আমার নাম হেপাটাইটিস সি ভাইরাস। আমি অতি ক্ষুদ্র জীবাণু, একটি আর এন, এ ভাইরাস। আমি অনাদি অনন্ত কাল থেকে মানুষের দেহে বসবাস করে আসছি এবং হেপাটাইটিস সি ভাইরাস জনিত লিভারে রোগ সৃষ্টি করছি। অনাদি কাল থেকে আমি শান্তিতেই ছিলাম। মানুষের দেহে বিশেষ করে লিভারের মধ্যে আমার বসবাস। মানুষের দেহে সর্বাঙ্গে আমি আক্রমণ চালাতে পারি। তবে দেহের লিভার যন্ত্রটি আমার খুবই প্রিয় বাসস্থান। আমার নাম দীর্ঘকাল ধরে মানুষের নিকট অজ্ঞাত ছিল। আমার পরিচয় ছিলনা বলে ১৯৮৯ সালের আগ পর্যন্ত আমাকে ডাকত নন এ নন বি ভাইরাস হিসাবে।
কিন্তু মানুষের চেষ্টার কোন সীমা নাই। দীর্ঘদিন চেষ্টা প্রচেষ্টার পর মাত্র কয়েক বছর আগে মানুষের যন্ত্রের জালে আমি ধরা পড়ে যাই। আমেরিকার কিরন কর্পোরেশন আমাকে ধরে ফেলে। তাদের জালে আটকা পড়ার পর আমার নামকরন করা হয় হেপাটাইটিস সি ভাইরাস।
আমি মানুষের কোষের ভিতরে বাস করি। আমার আয়তন মাত্র ৫০ ন্যানোমিটার। আমাকে সাধারণ মাইক্রোসকোপ দিয়েও দেখা যায় না, খালি চোখে তো দেখার প্রশ্নই ওঠে না। কেবল মাত্র ইলেকট্রন মাইক্রোসকোপ দিয়ে আমাকে দেখা যায়। আমি একজন সিঙ্গেল স্ট্র্যান্ডেড আর এন এ ভাইরাস। আমার আকার ছোট হলে কি হবে মানুষের ক্ষতি করতে আমার জুড়ি নেই। আমি কিভাবে মানুষকে আক্রমণ করি তা জানলে আপনারা যদিও সাবধান হয়ে যাবেন তবুও বলেই ফেলি। আমি প্রধানতঃ সংক্রমিত রক্তের মাধ্যমে অন্য মানুষের শরীরে প্রবেশ করি। বহু ব্যবহৃত সংক্রমিত ইনজেশনের সুঁচ, বিভিন্ন অপারেশনের এবং দাঁতের চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করা যন্ত্রপাতি, অনিরাপদ অনৈতিক শারীরিক সম্পর্ক, সেলুনের ক্ষুর, কাঁচি, ইত্যাদি আমি আমার নিজের বিস্তারের জন্য ব্যবহার করে থাকি। তবে দুঃখের বিষয়, খাবার ও পানির মাধ্যমে আমি মানুষকে কাবু করতে পারি না। পাকস্থলীর এসিড আমার শক্র, ওটা আমাকে ধ্বংশ করে দেয়। তাছাড়া মায়ের বুকের দুধের মাধ্যমেও শিশুর শরীরে বংশ বিস্তারের সুযোগ করতে পারিনা।
মানুষের শরীরে যে ভাবেই প্রবেশ করিনা কেন, সংগে সংগেই কিন্তু রোগের লক্ষন প্রকাশ করাতে পারিনা। ১৫-১৫০ দিন পার করে তারপর নিজেকে মেলে ধরার চেষ্টা করি। একবার মানুষের শরীরে ঢুকলে আমাকে বের করা অত সহজ নয়। লোকে বলে আমার স্বভাব চরিত্র নাকি খুবই খারাপ। আমি নাকি নীরব ঘাতক।
আমি বহুরূপী, বেঁচে থাকার জন্য আমি সাধ্যাতীত চেষ্টা চালাই। শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা দিয়ে আমার বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরী হয় বটে, কিন্তু আমার এ বহুরূপী চরিত্রের কারনে আমি নিজেকে বদলে ফেলি। এবার আমাকে পায় কে। আমার বিরুদ্ধে তৈরীকরা প্রতিরোধক টিকাও তাই ব্যার্থ হয়েছে।
