শিশু স্বাস্থ্য
সমস্যা-৩
প্রখ্যাত শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ জাতীয় অধ্যাপক এম আর খান শিশুদের বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা, খাদ্য, পুষ্টি সমস্যাসহ নানা বিষয়ে ইত্তেফাকের স্বাস্থ্য পাতায় নিয়মিত লিখবেন। এ সংখ্যায় লিখেছেন শিশুর রোগ প্রতিরোধে টিকা নিয়ে।
সময়মত টিকা দিয়ে আপনি আপনার শিশুকে বেশ কয়েকটি জীবনঘাতি সংক্রামক রোগ থেকে বাঁচাতে পারেন। মনে রাখবেন: রোগ-প্রতিরোধ নিরাময় থেকে উত্তমতর।
সংক্রামক রোগ
যক্ষ্মা : রোগীর হাঁচি, কাশির সঙ্গে যক্ষ্মা-জীবাণু বের হয়ে বাতাস এবং ধূলোবালির সঙ্গে মিশে তা সুস্থ লোকের নি:শ্বাসের সাথে শরীরে প্রবেশ করে, এবং কালক্রমে যক্ষ্মা রোগের সৃষ্টি করতে পারে। আগে এ-রকম ধারণা ছিল যে, যার হয় যক্ষ্মা তার নাই রক্ষা। এখন একথা আর সত্য নয়। রোগ ধরে উপযুক্ত সময়ে উপযুক্ত চিকিৎসা দিলে এ-রোগ পূর্ণ নিরাময় হয়। যক্ষ্মা রোগীদের জ্বর হয়, ঘুসঘুসে জ্বর, বিকালের দিকে বাড়ে, ঘাম হয়। কাশি থাকে, মাঝে মাঝে কাশির সঙ্গে রক্ত উঠে। শরীর খুব দুর্বল এবং ফ্যাকাশে হয়ে যায়। ওজন ক্রমশ: কমতে থাকে। স্ট্রেপটোমাইসিন বা ইথামবিউটল, রিফাম্পিসিন এবং আই-এন-এইচ ইত্যাদি ওষুধ দিয়ে যক্ষ্মারোগীর চিকিৎসা করা হয়। ডাক্তারের পরামর্শ মত ওষুধ এক নাগাড়ে ৯ মাস খেতে হয়।
ডিপথেরিয়া: মারাত্মক রোগ। রোগীর হাঁচি, কাশির সঙ্গে বেরিয়ে এই রোগের জীবাণু শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে সুস্থ লোকের শরীরে ঢোকে রোগ সৃষ্টি করে। শিশুদের এই রোগ বেশী হয়। গলায়, স্বরযন্ত্রে এবং নাকে ডিপথেরিয়া হতে পারে। গলায় ডিপথেরিয়ার সংক্রমণ বেশী হলেও স্বরযন্ত্রের ডিপথেরিয়াই মারাত্মক এবং জীবনঘাতি। এদের গলাব্যথা, জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্ট, কিংবা শ্বাসের সঙ্গে শোঁ শোঁ শব্দ এসমস- সমস্যা হয়। কারো-কারোর গলা ফোলে যায়। গলা পরীক্ষা করলে ডিপথেরিয়ার সাধাটে পর্দা দেখা যায়। সাধারণভাবে শিরায় এডিএস (৪০,০০০-১২০,০০০ ইউনিট) এবং পেনিসিলিন দিয়ে এদের চিকিৎসা করা হয়। তবে সব জায়গায় এই রোগের চিকিৎসা সম্ভব নয়। এই রোগ সনাক্ত করার পর পরই সংক্রামক রোগের হাসপাতালে উপযুক্ত চিকিৎসার জন্য রোগীকে পাঠিয়ে দেয়া দরকার। হাসপাতালে নেয়া সম্ভব না হলে রোগীকে-গলায় যতদিন পর্দা থাকে ততদিন-আলাদা করে রাখতে হয়।
হুপিং কাশি: এই রোগও হাঁচি কাশির মাধ্যমে ছড়ায়। এই রোগ প্রতিরোধ সম্ভব; কিন্তু একবার আক্রান- হলে রোগীকে প্রায় ৩ মাস পর্যন- ভুগতে হয়। রোগের প্রাথমিক অবস্থায় সামান্য সর্দি, জ্বর, কাশি হয়; সপ্তাহদিন পর আসল কাশি শুরু হয়। দিনে-রাতে অসংখ্যবার কাশি হতে পারে; একবার কাশি শুরু হলে রোগী অনেকক্ষণ অনবরত কাশে, কাশতে কাশতে চোখ-মুখ লাল হয়ে যায়, চোখে রক্ত জমে যেতে পারে এবং প্রশ্বাসের শেষে হু-উ-প করে শব্দ হয়, কেউ কেউ বা বমি করে ফেলে। এই রোগের চিকিৎসায় ইরিথ্রোমাইসিন, ক্লোরামফেনিকোল, এমপিসিলিন এবং ফেনোবারবিটোন ওষুধ ব্যবহার করা হয়।
