ডায়াবেটিস বাড়ছে এশিয়ায়, তবে পশ্চিমা দেশের মতো নয়, যাদের হচ্ছে ডায়াবেটিস তাদের বয়স তুলনামূলকভাবে কম, অনেকেই স্থূল।
২০০৯ সালের মে মাসে ‘জর্নাল অব আমেরিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন’-এ প্রকাশিত গবেষণা থেকে জানা যায়, রোগটি বিশ্বজুড়ে সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
২০০৭ সালে যা ছিল ২৪ কোটি, তা ২০২৫ সালে ৩৮ কোটিতে পৌঁছাবে।
সমস্যাটি আরও বড়, তা জানা গেল ২০০৯ সালের অক্টোবর মাসে মন্ট্রিলে আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিক ফেডারেশনের বিশ্ব কংগ্রেসে যে বিশ্ব ডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যা ২৮.৫ কোটি ছাড়িয়ে গেছে এবং এভাবে চলতে থাকলে দুই দশকে তা ৪৪ কোটিতে পৌঁছাতে পারে।
তাদের মধ্যে ৬০ শতাংশেরও বেশি ডায়াবেটিক রোগী থাকবে এশিয়ায়। বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল এ অঞ্চলে নিম্ন আয় ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে ডায়াবেটিসের প্রকোপ হবে সবচেয়ে বেশি। ভারতে ডায়াবেটিক রোগী চার কোটি থেকে বেড়ে সাত কোটিতে পৌঁছাবে, চীনে ৩.৯ কোটি রোগী বেড়ে হবে ৫.৯ কোটি, বাংলাদেশে রোগী ৩৮ থেকে ৭৫ লাখে পৌঁছাবে। লেখকদ্বয় আইডিএফ থেকে তথ্য উদ্ধৃত করেছেন, তবে এ পরিসংখ্যান সম্ভবত ২০০৭ সালের। ২০০৯ সালে বাংলাদেশের দিকে তাকালে দেখা যায়, ডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যা ৬০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইনস, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম ও অন্যান্য দেশেও ডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যাও সে হারেই বাড়ছে।
হার্ভার্ড স্কুল অব পাবলিক হেলথের অধ্যাপক ফ্রাংক হিউ লক্ষ করেছেন, এ রোগের সঙ্গে অনুষঙ্গ হিসেবে আসে গুরুতর জটিলতা, যেমন—হূদরোগ, স্ট্রোক, কিডনি বিকল ও অন্ধত্ব, যেগুলোর চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল।
গবেষণা প্রবন্ধটির অন্যতম লেখক ফ্রাংক হিউ আরও বলেন, সরকারের জোরালো পলিসি, শিক্ষাদান কর্মসূচি, সচেতনতা কর্মসূচি ও ভালো ক্লিনিক্যাল পরিচর্যা না থাকলে এশিয়ায় সাম্প্রতিক বছরগুলোয় যে আর্থিক উন্নতি হয়েছিল, তা এশিয়ার এই ক্রমবর্ধমান মহামারি ধুয়ে-মুছে ফেলবে সে উন্নতিকে, অচিরেই।
জর্নাল অব আমেরিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনে (JAMA) প্রকাশিত এক নিবন্ধ থেকে দেখা যায়, এ অঞ্চলে ডায়াবেটিসের এ ধারাটি জেনেটিক উপাদান থেকে শুরু করে ধূমপান এবং নগরায়ণের মাত্রার মধ্যে যে সাংস্কৃতিক পার্থক্য এগুলো দ্বারাও প্রভাবিত হয়েছে।
দেশ থেকে দেশে বয়স ও দেহের ওজনে যে ভিন্নতা, তা বেশ উল্লেখযোগ্য।
ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার দেশগুলোয় টাইপ-২ ডায়াবেটিসের পেছনে বড় উপাদান হয়েছিল স্থূলতা।
পশ্চিমা দেশের লোকদের তুলনায় এশিয়াবাসীর দেহের ওজন এখনো কম হলেও একটি ব্যাপার উল্লেখযোগ্য, পেটে প্রচুর মেদ জমেছে, অনেকেরই এশিয়ায়। ডায়াবেটিসের জন্য পেটে ও কোমরে মেদ জমা একটি বড় ঝুঁকিপূর্ণ উপাদান। উদরে যে মেদ জমে, ওই মেদে সঞ্চিত হয় বাড়তি শক্তি, এ থেকে নিঃসৃত হয় রাসায়নিক পদার্থ, যা নিয়ন্ত্রণ করে বিপাক এবং ইনসুলিনের কাজকর্ম।
সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব পাবলিক হেলথের অধ্যাপক স্টিফেন করবেট বলেন, সব উন্নয়নশীল দেশ, যেগুলোতে তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল খাদ্য সরবরাহ রয়েছে এবং যাদের মধ্যে শুয়ে-বসে থাকা জীবন চলে এসেছে—তাদের মধ্যে ডায়াবেটিস আসছে মহামারি রূপে।
হাজার হাজার বছর ধরে চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়ার বেশির ভাগ লোক হলো চাষি, কৃষিজীবী। তাদের মধ্যে বছরে কয়েক মাস থাকে খাদ্যের ঘাটতি।
গত ৪০ থেকে ৫০ বছরে এশিয়ায় যে খাদ্যবিধিতে অবস্থান-অন্তর ঘটেছে, সে অবস্থায় আসতে ইউরোপবাসীর লেগেছে ১৫০ থেকে ২০০ বছর। করবেট বলেন, তিনি মনে করেন ডায়াবেটিসের মহামারির পেছনে মূল কারণ হলো খাদ্যাভ্যাস।
গবেষণায় আরও দেখা গেছে, রোগটি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপে ৬০ থেকে ৭৯ বছরের মধ্যে বেশি হয়।
অথচ ডায়াবেটিস এশিয়াবাসীর মধ্যে যে বয়সে হচ্ছে, তা বেশ কম, ২০ থেকে ৫৯ বছরের মধ্যে বেশি।
এর একটি কারণ হতে পারে নিম্নজন্ম ওজন, যা উন্নয়নশীল দেশে বেশি এবং যেসব বাচ্চার নিম্নজন্ম ওজন পরে বয়সকালে অতিপুষ্টিতে এরা মোটা, স্থূল হয়ে যায়। ডায়াবেটিস হয় এ জন্য এদের বেশি।
প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, পশ্চিমা মহিলাদের তুলনায় এশিয়ান মহিলাদের মধ্যে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা দুই থেকে তিনগুণ বেশি।
এদের সন্তানের মধ্যে মেটাবলিক সিনড্রোমের আগাম বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা গেছে। ডায়াবেটিস আবার ডায়াবেটিস এভাবে একটি অনু চক্রের সৃষ্টি হচ্ছে। হিউ ও অন্য লেখকদের মন্তব্য।
জানুয়ারি ১৯৮০ থেকে মার্চ ২০০৯ পর্যন্ত প্রকাশিত প্রবন্ধ, উপাত্ত এবং শত শত গবেষণা থেকে ফলাফল সংগ্রহ করে নিবন্ধটি তৈরি করা হয়েছে।
অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরীর, পরিচালক, ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস, বারডেম হাসপাতাল, সাম্মানিক অধ্যাপক, ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ, ঢাকা
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারী ২৪, ২০১০
Leave a Reply