আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যত্। এই ভবিষ্যত্ প্রজন্মকে সুস্থ, সুন্দর, সাবলীল স্বাস্থ্যে উন্নত রাখার জন্য গর্ভবতী ও প্রসূতি মায়ের যথোপযুক্ত যত্ন ও পরিচর্যা দরকার। এর জন্য প্রথমেই প্রয়োজন পরিবারের সবার মানসিকতার পরিবর্তন। মনে রাখতে হবে, একজন নারী তাঁর শরীরের মধ্যে ধারণ করছেন আরেকজন ক্ষুদ্রাকৃতির মানুষ। এই ক্ষুদ্রাকৃতির মানুষটি পেটের ভেতর বেড়ে ওঠার জন্য চাই পরিবেশবান্ধব অবস্থা—সেটা হবে খাদ্য, আলো, বাতাস, বিশ্রাম ও সময়মতো চিকিত্সকের পরামর্শ এবং সে অনুযায়ী পথ্য ও পরীক্ষা। পুরো গর্ভাবস্থাকে এ জন্য তিনটি সময়ে ভাগ করা হয়েছে:
প্রথম তিন মাস
প্রথম গর্ভধারণের লজ্জা, বমি বমি ভাব, এসিডিটি, কোষ্ঠকাঠিন্য ইত্যাদি তাঁকে অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। অথচ এই সময়ই বাচ্চার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো পূর্ণ রূপ লাভ করে (পিরিয়ড অব অরগানোজেনেসিস)। তাই মাকে এ সময় সহমর্মিতার পাশাপাশি বমি বেশি হলে বমিনাশক, অম্লনাশক, কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করার জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধের পাশাপাশি সবুজ শাকসবজি, ফলমূল ও অন্যান্য পুষ্টিকর খাবার দিতে হবে। এ সময় ছোট কয়েকটি পরীক্ষা—যেমন রক্তের হিমোগ্লোবিন, সুগার ও গ্রুপ করে রাখা উচিত। খুব বেশি প্রয়োজন না হলে আলট্রাসনোগ্রাম করার দরকার নেই।
দ্বিতীয় তিন মাস
যাঁদের মাসিক অনিয়মিত, তাঁদের তারিখ নিশ্চিত করার জন্য ১২-১৪ সপ্তাহে এবং যাঁদের কোনো বংশগত বা জন্মগত সমস্যা আছে, কিংবা হয়েছে কি না, তা দেখার জন্য ২০-২২ সপ্তাহে আলট্রাসনোগ্রাম করতে হবে। যেহেতু গর্ভস্থ শিশুর শরীর গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান মায়ের কাছ থেকেই আসে, তাই মায়ের প্রতিদিনের খাদ্য হতে হবে সুষম, যার মধ্যে মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, শাকসবজি, ফলমূল ও প্রচুর পানি থাকতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে দুপুরে অন্তত দুই ঘণ্টা ও রাতে অন্তত সাত ঘণ্টা বিশ্রাম দিতে হবে। আগে টিকা দেওয়া না থাকলে গর্ভাবস্থায় পাঁচ ও ছয় মাস শেষ হলে দুটি টিটি টিকা দিতে হবে। গর্ভস্থ শিশুর বাড়ন্ত গঠনের জন্য আয়রন, ভিটামিন ও ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট খেতে দিলে ভালো হয়।
তৃতীয় তিন মাস
এ সময় গর্ভের শিশু খুব দ্রুত বেড়ে ওঠে। মোট গর্ভকালীন মায়ের ১০-১২ কেজি ওজন বৃদ্ধির বেশির ভাগ এ সময় হয়। এ সময় অনেক গর্ভবতী মায়ের পায়ে পানি আসে। পেট বড় হওয়ার জন্য মৃদু শ্বাসকষ্ট, এসিডিটি কষ্ট, স্তন থেকে কিছু তরল পদার্থ নিঃসৃত হতে পারে। এগুলো গর্ভবতী মায়ের জন্য স্বাভাবিক ব্যাপার। তাঁকে এসব বুঝিয়ে বলতে হবে। নিয়মিত ওজন ও প্রেশার মাপা, জরায়ুর ফান্ডাল উচ্চতা মেপে দেখা (যত সপ্তাহ তত সেমি)। কোনো জটিলতা দেখা দিলে, যেমন অস্বাভাবিক পেট বড় বা ছোট হওয়া, হঠাত্ রক্তভাঙা, খুব বেশি জ্বর আসা, বেশি রক্তচাপ দেখা দেওয়া—এমন পরিস্থিতিতে তাড়াতাড়ি চিকিত্সক দেখাতে হবে।
অন্তত পাঁচবার গর্ভবতী মাকে চিকিত্সক দেখানো দরকার। প্রথম তিন মাসে একবার, ২৮ সপ্তাহে একবার, ৩৬ সপ্তাহে একবার এবং তারপর প্রতি সপ্তাহে একবার করে চিকিত্সকের কাছে যাওয়া উচিত। প্রসূতিকে অবশ্যই একজন চিকিত্সক বা নিদেনপক্ষে প্রশিক্ষিত ও দক্ষ দাই দিয়ে প্রসব করানো উচিত।
মাথা ছাড়া অন্য কোনো অঙ্গ প্রথম দেখা দিলে বা বের হয়ে আসতে চাইলে, প্রসবের সময় ১২ ঘণ্টার বেশি হলে, অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ হলে তাড়াতাড়ি তাঁকে হাসপাতালে নিতে হবে। প্রসবের পরের প্রথম দুই ঘণ্টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ সময় রক্তক্ষরণ, রক্তচাপ পরীক্ষা এবং ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত মাকে বিশ্রাম দিতে হবে। জন্মের পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শিশুকে মায়ের কাছে আনতে হবে এবং মায়ের দুধ (শালদুধ) খাওয়াতে হবে।
সাত দিন এবং ছয় সপ্তাহ পর তাঁকে আবার চিকিত্সকের কাছে আনতে হবে, যিনি তাঁকে বুকের দুধ খাওয়ানোর এবং অন্যান্য সাধারণ চেকআপ করা ছাড়াও জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারে অবহিত করবেন ও পরামর্শ দেবেন। আমাদের দেশে প্রতি লাখে ৩২০ জন নারী সন্তান ধারণজনিত জটিলতায় মারা যান। উন্নত জীবন যাপন, গর্ভ ও প্রসবকালীন যথোপযুক্ত যত্নের জন্য উন্নত বিশ্বে এই মৃত্যুর হার অনেক কম। তাই আসুন, আমরা সচেতন হই, মায়ের গর্ভকালীন নিরাপত্তা ও পুষ্টি নিশ্চিত করি। শিশু জন্মদানের জন্য তাঁকে সুন্দর নির্ভরশীল বিশ্বস্ত পরিবেশ দিই। দিই স্বাস্থ্যসম্মত খাবার, মনোরম পরিবেশ মা ও সদ্য-প্রসূত সন্তানের জন্য। কবি সুকান্তের ভাষায়, ‘এ বিশ্বকে শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এই আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।’
হামিদা বেগম
প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ডিসেম্বর ০৯, ২০০৯
Leave a Reply