ধনুষ্টংকার: যে কোন বয়সে এই রোগ হতে পারে। নবজাতক শিশুদের এই রোগ বেশী হয় এবং অনেক ক্ষেত্রেই মৃত্যুর কারণ হয়ে থাকে। জন্মের পর শিশুর নাভি-সংক্রমণ থেকে, অথবা অন্যদের আঘাত-প্রাপ্তির ফলশ্রুতি হিসাবে এই রোগ হতে পারে। ধনুষ্টংকার হলে রোগী হা করতে পারে না (লক জ), শিশু মায়ের বুকের দুধ টেনে খেতে পারে না, খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দেয়। সমস- শরীর শক্ত হয়ে ধনুকের মত বেঁকে যায়। খিচুনি হয়। কিন্তু সজ্ঞান থাকে। মুখের আদল পাল্টে যায়, এটাকে কেউ কেউ শয়তানের হাসি বলে অভিহিত করে। এই রোগ হলে রোগীকে আলাদা অন্ধকার নি:শব্দ ঘরে রেখে চিকিৎসা করা হয়। টিটেনাস ইম্যুনোগ্লবিউলিন ৩,০০০-৬,০০০ ইউনিট মাংসে, অথবা এটিএস ৫০,০০০-১০০,০০০ ইউনিট (অর্ধেক মাংসে, অর্ধেক শিরায়), পেনিসিলিন এবং ডায়াজিপাম বা ক্লোরপ্রমাজিন ইত্যাদি ওষুধ এই রোগের চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়। মুখে খেতে না পারলে নাকে নল দিয়ে খাবার দেয়া হয়। এই রোগের প্রতিরোধ অত্যন- জরুরী। গর্ভবতী মাকে টিটি ইনজেকশন দেয়া ছাড়াও কতিপয় স্বাস্থ্যকর ব্যবস্থা এই রোগের প্রকোপ অনেক কমাতে পারে। শিশুর প্রসবের সময় ডাক্তারের বা স্বাস্থ্যকর্মীর পরামর্শ নিতে হবে। নবজাতকের নাভি পরিষ্কার জীবাণুমুক্ত ব্লেড, ছুরি, বা কাঁচি দিয়ে কাটতে হবে, কাটার আগে এগুলো (ব্লেড এবং নাভি বাঁধার সুতা ইত্যাদি) পানিতে আধ ঘন্টা ফুটিয়ে নিতে হবে। পুরানো ব্লেড, বাঁশের ছাল ইত্যাদি দিয়ে নাভি কাটা উচিৎ নয়, কিংবা নাভিতে গোবর, ছাই ইত্যাদি কোন সময়ই লাগানো ঠিক নয়।
পলিওপক্ষাঘাত বা পলিওমাইলাইটিস: পলিওমাইলাইটিস একটি মারাত্মক সংক্রামক রোগ। এই রোগের কারণে একবার পক্ষাঘাত হয়ে গেলে এর নিরাময়ী চিকিৎসা দেয়া যায় না। পক্ষাঘাতগ্রস্থ রোগী পরিবারের জন্য, সমাজের জন্য একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। আশার কথা এই যে, এই রোগের ফলপ্রসু টিকা রয়েছে, শিশুকে সময় মত টিকা দিলে পলিওপক্ষাঘাতের হাত থেকে তাকে বাঁচানো যায়। এই রোগের প্রাথমিক অবস্থায় সামান্য জ্বর হয়, এবং সর্বাঙ্গে ব্যথা হতে পারে, ঘাড়ও শক্ত থাকতে পারে; এর কয়েকদিন পরই রোগীর হাত, পা বা উভয়ই অবশ হয়ে আসে, রোগী পক্ষাঘাতগ্রস্থ হয়-সামঞ্জস্যহীনভাবে ১ হাত বা ১ পা বা ঘাড় এভাবে প্যারালাইসিস হয়। এই রোগের চিকিৎসায় গরম সেঁক এবং বিভিন্ন শারীরিক সম্পর্কে উপদেশ দেয়া হয়।
হাম বা মিজল্স্: যক্ষ্মা বা হুপিংকাশির মত এই রোগ ও রোগীর হাঁচি, কাশির মাধ্যমে বিস-ার লাভ করে। একবার এই রোগ হলে সাধারণত: দ্বিতীয়বার আর হয় না। রোগের প্রাথমিক অবস্থায় খুব জ্বর, সর্দি, কাশি হয়। এসময় মুখের ভেতরের শ্লৈষ্মক ঝিল্লিতে সাদাটে ধরনের দানা উঠে, এর চারদিকটা লাল হয়ে থাকে (কপলিকস স্পট)। এর কয়েক দিন পর গায়ে লাল লাল দানা ওঠে, প্রথমে কানের পেছনে এবং কপালে, এরপর সারা শরীরে, পরে পায়ে। ৫/৬ দিন পর এই দানাগুলি শুকিয়ে কালো হয়ে যায়। হাম নিজে খুব মারাত্মক রোগ নয়, তবে এই রোগ হলে প্রায়:শই প্রাণঘাতি জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে (নিউমোনিয়া, এনকেফালাইটিস, যক্ষ্মা, অপুষ্টি)-এ ব্যাপারে তীক্ষ্ম নজর রাখতে হবে। রোগীকে আলাদা ঘরে রেখে চিকিৎসা শুরু করা উচিৎ। যেহেতু এই রোগ সংক্রামক রোগ, সেহেতু ছোট ছেলে-মেয়েদের রোগীর কাছাকাছি আসতে বারণ করতে হবে। রোগীর খাবার-দাবারের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে, যেন এরা নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার খায়, সে ব্যাপারে যত্ন নিতে হবে। প্রয়োজনবোধে এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করতে হবে।
অধ্যাপক ডা. এম আর খান
জাতীয় অধ্যাপক এবং প্রখ্যাত শিশু বিশেষজ্ঞ
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, জানুয়ারী ০২, ২০১০
Leave a Reply