তেমন কিছু দরকার নেই। কাপড় মাপার জন্য দর্জি যে টেপ ব্যবহার করেন, তেমন একটি টেপ। কোমরের বেড় মেপে নিন। কোমরের মাপ বলে দেবে স্বাস্থ্যের অবস্থা। বাথরুম-স্কেলের মাপের চেয়েও বেশি গুরুত্ববহ। বেশি সঠিক নির্দেশক।
গবেষণায় দেখা গেছে, যাদের কোমরের মাপ বড়, তাদের রয়েছে হূদরোগ, ক্যানসার, ডায়াবেটিস, চিত্তভ্রংশ রোগের বড় ঝুঁকি।
২০০৯ সালের এপ্রিলে হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের গবেষকেরা ৪৪ হাজার সেবিকার ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর প্রকাশ করলেন, স্বাভাবিক ওজন রয়েছে এমন সেবিকা, তাদেরও হূদরোগ ও ক্যানসারে মৃত্যুর ঝুঁকি দ্বিগুণ হয়, যদি তাদের কোমরের বেড় বেশি হয়। অন্যান্য গবেষণায় পুরুষদের ক্ষেত্রেও তেমন ঝুঁকি দেখা যায়।
কোমরের মাপকে স্বাস্থ্যের নির্দেশক হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে কয়েক বছর ধরে। তবু অনেক চিকিত্সক রোগীর দেহের ওজনকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন এবং তাদের বডি মাস ইনডেক্স (বিএমআই) বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। বিএমআই হচ্ছে দেহের উচ্চতার সঙ্গে দেহের তুলনামূলক ওজনের পরিমাপ। তবে স্ত্রী-পুরুষের ওপর নানা গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, দেহের মোট ওজনের চেয়ে শরীরের কোন স্থান ভার হয়েছে বা বেশি ওজন হয়েছে, স্বাস্থ্যের বিবেচনায় তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
মার্চ মাসে জর্নাল অব ক্লিনিক্যাল এপিডেমিওলজিতে প্রকাশিত এক বিশ্লেষণে দেখা যায়, হূদ্বাহ স্বাস্থ্যের সবচেয়ে দুর্বল নির্দেশক হলো বিএমআই এবং নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রে যাদের উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস বা উঁচু মানের কোলেস্টেরল হওয়ার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি, এর ভালো সূচক হলো ‘কোমরের মাপ’।
গবেষণায় দেখা গেছে, একজন নারীর কোমরের মাপ ৩১.৫ ইঞ্চিতে উপনীত হলে স্বাস্থ্যঝুঁকিগুলো বাড়তে থাকে এবং কোমর ৩৫ ইঞ্চি বা এর বেশি হলে ঝুঁকি খুব বেড়ে যায়। পুরুষের ক্ষেত্রে কোমর ৩৭ ইঞ্চি হলে ঝুঁকি বাড়তে থাকে আর ৪০ ইঞ্চি বা এর বেশি হলে ঝুঁকি খুব বেড়ে যায়।
তবে এসব পরিমাপ নেহাতই গড় মান এবং দীর্ঘদেহ বা খর্বকায় লোকের জন্য তত উপযোগী নাও হতে পারে। শিশু বা অন্যান্য আদিবাসী গোত্রে কোমরের মাপ বড় সূচক নাও হতে পারে। যেমন জাপানিদের ক্ষেত্রে পুরুষের কোমর ৩৩.৫ ইঞ্চি হলে ঝুঁকির শুরু। তবে জাপানি মেয়েদের জন্য কোমর ৩৫.৫ ইঞ্চি না হওয়া পর্যন্ত ঝুঁকি তেমন বাড়ে না। ২০০৯ সালের এপ্রিলে ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব ওবেসিটিতে প্রকাশিত নিবন্ধে বলা হয়েছে, বিশেষ করে তরুণদের ক্ষেত্রে সার্বিক স্বাস্থ্যঝুঁকি বিবেচনার জন্য কোমর আর উচ্চতার অনুপাত আরও ভালো নির্দেশক।
