‘বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর সবার আমি ছাত্র।’ তাই তো ক্যাঙারু মায়ের কাছ থেকে আমরা শিখে নিয়েছি সন্তানকে যত্নের এক বিশেষ কৌশল। ক্যাঙারু শব্দটি শুনলে মনের জানালায় ভেসে ওঠে অ্যানিমেল প্লানেট বা ডিসকভারি টিভি চ্যানেলে দেখা অস্ট্রেলিয়ার ধূসর বর্ণের সুন্দর প্রাণীটি। মা ক্যাঙারু তার পেটের বাইরের থলিতে ছোট শিশু ক্যাঙারুকে নিয়ে কী স্বাচ্ছন্দ্যে ঘুরে বেড়ায়, লাফিয়ে বেড়ায়। মা আর সন্তানের এই অপূর্ব অবিচ্ছেদ্য বন্ধনই ‘ক্যাঙারু মায়ের যত্নের’ ভিত্তি।
ক্যাঙারু মায়ের যত্ন কী
কম ওজনের নবজাতকের পরিচর্যা করার একটি বিশেষ পদ্ধতি হচ্ছে, ‘ক্যাঙারু মায়ের যত্ন’ সংক্ষেপে যাকে বলে কেএমসি।
যেসব নবজাতকের জন্মের সময়ের ওজন দুই কেজি ৫০০ গ্রামের কম, তারাই হচ্ছে কম ওজনের শিশু। সাধারণত এই নবজাতকেরা বিভিন্ন রকম স্বাস্থ্য সমস্যা বা জটিলতার সম্মুখীন হতে পারে। কম ওজনের শিশুর এসব জটিলতা এড়াতে এবং সুস্থ রাখতে মূল কাজ হচ্ছে:
নবজাতককে উষ্ণ রাখা।
শুধু বুকের দুধ খাওয়ানো।
রোগ সংক্রমণ প্রতিরোধ করা।
কেএমসি পদ্ধতিতে এর সবই নবজাতককে দেওয়া সম্ভব হয়। এর সঙ্গে উপরি পাওনা হলো মা ও শিশুর নিবিড় মানসিক বন্ধন তৈরি হওয়া। কেএমসি পদ্ধতির মূল অংশ হচ্ছে—
ত্বকে ত্বক স্পর্শ।
শুধু বুকের দুধ খাওয়ানো।
সফল কেএমসির জন্য এ দুটো কাজ সঠিকভাবে করতে হবে।
কেএমসি যার জন্য প্রযোজ্য
কেএমসি দেওয়ার জন্য নবজাতকের শারীরিক বা স্বাস্থ্যগত অবস্থা স্থিতিশীল হওয়া প্রয়োজন।
জন্মের সময়ের ওজন এক কেজি ৮০০ গ্রামের বেশি হলে নবজাতক সাধারণত স্থিতিশীল অবস্থায় থাকে। তাই এই নবজাতককে জন্মের পরপরই কেএমসি দেওয়া যায়।
নবজাতক এক কেজি ২০০ গ্রামের বেশি কিন্তু এক কেজি ৮০০ গ্রামের কম ওজনের হলেও যদি তার অবস্থা স্থিতিশীল থাকে, তাহলে তাকে কেএমসি দেওয়া যাবে।
অসুস্থ বা অস্থিতিশীল নবজাতক সুস্থ, স্থিতিশীল অবস্থায় না আসা পর্যন্ত তাকে কেএমসি দেওয়া যায় না।
কখন কেএমসি শুরু করা যায়
প্রসব-পরবর্তী সময়ে মা যখনই সুস্থ বোধ করবেন, তখনই কেএমসি শুরু করা যায়।
তবে শুরু করার আগে হাসপাতালের চিকিত্সক বা নার্স শিশুর মা ও পরিবারের সদস্যদের কেএমসি সম্পর্কে বিস্তারিত জানাবেন। বিশেষত এর প্রয়োজনীয়তা ও উপকারিতা সম্বন্ধে। ফলে মা কেএমসি দিতে উত্সাহী হবেন। এ বিষয়ে তাঁদের কিছু জানার থাকলে এই সময় তাঁরা জেনে নিতে পারবেন।
