বর্তমানে দেশে সফলভাবে কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল, কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতাল, বারডেম হাসপাতাল, কিডনি ইনস্টিটিউট হাসপাতাল, গুলশান ইউনাইটেড হাসপাতাল, এ্যাপোলো হাসপাতাল, আলমারকাজুল হাসপাতাল, রেনাল হাসপাতাল ও চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সফলভাবে কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট হচ্ছে। এছাড়া কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট পরবর্তী অতি প্রয়োজনীয় সাইক্লোস্ফোরিন ওষুধও বাংলাদেশে তৈরি হচ্ছে। ফলে কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট ব্যয় অনেক কম। বিদেশে একটি কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট ব্যয় ৪ লাখ টাকা থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত। অথচ বাংলাদেশে মাত্র ১ লক্ষ টাকা ব্যয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের ইউরোলজি বিভাগে কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করা হচ্ছে। এ ছাড়া কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতালেও কম খরচে কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করা হয়। কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট নিয়ে আজকের এই নিবন্ধটি রচনা করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউরোলজি বিভাগের সহকারি অধ্যাপক ডা: মুহম্মদ হোসেন।
মানুষের শরীরে রক্ত পরিশোধনের জন্য
দুটি অঙ্গ আছে। এই অঙ্গ দুটি ছাকনীর মত কাজ করে। এই অঙ্গ দুইটির নাম কিডনি। রক্ত থেকে ইউরিয়া, ক্রিয়োটিনিন সহ দুষিত পদার্থ বের করে দেয়া, শরীরে লবণ ও পানির ভারসাম্য রক্ষা করা ও রক্ত তৈরি ও ভিটামিন ডি কে কার্যকর উপাদানে পরিণত করা মুলত: কিডনির কাজ। গলায় টনসিলের প্রদাহ, ইনফেকশন, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ওষুধের ক্ষতিকর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া প্রভৃতি কারণে কিডনি ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে। সাধারণত কিডনি যখন ধীর গতিতে নষ্ট হতে থাকে তখন এর নষ্ট হওয়ার প্রক্রিয়াকে একেবারে থামান যায়না তবে শ্লথ করা যায়। অন্যদিকে ডায়ারিয়া, অতিরিক্ত রক্তচাপ, বিভিন্ন কারণে দীর্ঘক্ষণ অতি নিম্ন রক্তচাপ, ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া মারাত্মক ইনফেকশন প্রভৃতি কারণে আকস্মিক কিডনি বিকল হতে পারে যা যতাযথ চিকিৎসার মাধ্যমে আরোগ্য লাভ করে। কিডনির কার্যক্ষমতা ধীরে ধীরে কমতে কমতে যখন অসহনীয় পর্যায়ে চলে আসে তখন রোগীকে রেনাল রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি বা কিডনির প্রতিস্থাপক চিকিৎসা প্রদানের প্রয়োজন হয়। রেনাল রিপ্লেসমেন্ট থেরাপির মধ্যে রয়েছে হিমোডায়ালাইসিস, পেরিটোনিয়াল ডায়ালাইসিস, কনটিনিয়াস এম্বুলেটরি পেরিটোনিয়াল ডায়ালাইসিস (সি.এ.পি.ডি) কন্টিনিয়াস সাইক্লিক এম্বুলেটরি পেরিটোলিয়াল ডায়ালাইসিস (সি.সি.পি.ডি) ও কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট, কিডনি ট্রান্সপ্লান্টের মধ্যে রয়েছে লাইফ রিলেটেড কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট ও ক্যাডাভারিক কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট। ক্যাডাভারিক কিডনি ট্রান্সপ্লান্টকে প্রচলিতভাবে বলা হয় মৃত মানুষের দেহ থেকে কিডনি সংগ্রহ করে তা কিডনি বিকল রোগীর দেহে কিন্তু ব্যবহারিক অর্থে তা সঠিক নয়। মূলত কিডনি সংগ্রহ করা হয় ব্রেইন ডেথ রোগীদের থেকে যিনি ইন্টেনসিভ কেয়ার ইউনিটে আছেন। যার শ্বাস-প্রশ্বাস কৃত্রিম উপায় চলছে, হৃদপিন্ড ক্রিয়াশীল এবং রক্তচাপ বজায় রাখা হচ্ছে। এ ধরণের রোগীদের ব্রেইনডেথ ঘোষনার জন্য নেফ্রোলজিষ্ট, নিউরোলজিষ্ট সম্মন্বয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের