উন্নয়নশীল দেশে অধিকাংশ পুরুষ ধূমপান করে অসচেতনতা, বন্ধুদের (পিয়ারদের) প্রেসার এবং সিগারেটের অতিমাত্রায় সহজলভ্যতার কারণে। অন্যদিকে, উন্নত দেশে মানুষের সচেতনতা এবং ধূমপানের ওপর বিধিনিষেধ থাকার কারণে ধূমপান করার হার কমে যাচ্ছে এবং সিগারেট কোম্পানিগুলো আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশকে টার্গেট করেছে সিগারেটের ব্যবসা প্রসারের জন্য। উন্নত দেশে নারীরা ধূমপান করে থাকে বিভিন্ন কারণে: কিছু নারী ধূমপান করে স্ট্রেস/চাপ মোকাবিলা করার জন্য অথবা দৈহিক ওজন নিয়ন্ত্রণ করার জন্য; তরুণীরা ধূমপান শুরু করে বিদ্রোহী এবং স্বাধীনচেতা মনোভাবের প্রকাশ হিসেবে অথবা তাদের বন্ধুদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ার জন্য। মোদ্দা কথা, ধূমপান করার জন্য ভালো কোনো কারণ নেই। ধূমপান মারাত্মক স্বাস্থ্যহানির কারণ ঘটায়।
যেসব স্বাস্থ্যগত কারণে ধূমপান ছাড়বেন
ফুসফুস, গলা, মুখ, বাগ্যন্ত্র, খাদ্যনালি, অগ্ন্যাশয়, বৃক্ক, মূত্রথলি, জরায়ুর মুখ এবং পাকস্থলীর ক্যানসার। লিউকেমিয়া (এক ধরনের রক্তের ক্যানসার)। ফুসফুসের অন্যান্য রোগ (যেমন এফাইসিমা) রক্তনালি শক্ত এবং চিকন হয়ে যাওয়া (অ্যাথেরোস্কেলেরোসিস)। হার্ট অ্যাটাক।
স্ট্রোক (ব্রেইনে রক্তক্ষরণের জন্য প্যারালাইসিস)। দাঁতের মাঢ়ির রোগ।
চোখের সমস্যা থেকে অন্ধ হয়ে যাওয়া।
ধূমপান আরও কিছু সমস্যার কারণ, যেমন—
অন্যান্য অসুস্থতা দীর্ঘস্থায়ী করে।
অপারেশনের পর সহজেই ক্ষতস্থানে ইনফেকশন হয়। গর্ভধারণে সমস্যা হয়।
কোমর বা ঊরুর হাড় ভাঙার ঝুঁকি বাড়ায়।
গর্ভাবস্থায় ধূমপান সাংঘাতিক খারাপ, কারণ—
গর্ভফুল (প্লাসেন্টা) জরায়ু মুখের খুব কাছাকাছি চলে আসে, তাতে সিজারিয়ান অপারেশন ছাড়া বাচ্চা ডেলিভারি করা যায় না।
গর্ভফুল সঠিক সময়ের আগেই জরায়ু ছেড়ে আসে, যার ফলে সময়ের আগেই ‘লেবার পেইন’ হয় অথবা গর্ভেই বাচ্চার মৃত্যু হতে পারে। গর্ভপর্দা সঠিক সময়ের আগেই ফেটে যায়, পানি বেরিয়ে আসে ‘লেবার পেইন’ শুরু হওয়ার আগেই, ফলে বাচ্চা সময়ের আগেই ভূমিষ্ঠ হয়। কম ওজনের বাচ্চা ভূমিষ্ঠ হয়। নবজাতকের ফুসফুসের ক্ষতি হয়।
ধূমপান ছেড়ে দিলে আপনি যে বাড়তি সুফলগুলো পাবেন—
আপনাকে ধূমপানের জন্য কর্মস্থল বা বাড়ি ছাড়তে হবে না। আপনার দাঁতগুলো আরও পরিষ্কার হবে। আপনার শ্বাস দুর্গন্ধমুক্ত হবে। আপনার আঙুলগুলোর নিকোটিন-রং হালকা হয়ে যাবে। আপনার ত্বক কুঁচকানো কমে যাবে। খাবারের ঘ্রাণ ও স্বাদ আগের থেকে ভালো উপভোগ করবেন। আপনি অধিকতর শক্তি অনুভব করবেন এবং কর্মক্ষম হবেন।
ধূমপান ছাড়ার উপায়
দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিন এবং ভালো বোধ করুন!
