পুরুষের মত মহিলারাও মূত্রতন্ত্রসহ নানা ইউরোলজিক্যাল সমস্যায় ভুগে থাকেন। অথচ যথাযথ চিকিৎসায় এসব সমস্যা সম্পূর্ণ ভাল হয়। মহিলাদের মূত্রতন্ত্রের সমস্যা নিয়ে এই বিশেষ প্রতিবেদন রচনা করেছেন বিশিষ্ট ইউরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা: মো: জাহাঙ্গীর কবীর।
একজন মহিলা, পুরুষের মতই অন্যান্যইউরোলজি রোগে ভুগতে পারেন। যেগুলোর মধ্যে আছে কিডনি ও মূত্রতন্ত্রের ক্যান্সার, কিডনি ও মূত্রতন্ত্রের পাথুরে রোগ, আঘাতজনিত সমস্যা ইত্যাদি। তবে নারী পুরুষের দৈহিক গড়ন ও প্রকৃতিগত পার্থক্যের কারণে নারীর মূত্রতন্ত্রের বা ইউরোলজি রোগের ক্ষেত্রে বিশেষ পার্থক্য দেখা যায়। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-মূত্রতন্ত্রের ইনফেকশন, মূত্রথলির অস্থিরতা, মূত্রঝরা, ফিস্টুলা ও স্ট্রিকচার।
মূত্রতন্ত্রের ইনফেকশন: মহিলাদের ঘনঘন ইউ.টি.আই বিশ্বব্যাপি একটি প্রচলিত সমস্যা। মহিলাদের মূত্রপথের কম দৈর্ঘ্য, মূত্রদ্বার জননাঙ্গ পথের নিকট অবস্থান, মেনোপজের পর মূত্রপথের স্বাভাবিক প্রতিরোধ ক্ষমতা কমা ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে মহিলাদের মূত্রতন্ত্রের ইনফেকশন হয়ে থাকে। তবে কারো কারো ক্ষেত্রে এর প্রবণতা বেশী দেখা যায়। এছাড়া গর্ভবতী অবস্থায়ও নানাবিধ কারণে মূত্রতন্ত্রের ইনফেকশনের প্রবণতা অনেকগুন বেড়ে যায়। ডায়াবেটিস্, বাতজনিত রোগ ও বার্ধক্যজনিত কারণে মূত্রতন্ত্রের ইনফেকশন হয়ে থাকে। অন্য সাধারণ অসুখের মত স্বল্প সময়ের জন্য (অর্থাৎ ৫-৭ দিন) অ্যান্টিবায়োটিক খেলেই ইউ.টি.আই সবসময় ভাল হয় না। অনেক সময় দীর্ঘদিন অ্যান্টিবায়োটিক খেয়ে যেতে হয়।
তবে যাদের ঘনঘন ইউ.টি.আই হয়, তাদের কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা জরুরি। ইউ.টি.আই-এর ক্ষেত্রে শতকরা ৮৫ ভাগ জীবাণু ই-কলাই পাওয়া যায়। অন্যান্য জীবাণুর মধ্যে আছে ক্লেবসিলা, এন্টারোব্যাকটেরিয়া , প্রটিয়াস ইত্যাদি। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে সুডোমনাস পাওয়া যেতে পারে। অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের পূর্বে মূত্রের কালচার সেনসিভিটি করা হয়-যাতে সঠিক অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করা যায়। তাছাড়া মূত্রতন্ত্রের আর কোন জটিলতা আছে কিনা, ক্ষেত্র বিশেষে আলট্রাসাউন্ড অথবা এক্স-রে পরীক্ষার মাধ্যমে তা দেখে নেয়ার দরকার হয়। যেমন-মূত্রত্যাগের পর প্রস্রাবের থলিতে মূত্র থেকে যায় কিনা, মূত্রতন্ত্রের পাথর আছে কিনা, কিডনির কোন অংশ অস্বাভাবিক ফোলা কিনা, অথবা প্রস্রাব উল্টোদিকে প্রবাহিত হয় কিনা। যাদের এ ধরনের সমস্যা থাকে, প্রাথমিকভাবে এগুলোর চিকিৎসা না করালে ইউ.টি.আই ভালো হয় না।
মূত্রথলির অস্থিরতা: ঘনঘন মূত্র ত্যাগ, তাড়াহুড়ো করে মূত্র ত্যাগের প্রবণতা, টয়লেটে পৌঁছাবার পূর্বেই মূত্রত্যাগের নিয়ন্ত্রণ হারান, বাড়িতে পৌঁছামাত্রই অথবা পানির সংস্পর্শে আসা মাত্রই মূত্র ত্যাগের বেগ পাওয়া, সব সময় তলপেটে অস্বস্থি অনুভূত হওয়াকে মূত্রথলির অস্থিরতা বা ওভারঅ্যাকটিভ ব্লাডার বলা হয়ে থাকে। এ অবস্থায় মূত্রথলির মাংসের অনিয়ন্ত্রিত সংকোচন হয়ে থাকে।
