বাড়ছে, এ জন্য ডায়াবেটিস ও ক্রনিক কিডনি রোগের আশঙ্কা বাড়ছে। পারিবারিক ইতিহাস, শরীরচর্চা না করা, উচ্চ রক্তচাপ, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস বড় ঝুঁকি। যেসব ঝুঁকি আয়ত্তে আনা সম্ভব, সেগুলো হ্রাস করলে ডায়াবেটিস ও ক্রনিক কিডনি রোগের আশঙ্কা কমে, কমে হূদরোগ হওয়ার আশঙ্কাও।
বিশ্বজুড়ে মানুষের মধ্যে বাড়ছে উচ্চ রক্তচাপ। ক্রনিক কিডনি রোগের এটি হলো বড় কারণ। বিশ্বজুড়ে বৃদ্ধলোকের সংখ্যা বাড়ছে এবং উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও ক্রনিক কিডনি রোগের পেছনে একটি কারণ হলো বার্ধক্য। বুড়ো বয়সের লোকের এসব বেশি হয়।
পৃথিবীজুড়ে প্রায় ১০০ কোটি লোকের রয়েছে উচ্চ রক্তচাপ। ২০২৫ সালে তা হতে পারে ১৫৬ কোটি। উন্নত দেশগুলোতে উচ্চ রক্তচাপ বাড়বে ২৪ শতাংশ।
তাই এ রোগ আগাম শনাক্ত করা জরুরি। বিশ্ব কিডনি দিবসে যাদের ঝুঁকি রয়েছে, এদের সবাইকে চেকআপ করানোর আহ্বান জানানো হচ্ছে। মানুষকে কিডনির সহজ টেস্টগুলো করিয়ে নেওয়ার জন্য উৎসাহিত করতে হবে। কিডনি রোগের ঝুঁকি যাদের রয়েছে, তাদের জন্য স্ক্রিনিং খুব জরুরি। কিডনি রোগ থাকলে আগাম নির্ণয় খুব গুরুত্বপূর্ণ, এতে কিডনির ক্ষতি হওয়ার আগেই চিকিৎসা দেওয়া যাবে।
কিডনি রোগ হয় ধীরে ধীরে এবং শেষ পর্যায়ে যখন কিডনি বিকল হওয়ার পথে, তখন হয়তো লক্ষণ-উপসর্গ দেখা দেয়। তখন হয়তো ডায়ালাইসিসের পর্যায়ে। এমন অবস্থায় জীবনাচরণ হয়ে পড়ে জটিল, স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপরও ব্যয়ের চাপ পড়ে।
মূত্রের রুটিন পরীক্ষা। মূত্রের এলবুমিন ও সুগার, রক্তের ক্রিয়েটিনিন, রক্তচাপ, রক্তের সুগার পরীক্ষা করে কিডনি রোগের আগাম সংকেত পাওয়া যেতে পারে। ল্যাবরেটরি টেস্ট করাতে সামান্য রক্ত ও প্রস্রাব প্রয়োজন হয়। কিডনির সমস্যা হলে প্রস্রাবে পাওয়া যাবে এলবুমিন। ক্রমেই বেড়ে যাবে ক্রিয়েটিনিন। গ্লুমেরুলার ফিলট্রেশন রেট (জিএফআর) কমতে থাকে, প্রতি মিনিটে ১০০ মিলিলিটার থেকে কমে ৬০-এর নিচে, শোচনীয় হলে ১৫-এর নিচে। বিশেষজ্ঞের চিকিৎসা প্রয়োজন হবে তখন।
অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরীর কলম থেকে
পরিচালক, ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস, বারডেম হাসপাতাল
সাম্মানিক অধ্যাপক, ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ, ঢাকা।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ১০, ২০১০
Leave a Reply