হাসপাতালে চিকিত্সকের তত্ত্বাবধানে কেএমসি শুরু করতে হবে। পরে মায়ের পরিবর্তে অন্য কেউ যেমন—বাবা, নানি, দাদিও এভাবে শিশুর যত্ন নিতে পারবেন।
কেএমসির উপকারিতা
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, কেএমসি পাওয়া নবজাতকের শুধু মায়ের দুধপানের হার এবং দুধপানের স্থায়িত্বকাল, যারা এ পদ্ধতিতে যত্ন পায়নি তাদের চেয়ে অনেক বেশি। এদের ওজন দ্রুত বৃদ্ধি পায়, শারীরিক বিকাশও ঘটে দ্রুত।
কম ওজনের শিশুর সমস্যা হিসেবে প্রায়ই নিম্ন তাপমাত্রা ঘটে থাকে, যা এসব শিশুর শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটায়। কেএমসি পাওয়া নবজাতক সার্বক্ষণিক ত্বকে ত্বক স্পর্শ পায়, যা তাকে উষ্ণ রাখে। ফলে নিম্ন তাপমাত্রা ঘটার ঝুঁকি অনেকাংশে কমে যায়। এমনকি যেসব নবজাতকের শরীরের তাপমাত্রা ইতিমধ্যে স্থিতিশীল অবস্থায় আছে, তাদের বেলাতেও ইনকিউবেটরের চেয়ে কেএমসি বেশি নিরাপদ এবং শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে অধিক সহায়ক।
হঠাত্ শ্বাস বন্ধ হওয়া কম ওজনের শিশুর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। কেএমসি পাওয়া শিশুর শ্বাস দ্রুত নিয়মিত হয়ে আসে এবং হঠাত্ শ্বাস বন্ধ হওয়া কম হয়।
এরা নিউমোনিয়ায় কম আক্রান্ত হয় এবং অন্যান্য রোগের সংক্রমণও কম হয়।
এদের হাসপাতালে অবস্থান তুলনামূলক কম সময়ের হয়ে থাকে।
এ পদ্ধতিতে মা ও শিশু দুজনই নিরুদ্বিগ্ন থাকে। মা ও শিশুর বন্ধন নিবিড় হয়। শিশুর যত্নে মায়ের আত্মবিশ্বাস বাড়ে।
এ জন্য আলাদা কোনো লোকবলের প্রয়োজন হয় না। বাড়তি কোনো খরচও লাগে না।
মা বিশ্রামে থাকলে, অথবা অন্য কারণে কেএমসি না দিলে অন্য যে কেউ দিতে পারে।
সর্বোপরি কেএমসি শিশুর পঞ্চেন্দ্রিয়কে উজ্জীবিত ও পরিতৃপ্ত করে। শিশু ত্বকে ত্বক স্পর্শের ফলে উষ্ণতা অনুভব করে (স্পর্শ), মায়ের কণ্ঠস্বর এবং হূত্স্পন্দন শোনে (শ্রবণ), দুধপান করে (স্বাদ), মায়ের চোখে চোখ রাখে (দর্শন) এবং মায়ের শরীরের গন্ধ পায় (ঘ্রাণ), ফলে একই সঙ্গে সব ইন্দ্রিয় সক্রিয় থাকে।
কেএমসি দেওয়ার প্রস্তুতি
মা এমন পোশাক পরবেন, যেন সহজেই তাঁর সামনের অংশ খোলা যায়। যেমন—সামনে খোলা ঢিলা ব্লাউজ বা কামিজ অথবা ম্যাক্সি ইত্যাদি।
শিশু খালি গায়ে থাকবে তবে টুপি, মোজা ও ন্যাপি পরবে। ঠান্ডা আবহাওয়ায় সামনের দিক খোলা জামা পরানো যেতে পারে।
