পরিচিত দৃশ্য: সেই সাতসকালে ওঠা মায়ের। শিশুকে স্কুলে পাঠাতে হবে। সবকিছু তৈরি করে দিতে হবে। স্কুলব্যাগ, পানীয় জল, টিফিন, জুতা-মোজা, পোশাক-আশাক।
যাওয়ার সময় বাছা কিছুই খায়নি, অথবা এত তাড়াহুড়ো যে মুখে খাবার তুলে দেওয়ার সময়ও মেলেনি।
অথচ মা কত না যত্নে মনের মাধুরী মেশানো হাতে টিফিন-বক্সে খাবার সাজিয়ে দিয়েছেন! স্কুল ছুটির পর দেখা গেল, শিশু ওই খাবারের কণামাত্রও খায়নি। বরং ঘরে এসে রান্নাঘরে খাবার খুঁজে বেড়াচ্ছে; বা কোনো দিন তথ্যসূত্রে জানা গেল, জনপ্রিয় ব্যক্তিদের মতো সে তার টিফিনের খাবার ছোট বন্ধুদের মধ্যে বিলিয়ে দিয়েছে।
শিশুবিশেষজ্ঞরা যা বলেন
শিশুবিশেষজ্ঞ, পুষ্টিবিজ্ঞানী কিংবা স্বাস্থ্যবিজ্ঞানীরা বলেন—কে বলেছে একই সঙ্গে খাবার স্বাস্থ্যকর ও সুস্বাদু করা যায় না? অবশ্যই তা সম্ভব। শিশুর জিব তা-ই চায়। প্রতিদিন সেই একই রকমের খাবার। একঘেয়েমি। বড়দেরও অরুচি ধরে যায়। শিশুর জিব বেশি স্বাদ, বেশি বৈচিত্র্য সন্ধান করে—এ কথা মানতেই হবে। তবে তা কাজে লাগানোর জন্য মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো কোনো দুশ্চিন্তার দরকার নেই।
পরিবারে যেসব খাদ্যতালিকার প্রচলন, শুধু এর ব্যবহার করেই খাবারে স্বাদবৈচিত্র্য ধরে রাখা যায়। স্বাস্থ্যকর, আবার নতুন নতুন মজার। পরিমিতসংখ্যক খাবারসামগ্রী, কিন্তু পদ হতে পারে অসংখ্য, লোভনীয়। এমনকি শুধু শাকসবজির তালিকা থেকে নানা স্বাদের খাবার বেরিয়ে আসতে পারে।
রবীন্দ্রনাথ জানাচ্ছেন, ‘বাসনার সেরা স্থান রসনায়।’ শিশুরা যতটা না পেটুক, এর চেয়ে বেশি ভোজনরসিক। খাবার শুধু জিবের তৃপ্তি মেটানোর দায়িত্ব পালন করেই ক্ষান্ত থাকে না; দর্শন, ঘ্রাণেন্দ্রিয়ও উদ্দীপ্ত করে। পদগুলোর আকার-আকৃতি, স্বাদ, গন্ধ, বর্ণ শিশুকে মাতায়। মাশরুমের কথা ধরা যাক, স্বাদ তেমন নয়, কিন্তু দেখতে এত পেলব—জিবে জল আনে।
সুতরাং মা হিসেবে, অভিভাবক হিসেবে এটুকু স্বীকার করে নিতে হয়, একটু মাথা খাটিয়ে প্রতিদিনের খাবারের তালিকায় একটু শাকসবজির আইটেম একেক দিন বদলিয়ে একটু অন্যভাবে রান্না করা হলে টিফিন-বক্সে শিশু উঁকি দেবে। শিশুকে নাক সিটকাবে নয়—ধ্যাত্, এ তো একই স্যান্ডউইচ, বারগার! টিফিনের খাবার খেয়ে পরিতৃপ্ত হয়ে সে বাসায় ফিরবে। স্বাস্থ্যবান থাকবে, ভালোবাসায় সিক্ত হবে।
যেকোনো এক সপ্তাহের তালিকা:
শনিবার: বরাবরের সাদা রুটি নাহয় বাদ যাক। এর পরিবর্তে আনুন বাদামি পাউরুটি। যদি তাও প্রতিনিয়ত পছন্দ না করে, তাহলে পিঠা তৈরির কথা কি ভাবা যায়!
রোববার: যদি ঘরে তৈরি স্যুপ তাকে আকৃষ্ট করে, তবে ভালো তরকারির বদলে আজ তা-ই দেওয়া যায়। তবে বাজারের মোড়কজাত স্যুপ নয়, এসব স্বাস্থ্যকর বলে বিবেচনায় না রাখাই ভালো। পনিরের টোস্ট বানিয়ে দেওয়া যায়।
সোমবার: আজ দেওয়া যেতে পারে ফল দিয়ে তৈরি সালাদ। তরমুজ, পেঁপে, আপেলের টুকরো। আঙুর জোগানো হলে ফ্রুট সালাদ তাকে দারুণ মাতাবে।
মঙ্গলবার: প্রতিদিন একই পানীয় জল, আজ নাহয় তার পানীয় বোতলে লেবুজলের শরবত দেওয়া হোক। তার পছন্দের সবজি দিয়ে পদ তৈরি করা যায়, অথবা ঘিয়ে ভাজা পরোটা।
বুধবার: মাখন স্যান্ডউইচ, শস্যকণাসমৃদ্ধ সস।
বৃহস্পতিবার: নবীন অভিভাবকেরা চিন্তাশক্তি কাজে লাগিয়ে উদ্ভাবন করুন। ময়দা, আটা, পেস্তাবাদাম—যা ইচ্ছা উপাদান নিন।
যা জানা জরুরি
বাংলাদেশে বিদ্যালয়গামী শিশুরা আয়রনের ঘাটতিজনিত রক্তস্বল্পতা, দাঁতের ক্ষয়রোগ, গলগণ্ড, প্রোটিন-ক্যালরির ঘাটতিজনিত অপুষ্টি, ‘এ’ ভিটামিনের অভাবজনিত দৃষ্টিশক্তির সমস্যা প্রভৃতিতে জর্জরিত। স্বাস্থ্যকর টিফিন (হোক তা বাসায় তৈরি কিংবা ‘লাভ-লোকসান নেই’ রীতিতে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ থেকে বরাদ্দ করা) যদি এসব পুষ্টিমান নিশ্চিত করে, তবে শিশু স্বাস্থ্যবান থাকবে। বলা হয়, শিশুর দৈনিক চাহিদার এক-তৃতীয়াংশ ক্যালরি ও অর্ধেক পরিমাণ প্রোটিন টিফিনের মাধ্যমে শিশুকে জোগানো যায়।
প্রণব কুমার চৌধুরী
সহকারী অধ্যাপক, শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ডিসেম্বর ২৩, ২০০৯
Leave a Reply