নানাবিধ কারণে এই অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। যেমন-স্নায়ুবিক জটিলতা, স্ট্রোক, স্ট্রিকচার ইত্যাদি। তবে কোন কারণ ছাড়াও মূত্রথলির এই অস্থিরতা দেখা দিতে পারে। যাকে আমরা ইডিওপ্যাথিক ডেটরুসর ইনস্টিবিলিটি বলে থাকি। এই সমস্যা নারীদের ক্ষেত্রে বেশী হয় এবং যে কোন বয়সেই তা দেখা দিতে পারে। তবে এ কথা মনে রাখা দরকার যে, প্রয়োজনীয় পরীক্ষার মাধ্যমে মূত্রথলির অস্থিরতার অন্য কারণগুলো বাদ দেওয়ার পরই কেবল এটা বলা যায়। সবশেষে ইউরোডায়নামিক পরীক্ষা (সিস্ট্রোমেট্রি) করেই এটা নিশ্চত ভাবে ডায়াগনোসিস করা যায়। মূত্রথলির অল্প ও মধ্যম মাত্রার অস্থিরতা সাধারণত: ওষুধ সেবনের মাধ্যমেই নিয়ন্ত্রণ রাখা যায়। তবে অধিক মাত্রার অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণে অস্ত্রপচারের প্রয়োজন হয় এবং রোগীকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে তোলা যায়।
মূত্রঝরা: বিভিন্নভাবে মূত্রঝরা দেখা দিতে পারে-
স্ট্রেস ইনকন্টিনেন্স: এ অবস্থায় হাঁচিকাঁশির সঙ্গে মূত্র নির্গত হয়ে থাকে। বার্ধক্য বা প্রসবজনিত কারণে পেলভিক ফ্লোরের মাংস দুর্বল হয়ে মূত্রদ্বারের নিয়ন্ত্রণে দুর্বলের জন্য এটি হয়ে থাকে। ব্যায়ামের মাধ্যমে এ অবস্থার যথেষ্ঠ উন্নতি করা গেলেও অনেক ক্ষেত্রে অস্ত্রপচারের প্রয়োজন হয়।
আর্জ ইনকন্টিনেন্স: এ অবস্থায় হঠাৎ মূত্রত্যাগের বেগ পেয়ে টয়লেটে পৌঁছানোর পূর্বেই মূত্র নির্গত হয়ে থাকে। ওভার এ্যাকটিভ ব্লাডার অথবা স্নায়ুবিক জটিলতা থেকে এটি হতে পারে। যদিও ওষুধ সেবনে অধিকাংশ রোগী ভাল থাকে তবুও ক্ষেত্র বিশেষে অস্ত্রপচারের প্রয়োজন হয়।
কন্টিনিউয়াস ইনকন্টিনেন্স (সবসময় মূত্রঝরা): মূত্রদ্বারের নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণভাবে নস্ট হয়ে গেলে, মূত্রথলির সঙ্গে জননতন্ত্রের অস্বাভাবিক যোগাযোগে তৈরী ফিস্টুলা থাকলে-এ অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। এখানে সাধারণত: ওষুধে কাজ হয় না। শুধু অস্ত্রপাচারের মাধ্যমেই এটি থেকে আরোগ্য লাভ করা যায়। নিচে ফিস্টুলা নিয়ে আলাদা ভাবে আলোচনা করা হল।
জেনিটো ইউরিনারি ফিস্টুলা
ফিস্টুলা: মূত্রতন্ত্রের সঙ্গে জননতন্ত্রে অস্বাভাবিক যোগাযোগের সাথে এটি সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন কারণে এটি হতে পারে। এদের মধ্যে উল্লোখযোগ্য হচ্ছে জন্মগত, অপারেশনের জটিলতা, প্রসব জটিলতা ইত্যাদি থেকে। আমাদের দেশে একটি বড় কারণ হচ্ছে-প্রসবজনিত জটিলতা। উন্নত দেশে এ ধরনের ফিস্টুলার অসি-ত্ব লোপ পেয়েছে। কিন্তু এদেশে গর্ভবতী নারীদের সেবা এখনও পর্যাপ্ত না হওয়ায় অনেক পরিমাণ দেখা যায়। এ ধরনের অবস্থা যে কোন নারীর জন্য একটি চরম অবস্থা। এরা সামাজিকভাবে এবং অনেক ক্ষেত্রে স্বামী পরিত্যাক্তা হন। অস্ত্রপচারের মাধ্যমে এ থেকে সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করা যায়।
পরিশেষে, একথা বলা প্রয়োজন যে- ইউরোলজিক্যাল সমস্যাগুলি কোনভাবেই কিডনি বা স্ত্রী রোগ নয়। অনেকে এ বিষয়ে ভ্রান- ধারণা পোষণ করেন। আবার অনেকেই একে দূরারোগ্য ব্যাধি, চিকিৎসা নেই মনে করে চিকিৎসা ছাড়াই অহেতুক কষ্ট পেয়ে থাকেন। অথচ অনেকেই জানেন না আমাদের দেশেই এখন এ ধরণের রোগের উন্নত চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হচ্ছে।
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, জানুয়ারী ০২, ২০১০
Leave a Reply