যদি আপনি ধূমপান ছেড়ে দেওয়ার দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন, আপনাকে বিশাল অভিনন্দন! এতে শুধু আপনার স্বাস্থ্যই উন্নত হবে না, আপনি আপনার প্রিয়জনদের স্বাস্থ্যও রক্ষা করবেন পরোক্ষ ধূমপান থেকে। এটা কঠিন সত্য যে ধূমপান একেবারে ছেড়ে দেওয়া অত্যন্ত কঠিন। আপনি কি জানেন, অনেক ধূমপায়ীই মঙ্গলের জন্য ধূমপান ছাড়তে চায় কিন্তু সে চেষ্টা সফল হওয়ার আগে দুই বা তিনবার ব্যর্থ হয়? সিগারেটের মূল উপাদান নিকোটিন একটি সাংঘাতিক আসক্তিকর ড্রাগ: এমনই আসক্তিকর যে তা হেরোইন বা কোকেইনের মতো। সুসংবাদটি হচ্ছে, মঙ্গলের জন্য লাখ লাখ মানুষ ধূমপান ছেড়ে দিতে সমর্থ হয়েছে। ধূমপান ছেড়ে দেওয়া কঠিন কাজ হলেও সম্ভব। আপনি শিহরিত হবেন, যখন নিজেকে ব্যয়বহুল একটি নেশা থেকে মুক্ত করতে পারবেন এবং পরোক্ষ ধূমপানের দ্বারা অন্যের আর ক্ষতি করবেন না।
ধূমপান ছাড়ার পাঁচটি টিপস: (গবেষণালব্ধ ফল)
বিশেষ একটি দিন ঠিক করুন: দিনটির আগের দিন সব সিগারেট, অ্যাশট্রে এবং লাইটার ফেলে দিন, আপনার বাড়িতে কাউকেই ধূমপান করতে দেবেন না। একটি কাগজে লিখে রাখুন কেন আপনি ধূমপান ছাড়তে চান এবং লিস্টটি সংরক্ষণ করুন রিমাইন্ডার হিসেবে।
আপনার পরিবার, বন্ধু এবং সহকর্মীর সহযোগিতা নিন: গবেষণায় দেখা গেছে, অন্যের সহযোগিতা পেলে ধূমপান ছাড়া সহজ। আপনার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ধূমপান ছাড়ার তারিখটি জানান এবং তাদের সহযোগিতা করতে বলুন। অনুরোধ করুন তারা যেন আপনার চারপাশে ধূমপান না করে অথবা সিগারেট অফার না করে।
ধূমপানের বিকল্প খুঁজুন এবং প্রতিদিনের রুটিন বদলান: যখন ধূমপান করার ইচ্ছে হবে, এমন কিছু করুন, যাতে আপনার মন অন্য কিছুতে ব্যস্ত থাকে। বন্ধুর সঙ্গে কথা বলুন, হাঁটতে বের হয়ে যান, অথবা সিনেমা দেখতে হলে চলে যান। চিনিমুক্ত চুইংগাম বা ক্যান্ডি খান আপনার ধূমপানের আকাঙ্ক্ষাকে কমানোর জন্য। প্রচুর পানি ও জুস খান। এর সঙ্গে আপনি আপনার প্রতিদিনের রুটিন বদলাতে পারেন। কফির পরিবর্তে চা পান করুন। সকালের নাশতা একই জায়গায় প্রতিদিন খাবেন না। কর্মস্থলে যাওয়ার রাস্তা পরিবর্তন করুন।
ধূমপান ছাড়ার ওষুধ গ্রহণ করতে পারেন: চিকিত্সকের পরামর্শ নিন। কিছু ধূমপায়ীর প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় যদি সে ধূমপান ছেড়ে দেয় যেমন—বিষণ্নতা, ঘুমাতে সমস্যা, বিরক্তবোধ বা অস্বস্তিবোধ করা এবং পরিষ্কার চিন্তা করতে না পারা। কিছু ওষুধ উল্লিখিত উপসর্গগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে। অধিকাংশ ওষুধ সিগারেটের মূল আসক্তিকর উপাদান নিকোটিনের মাত্রা রক্তে ধারাবাহিকভাবে কম পরিমাণ অবমুক্তকরণের মাধ্যমে কাজ করে। চিকিত্সকের পরামর্শ নিন কোন ওষুধটি আপনার জন্য সঠিক।
নিকোটিন প্যাচ: এটি ত্বকে লাগানো হয় এবং ত্বকের মাধ্যমে দেহে নিকোটিন অবমুক্ত হয়। নিকোটিন গাম/লজেন্স: মুখের ভেতর আবরণীর মাধ্যমে রক্তে নিকোটিন অবমুক্ত হয়। নিকোটিন নেজাল স্প্রে: নাকে স্প্রে করলে নিকোটিন শ্বাসের মাধ্যমে রক্তে প্রবেশ করে। নিকোটিন ইনহেলার: মুখ ও গলার মাধ্যমে নিকোটিন রক্তে প্রবেশ করে। বিউপ্রোপিওন: এটি একটি বিষণ্নতাবিরোধী ওষুধ, যেটি নিকোটিন পরিহারজনিত লক্ষণ কমাতে সাহায্য করে এবং ধূমপানের আকাঙ্ক্ষা কমায়। ভ্যারেনিক্লিন (চ্যানটিক্স): ওষুধটি নিকোটিন পরিহারজনিত লক্ষণ এবং ধূমপানজনিত তৃপ্তি কমায়।
পুনঃ ধূমপানের প্রবণতা থেকে সতর্ক থাকুন: অধিকাংশ ধূমপায়ী ধূমপান ছাড়ার প্রথম তিন মাসের মধ্যেই আবার ধূমপান শুরু করে, এতে আশাহত হবেন না। মনে রাখবেন, অনেকের ক্ষেত্রেই এটি ঘটে কিন্তু সফল হয় নিজের মঙ্গলের জন্য।
আপনি চিন্তা করুন, কোন বিষয়গুলো ধূমপান ছাড়ার জন্য সহায়ক ছিল এবং কোনগুলো ছিল না। এগুলো বের করতে পারলে আপনার সফল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কিছু কিছু অবস্থা আপনার ধূমপানের আকাঙ্ক্ষা বাড়ায়। যেমন ধূমপায়ীদের সান্নিধ্যে থাকা, শরীরের ওজন বাড়া, চাপ বা স্ট্রেস, অথবা বিষণ্নতায় থাকা; তাই এগুলো মোকাবিলার জন্য চিকিত্সকের পরামর্শ নিন।
মো. ইফতেখার হাসান খান
জনস্বাস্থ্য ও ফ্যামিলি মেডিসিন বিশেষজ্ঞ
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারী ২৭, ২০১০
Leave a Reply