মা কেএমসি দেওয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকবেন।
মা হেলান দিয়ে বিছানায় শোবেন বা আরাম করে বসবেন।
কেএমসি দেওয়ার নিয়ম
শিশুকে সোজা অবস্থায় মায়ের দুই স্তনের মাঝখানে রাখতে হবে, যাতে ত্বকে ত্বক স্পর্শ সে ঠিকভাবে পায়।
শিশুর মাথা একদিকে ফিরিয়ে রাখতে হবে এবং কিছুটা পেছনের দিকে হেলে থাকবে। এতে শিশুর শ্বাসনালি খোলা থাকবে এবং মা সহজেই শিশুর চোখের দিকে তাকাতে পারবেন।
শিশুর হাত-পা ভাঁজ করা অবস্থায় থাকবে (ব্যাঙের মতো)।
মায়ের শরীরের মাঝ রেখায় পাঁজরের নিচ বরাবর শিশুর পেট স্পর্শ করবে।
কেএমসি অবস্থায় শিশুর বুকের দুধ খাওয়া সহজ হয়। সন্তানের স্পর্শে দুধের প্রবাহ বেশি হয়। শুধু বুকের দুধ দেওয়া—নিশ্চিত করা সম্ভব হয়।
কাপড় দিয়ে সুবিধামতো বেঁধে শিশুকে যথাস্থানে রাখতে পারলে মা ঘুমের মধ্যেও কেএমসি দিতে পারবেন।
ত্বকে ত্বক স্পর্শ পরিচর্যার সময়কাল ধীরে ধীরে বাড়াতে হবে। শুধু ডায়াপার বা ন্যাপি বদলানোর সময় ছাড়া বাকি সময়টুকু কেএমসি দিতে হবে (অর্থাত্ দৈনিক প্রায় ২৪ ঘণ্টা)।
একনাগাড়ে এক ঘণ্টার বেশি কেএমসি দেওয়া সম্ভব না হলে এটা শুরু না করাই ভালো।
কেএমসি কখন বন্ধ করবেন
নবজাতকের ওজন দুই কেজি ৫০০ গ্রাম বা বয়স (গর্ভকাল+জন্ম-পরবর্তী সময়) ৪০ সপ্তাহ না হওয়া পর্যন্ত কেএমসি চালিয়ে যেতে হবে। তবে মা বা শিশুর কোনো ধরনের অসুবিধা হলে এর আগেই এটি বন্ধ করে দেওয়া যেতে পারে।
কেএমসি ফলোআপ
সফলভাবে কেএমসি চালিয়ে যাওয়ার জন্য নিয়মিত শিশুর ফলোআপ দেওয়া খুবই প্রয়োজন। যত কম ওজনের শিশু, তত ঘন ঘন ফলোআপ প্রয়োজন। ফলোআপে চিকিত্সক কেএমসি চালাতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে কি না, তা দেখার পাশাপাশি শিশুকে পূর্ণাঙ্গভাবে পরীক্ষা করেন এবং কোনো সমস্যা পাওয়া গেলে তাত্ক্ষণিকভাবে চিকিত্সার ব্যবস্থা নেন। তাই শিশুর স্বার্থে, বাড়িতে চলে গেলেও নির্ধারিত দিনে তাকে নিয়মিত ফলোআপের জন্য হাসপাতালে নিয়ে আসা প্রয়োজন।
নাজমা ইয়াসমীন
একজন মায়ের যত্নের ফলেই শিশু এমন সুস্থ ও সবল থাকে। সহকারী অধ্যাপক, শিশু বিভাগ
নর্দান ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ, ঢাকা
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারী ১৩, ২০১০
Leave a Reply