পৃথিবীতে আমি অন-ত সাড়ে সাত কোটি মানুষের দেহে বসবাস করছি। আমি মানুষের লিভারকে আমার আগুনে পুড়ে পুড়ে ছাই করি। তাদের লিভারকে তিলে তিলে ধ্বংশ করি। মানব দেহে প্রবেশের পর শতকরা ৮৫-৯০ ভাগ মানুষের শরীরেই দীর্ঘমেয়াদি রোগ ক্রনিক হেপাটাইটিস সি রূপে আমার কার্যক্রম চালিয়ে যাই। আমার দীর্ঘমেয়াদি সফলতা আসে মূলত ১২-২০ বছর পর। যদিও সময় লাগে অনেক, কেউ জানতেই পারে না যে আমি ঠিকই দীর্ঘসময় লিভারে প্রদাহ করে যাচ্ছি। তাই আমাকে অনেকে বলে আমার আগুন তুষের আগুন। আঙ্গুল দিলে পুড়ে যায়, দেখা যায় না।
আমার আগুনে যখন লিভার জ্বলতে থাকে। তখনও মানুষ বুঝতে পারে না, কি অসুখ হয়েছে তার। অথচ এরই মধ্যে আমি শতকরা ২০ ভাগ মানুষের লিভারে সিরোসিস ঘটিয়ে দিয়েছি।
আমি আস্তে আস্তে মানুষের শরীরকে দুর্বল করে দেই। শরীর থাকে ক্লান্ত পরিশ্র্নত, আস্তে আস্তে শরীর ভেঙ্গে যায়, ক্ষুধা মন্দা হয়, হজমে গন্ডগোল হয়, ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। এক সময় জন্ডিস দেখা দেয়, এমনকি পায়ে এবং পেটে পানিও আসতে পারে। এমনটি যখন হয়, তখন আমার আনন্দের সীমা থাকে না। কারণ তখন আমি তার লিভারে বংশ বৃদ্ধি করে চলেছি। আমাকে আর তাড়ায় কে! আমি তখন সাকসেসফুল্লি কার্য সমাধা করে মানুষের লিভারে সিরোসিসের জন্ম দিই।
এতেই আমি শান্ত হইনা। এই অবস্থা চলতে থাকলে আমার আক্রমণে মানুষ লিভারের ক্যান্সারে আক্র্নত হতে পারে। যার হার বছরে শতকরা ১-৪ ভাগ পর্যন্ত।
এতক্ষন তো বললাম আমার সুখের কথা, এবার আমার দুঃখের কথা শুনবেন কি? আমার দুঃখ রাখার জায়গা নেই। এ দুঃখ আর হতাশার পাল্লা দিন কে দিন ভারি হচ্ছে। যদিও এসব বলে ক্ষতি ছাড়া লাভ নাই তবুও বলি।
মানুষ আজকাল বড়ই চতুর আর সচেতন হয়ে গেছে। আমাকে মারার জন্য এরা উঠে পড়ে লেগেছে। আমার অস্তিত্ব বিলীন করার জন্য রিবাভিরিন এবং অত্যন্ত ব্যয়বহুল ইন্টারফেরন দিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে। ভাবুনতো কি সাংঘাতিক ব্যাপার। আমার উপস্থিতি এবং কার্যক্রম ধরে ফেলার জন্য বিভিন্ন রকম পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে। আমার সংক্রমণের পথ রুদ্ধ করে দিচ্ছে। কারণ পরিষ্কার সুঁই আর বিশুদ্ধ রক্ত ব্যবহার করার ফলে মানুষের শরীরে ঢুকতে পারি না।
তবে আমার গতিপথে বাধা দেয়ার ক্ষমতা মানুষ পরিপূর্ণ ভাবে অর্জন করে নেই। যেমন, আমি নাপিতের ক্ষুর, খতনা, টাট্টু, ডেন্টাল প্রসিডিউর, অনৈতিক পরস্পর শারীরিক সম্পর্ক এর মাধ্যমে এখনও বিস্তারের সুযোগ পাই।
এখন পৃথিবীর বুকে শতকরা ০.৩-৫ ভাগ মানুষের দেহে আমার শিকড় বিস্তার করে আছি। চারিদিকে আমার বিরুদ্ধে যেভাবে প্রচার প্রপাগান্ডা শুরু হয়েছে তাতে আবার অস্তিত্বই বিলীন হওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে। সামনে মনে হচ্ছে সমূহ বিপদ। কি আর করা, সবই আমার কপাল। আজ তা হলে আসি, আবার দেখা হবে কি?
অধ্যাপক লিভার বিভাগ,
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
শাহবাগ, ঢাকা, বাংলাদেশ
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, ডিসেম্বর ২৬, ২০০৯
Leave a Reply