সহজভাবে বলা যায়, কোমরের মাপ হওয়া উচিত দৈহিক উচ্চতার অর্ধেকেরও কম। তবে কোমর ভারী হলেই সব সময় অস্বাস্থ্য, তাও বলা যায় না। একটি বড় উদাহরণ হলো, জাপানি সুমো কুস্তিগির। তার প্রকাণ্ড আয়তন থাকা সত্ত্বেও একজন ক্ষীণতনু অ্যাথলেটের হূত্স্বাস্থ্যের মতো সজীব হূত্স্বাস্থ্য অর্জন করে থাকতে পারে। সুমো কুস্তিগিরদের মেদ জমা হয় ত্বকের ঠিক নিচে, এই মেদভান্ডার ক্ষতিকারক নয়, শরীরের অন্তর্যন্ত্রের চারধারে যে মেদ, তা-ই হয় দেহ ও স্বাস্থ্যের ক্ষতির কারণ।
তবু বেশির ভাগ লোকের ক্ষেত্রে কোমরের মাপ গুরুত্বপূর্ণ। আলবাটস বিশ্ববিদ্যালয়ের ওবেসিটি রিসার্চ ও ম্যানেজমেন্টের চেয়ারম্যান আর্য এম শর্মা বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে আমরা জেনে আসছি, যাদের উদরের অভ্যন্তরে রয়েছে মেদের ভান্ডার, তাদের ডায়াবেটিস ও হূদরোগের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। যাঁরা সুমো কুস্তিগির নন, তাঁদের জন্য এই নির্দেশক খুব গুরুত্বপূর্ণ।
কোমর ভারী হলে বোঝা যায়, হূিপণ্ড, যকৃত্ ও সাধারণ পেশির চারধারে মেদ জমার আশঙ্কা এবং এতে এ সংকেত পাওয়া যায়, অন্যান্য স্বাস্থ্য-সমস্যা—যেমন ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স ও উঁচু মানের কোলেস্টেরল ও ট্রাইগ্লিসারাইড মান পরীক্ষা করা প্রয়োজন।
সামান্য কিছু ওজনও শরীর থেকে ঝরালে বড় সুফল পাওয়া যেতে পারে। ছোট একটি গবেষণায় দেখা যায়, ২০ জন খুব বেশি স্থূল রোগীকে কম ক্যালোরির খাবার দেওয়া হলো, এরা দেহের ওজনের ২০ শতাংশ ওজন হারাল। এতে তাদের ক্ষেত্রে বিএমআইয়ের ১৯ শতাংশ হ্রাস পেল, তবে কোমরের মাপ হ্রাস পেল ২৩ শতাংশ। ইমেজিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে দেখা গেল, হূিপণ্ডের চারপাশে মেদের স্তর ৩২ শতাংশ সংকুচিত হলো। এই প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে ২০০৯ সালের মে মাসে মেডিকেল জর্নাল অব ওবেসিটিতে।
পেটের ভেতর মেদের সঙ্গে সম্পর্কিত স্ট্রেস হরমোন। একটি গবেষণায় ১৮-২৫ বছর বয়সী ৬৭ জন মহিলা, যাঁদের কথন পরীক্ষা ও গণিত পরীক্ষার মুখোমুখি করা হলো, তাদের স্ট্রেস কী পরিমাণ হলো, তা মাপার জন্য রক্ত ও লালা পরীক্ষা করা হলো। যেসব মহিলার স্ট্রেস সবচেয়ে বেশি হলো, তাদের কোমর বেশি ভারী পাওয়া গেল; যাদের স্ট্রেস তেমন হয়নি, তাদের তুলনায়। এই প্রতিবেদনটিও প্রকাশিত হয়েছে ২০০৯ সালের মার্চে ইন্টারন্যাশনাল জর্নাল অব ওবেসিটিতে।
চিকিত্সকেরা বলেন, খাদ্যবিধি মেনে ও ব্যায়াম করে কোমর সংকুচিত করা সম্ভব। অনেকেই এতে সফল হতে সক্ষম হয় না। ডা. শর্মার মতে, কোমর ভারী হলে প্রথম লক্ষ্য হলো ওজন যাতে আর না বাড়ে সেদিকে নজর রাখা এবং কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া। ব্যায়াম ও খাদ্যের গুণগত মান ঠিক করলে হূদরোগ ও অন্যান্য সমস্যার ঝুঁকি কমানো যায়, ওজন হ্রাসে তেমন সমর্থ না হলেও তা কিছুটা সম্ভব।
ডা. শর্মা বলেন, অবশ্য কেবল ওজন নিয়ে বেশি উত্কণ্ঠিত না হয়ে স্বাস্থ্য রক্ষাই মুখ্য হওয়া উচিত। স্থূলতা মোকাবিলা মানে দেহের ওজন কমানোই কেবল নয়, স্বাস্থ্য উন্নত করাই হলো বড় কথা।
অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরীর কলম থেকে
পরিচালক, ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস, বারডেম হাসপাতাল, সাম্মানিক অধ্যাপক
ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ, ঢাকা।
Leave a Reply