১৯৬৫ সালে এক অস্ট্রেলীয় আদিবাসীর রক্তে হেপাটাইটিস বি ভাইরাস আবিষ্কৃত হয়। বর্তমানে পৃথিবীতে প্রায় ৩৫ কোটি লোক হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত, যাদের প্রায় এক কোটির বাস বাংলাদেশে। রক্ত আর স্ত্রী-সহবাসের মাধ্যমে এ ভাইরাসটি ছড়ায়। রক্ত ছাড়াও মানুষের লালাতে হেপাটাইটিস বি ভাইরাস পাওয়া যায়। এই ভাইরাসে আক্রান্ত অধিকাংশ লোকের বয়স ৫০ বছরের নিচে। হেপাটাইটিস বি আক্রান্ত কোনো ব্যক্তির রক্তমাখা সু্ইয়ের খোঁচায় ভাইরাসটি সংক্রমণের আশঙ্কা শতকরা ৩০ ভাগ। আর মায়ের রক্তে হেপাটাইটিস বি ভাইরাস থাকলে জন্মের পরপর সন্তানের আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা প্রায় ৯০ ভাগ। তবে মায়ের দুধের মাধ্যমে হেপাটাইটিস বি ভাইরাস ছড়ায় না। সামাজিক মেলামেশা যেমন— করমর্দন বা কোলাকুলি ও রোগীর ব্যবহার্য সামগ্রী গ্লাস, চশমা, তোয়ালে, জামা-কাপড় ইত্যাদির মাধ্যমে এ রোগ ছড়ায় না।
হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত প্রায় ৭০ ভাগ রোগীর জন্ডিসে আক্রান্ত হওয়ার কোনো ইতিহাস থাকে না। শতকরা ১০ ভাগ প্রাপ্তবয়স্ক আর প্রায় ৯০ ভাগ শিশু যারা এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়, তাদের লিভারে স্থায়ী ইনফেকশন দেখা দেয়। একে বলা হয় ক্রনিক হেপাটাইটিস বি। এসব ব্যক্তিই HBsAg পজিটিভ হিসেবে পরিচিত। এ ধরনের রোগীর প্রায়ই কোনো লক্ষণ থাকে না। এরা কখনো কখনো পেটের ডান পাশে ওপরের দিকে ব্যথা, দুর্বলতা কিংবা ক্ষুধামন্দার কথা বলে থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিদেশে গমনের সময় রক্ত পরীক্ষা কিংবা রক্ত দিতে অথবা ভ্যাকসিন নিতে গিয়ে রোগীরা তাদের ইনফেকশনের কথা জানতে পারে।
ক্রনিক হেপাটাইটিস বি এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় আরও অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও লিভার সিরোসিস ও লিভার ক্যানসারের প্রধান কারণ। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, যদিও হেপাটাইটিস বি অনেকাংশেই নিরাময়যোগ্য, কিন্তু অ্যাডভান্সড লিভার সিরোসিস অথবা লিভার ক্যানসারে আক্রান্ত না হওয়া পর্যন্ত রোগীরা প্রায়ই কোনো শারীরিক অসুবিধা অনুভব করে না। ফলে হেপাটাইটিস বি ভাইরাস ইনফেকশনের চিকিত্সা করা সম্ভব হলেও রোগীকে আর সেভাবে সাহায্য করা সম্ভব হয় না।
ভ্যাকসিনেশন হেপাটাইটিস বি প্রতিরোধে কার্যকর। হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত মায়ের সন্তান, রোগীর স্বামী বা স্ত্রী, স্বাস্থ্যকর্মী ও থেলাসেমিয়া এবং অন্যান্য হেমোলাইটিক এনিমিয়ার রোগীদের জন্য হেপাটাইটিস বি-এর ভ্যাকসিন নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। তবে ভ্যাকসিনটি নিতে হবে কোনো ভালো জায়গা থেকে। কারণ, ঠিকমতো সংরক্ষণ করা না হলে এই ভ্যাকসিন কোনো উপকারেই আসে না।
এর মধ্যেও সুসংবাদ হলো, হেপাটাইটিস বি আজ আর কোনো দুরারোগ্য ব্যাধি নয়। লিভার সিরোসিস বা লিভার ক্যানসারের মতো মারাত্মক রোগ দেখা দেওয়ার আগে এটি ধরা গেলে রোগাক্রান্ত ব্যক্তির পূর্ণ নিরাময়ের সম্ভাবনা খুবই উজ্জ্বল। পৃথিবীতে আজ এই ভাইরাসটির বিরুদ্ধে কার্যকর অনেক ওষুধ রয়েছে, যার প্রায় সবকটিই বাংলাদেশে সহজলভ্য। এসবের মধ্যে আছে পেগাসিস, ইন্টারফেরন, ল্যামিভুডিন, এডিফোভির আর সর্বশেষ সংযোজন টেলবিভুডিন, যা এ বছরের প্রথম দিকে আমেরিকায় ফেডারেল ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের অনুমোদন পেয়েছে, আর এখন বাংলাদেশেও পাওয়া যাচ্ছে। আরও সুসংবাদ হলো, আমাদের দেশীয় একাধিক ওষুধ কোম্পানি এসব ওষুধের বেশ কিছু এ দেশেই তৈরি করছে এবং তা সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে।
তবে চিকিত্সায় প্রত্যাশিত ফলাফল প্রাপ্তি নির্ভর করে সঠিক সময়ে সঠিক ওষুধ প্রয়োগের ওপর। হেপাটাইটিস বি আক্রান্ত কোনো রোগীকে হেপাটাইটিস বি-এর যেকোনো ওষুধ দিয়ে দিলেই কাজ হয়ে যাবে, এমনটা প্রত্যাশা করা ঠিক নয়।
এ জন্য অনেক সময় লিভার বায়োপসি করেও সিদ্ধান্ত নিতে হয়। কারণ, ওষুধ নির্বাচনে কিংবা প্রয়োগে এতটুকু হেরফের হলেও তাতে ভাইরাল রেজিস্টেন্স তৈরির পাশাপাশি রোগীর লিভারের বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা থাকে।
হেপাটাইটিস বি-জনিত লিভার রোগ প্রতিরোধ ও চিকিত্সায় তাই প্রয়োজন সচেতনতার।
একদিকে যেমন প্রত্যেকেরই উচিত হেপাটাইটিস বি-এর ভ্যাকসিন নেওয়া, তেমনি হেপাটাইটিস বি-আক্রান্ত ব্যক্তিরও উচিত হতাশ না হয়ে লিভার রোগবিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হওয়া।
লিভারে আক্রান্ত প্রায় ৩০ শতাংশ রোগী পরবর্তী সময়ে লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হয়। এ দেশেও আমরা ফ্যাটি লিভারজনিত লিভার সিরোসিস ও লিভার ক্যানসারের রোগী পেয়ে থাকি। অতএব সাবধান!
মামুন-আল-মাহতাব
হেপাটাইটিস বি নতুন করে চেনা সহকারী অধ্যাপক, লিভার বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারী ২৭, ২০১০
Leave a Reply