একটি টিম গঠন করা হয়। তারা বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত করেন যে এই রোগীর কখনই আর আরোগ্য লাভের সম্ভাবনা নেই এবং গুরুত্বপূর্ণ লাইফ সাপোর্ট মেশিন খুলে নিলে তিনি জীবন ধারণ করতে সক্ষম নন। এর পর ট্রান্সপ্লান্ট টিমকে খবর দেয়া হলে তারা আত্মীয় স্বজনদের সম্মতিতে কিডনি সংগ্রহ করে উপযুক্ত গ্রহিতার দেহে সংস্থাপন করেন। এই ধরণের ক্যাডাভারিক কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট অপারেশন সাফল্যজনক ভাবে সম্পন্ন করার জন্য ব্যাপক লজিস্টিক সাপোর্ট দরকার হয়। অদুর ভবিষ্যতে আমাদের দেশে এ ধরণের ট্রান্সপ্লান্ট অপারেশন চালু হবে বলে আমরা আশাবাদী।
বর্তমানে আমাদের দেশে লাইফ রিলেটেড কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট অপারেশন চালু আছে। আমাদের দেশে অঙ্গ সংস্থাপন আইন অনুযায়ী শুধুমাত্র নিকট আত্মীয় যেমন বাবা-মা, আপন ভাই-বোন, চাচা, মামা, খালা, ফুফু, স্বামী ও স্ত্রী এর মধ্যে একে অপরকে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে বিনিময় বিহীন কিডনি দান করতে পারেন। এই আত্মীয়তা সমপর্ক প্রমাণের জন্য বিভিন্ন ধরণের কাগজপত্র ছাড়াও ক্ষেত্র বিশেষে ডিএনএ, টেষ্টের প্রয়োজন হতে পারে। যে কোন ধরণের অনাত্মীয় এর নিকট থেকে কিডনি গ্রহণ কিংবা কিডনি কেনা বেচা আমাদের দেশের আইন অনুযায়ী সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ও শাস্তিমূলক অপরাধ। এক্ষেত্রে শাস্তি ৭ বছর সশ্রম কারাদন্ড ও তৎসহ আর্থিক জরিমানা। কিডনি ট্রান্সপ্লান্টের জন্য প্রাথমিকভাবে কিডনি দাতা ও গ্রহিতার রক্তের গ্রুপ, টিস্যু মেচিং ও টিস্যুক্রশম্যাচ প্রয়োজন হয়। এগুলো মিলে গেলে কিডনি দাতার শরীর থেকে একটি কিডনি অপসারণ করলে কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে কিনা তা বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চত করা হয়।
অপারেশনের পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে অপারেশনের আগের দিন রোগীকে ডায়ালাইসিস দেয়া হয়। এই দিন থেকে রোগীর শরীরে প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়ার জন্য এন্টিরিজেকশন ড্রাগ যথা সাইক্লোসপরিণ প্রয়োগ শুরু করা হয়। অপারেশনের আগে অপারেশনের দিন সহ পরপর তিন দিন রোগীকে বেটাডিন বাথ দেয়া হয়। অপারেশনের একদিন আগে অপারেশন কক্ষগুলো ফিউমিগেট করা হয়। ২৪ ঘন্টা পর অপারেশনের দিনে রুমগুলো খোলা হয়। এতকিছু করা হয় জীবাণুমুক্ত পরিবেশে অপারেশন করা ও ইনফেকশনের হার কমিয়ে আনার জন্য। দাতার দেহ থেকে কিডনি নেয়ার পর তা বরফশীতল পারফিউশন সলিউশন দিয়ে ধোয়া হয় ও কিডনিকে হিমশীতল করে ফেলা হয়। এ প্রক্রিয়ার ফলে শরীর থেকে অপসারিত কিডনির টিস্যু অপারেশনের পর পূন সংযোজন পর্যন- সময়ে বড় রকমের ক্ষতি প্রতিহত করে। এরপর রোগীর তলপেটে সাধারণত ডান দিকে কিডনি সংস্থাপন করা হয়। কিডনি সংস্থাপন করার পর কিডনি কাজ শুরু করলে দ্রুত তার শরীরের ইউরিয়া ক্রিয়েটিনিন কমে আসে। মনে রাখতে হবে সংস্থাপিত কিডনি কাজ করলেই তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ নন। তাকে নিয়মিত এন্টিরিজেশন ওষুধ খেতে হবে যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয় ফলে খাওয়া-দাওয়া, চলাফেরা সর্ব অবস্থায় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে নচেৎ তিনি মারাত্মক ইনফেকশনে আক্রান- হতে পারেন যাতে তার জীবনে সংশয় দেখা দিতে পারে, অথবা সংস্থাপিত কিডনি পুনরায় নষ্ট হতে পারে।
ট্রান্সপ্লান্ট রোগীদের জন্য
কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট, বোনম্যোরো ট্রান্সপ্লান্ট, বাত ব্যথা-এ নামগুলোর সাথে পরিচিত নন এমন মানুষের সংখ্যা আমাদের দেশে খুবই কম। ইদানিং এ নামগুলো আমরা প্রচুর পরিমাণে শুনি। বিশ্বে চিকিৎসা বিজ্ঞানে অভূতপূর্ব অগ্রগতির সাথে সাথে কিডনি রোগের চিকিৎসারও যথেষ্ঠ উন্নতি ঘটেছে। এখানে দুটি কিডনি অকেজো হয়ে গেলেও একজন মানুষ নিয়মিত ডায়ালাইসিস অথবা কিডনি সংযোজনের মাধ্যমে দীর্ঘদিন সুস্থ জীবন যাপন করতে পারে। কিন্তু ডায়ালাইসিসের ক্ষেত্রে যখন আনুষাঙ্গিক জটিলতা বেড়ে যায় এবং জীবন সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে তখন কিডনি সংযোজনই হচ্ছে এক্ষেত্রে প্রত্যাশিত চিকিৎসা। একটা সময় ছিল যখন কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট, বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট বা অন্যান্য অঙ্গ ট্রান্সপ্লান্ট এর জন্য রোগীদের যেতে হতো ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর অথবা পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে। সুখবর হচ্ছে বর্তমানে বাংলাদেশেই এই চিকিৎসা সম্ভব। এর ফলে রোগী এবং তার আত্মীয়স্বজনদের দুশ্চিন্তা অনেক কমে এসেছে। ট্রান্সপ্লান্টের পরবর্তী চিকিৎসকদের চিন্তার কারণ থাকে “গ্রাফট রিজেকশন” এর অর্থ হচ্ছে যে কিডনি, বোনম্যারো বা অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা হলো তা পরিত্যক্ত হবার সম্ভাবনা থাকে। এ দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য দরকার ‘ইমিনোসাপ্রেসেন্ট’ টাইপের ওষুধ। ইমিউনোসাপ্রেসিভ হিসেবে বিভিন্ন ধরনের ওষুধ ব্যবহার করা হয়। যেমন-ক্যালসিনিউরিন ইনহিবিটরের মধ্যে আছে সাইক্লোস্পোরিন; এন্টিপ্রোলিফারেটিভ এজেন্টের মধ্যে আছে অ্যাজাথাইয়োপ্রিন, মিথোট্রিক্সেট ইত্যাদি। রোগীকে ইমিনোসাপ্রেসেন্ট অনেক দিন ধরে খেতে হয়। দীর্ঘদিন ইমিনোসাপ্রেসেন্ট চালিয়ে যাবার জন্য রোগীর দেহে আবার ইনফেকশনের ভয় বেড়ে যায়। এই সব দিক বিবেচনা করে বর্তমানে চিকিৎসকেরা সমস- ইমিনোসাপ্রেসেন্টের মধ্যে থেকে ‘সাইক্লোস্পোরিন’-কে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করছেন। যে কোন ট্রান্সপ্লান্ট, জটিল ধরনের রিউমাটয়েড আর্থরাইটিস কিংবা সোরিয়াসিস- এ এখন ‘সাইক্লোস্পোরিন’ ব্যবহৃত হচ্ছে। এই ওষুধ আগে বিদেশ থেকে আমদানি করা হতো যা ছিল খুবই ব্যয়বহুল। যেহেতু এই ওষুধ দীর্ঘ দিন চালিয়ে যেতে হয় তাই এই দীর্ঘসময়ের জন্য ব্যয়বহুল ওষুধ কেনাটা ছিল অনেকেরই ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। আবার যেহেতু ওষুধটি আমদানিকৃত তাই দরকারমতো সবসময় হাতের কাছে পেতেও সমস্যা হতো। সুতরাং চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকলেও সাধ্য এবং সহজলভ্যতা তখন ছিল চিন্তার বিষয়।
‘সাইক্লোস্পোরিন’ টি-লিম্ফাসাইটের কাজ বন্ধ করে ইমিউনোসাপ্রেসেন্ট হিসেবে কাজ করে। প্রয়োজনমত সময়ে পর্যাপ্ত ‘সাইক্লোস্পোরিন’ খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং নিয়মিত ভাবে সঠিক পরিমাণ ওষুধ এর যথাযথ কার্যস্থানে পৌছানো দরকার। রোগীদের ক্ষেত্রে সাইক্লোস্পোরিনের ডোজ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
‘সাইক্লোস্পোরিন’ বিভিন্ন অঙ্গ প্রতিস্থাপন যেমন-কিডনি, লিভার, বোনম্যারো প্রতিস্থাপন এবং প্রতিস্থাপন ছাড়াও রিউমাইয়েড আর্থারাইটিস, সোরিয়াসিসে ব্যবহার করা যায়। সমপ্রতি ইনসেপ্টা ‘সাইক্লোস্পোরিন’ তৈরী করছে যা “স্পোরিয়াম” নামে পাওয়া যাচ্ছে।
ডোজ মিস হয়ে গেলে কি করবেন ?
যেহেতু রক্তে সাইক্লোস্পোরিনের পরিমাণ পুংখানুপুংখভাবে ঠিক রাখতে হয় তাই কোন ডোজ মিস হয়ে গেলে তাৎক্ষণিক চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। অনেকেই চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ ছাড়াই পরের ডোজের সাথে আগের ডোজটিও খেয়ে নেন। সাইক্লোস্পোরিনের ক্ষেত্রে এটা করা ঠিক হবে না। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোন ডোজ পরিবর্তন করা যাবে না। যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে যাতে কোন ডোজ মিস হয়ে না যায়।
ডাঃ নুসরাত বিনতে রাববানী
সূত্রঃ দৈনিক ইত্তেফাক, ডিসেম্বর ১৫, ২০০৯
Leave a Reply