অশোক পুষ্প-পল্লবে নিমগ্ন বসন্তের প্রকৃতি। গাছের ডাল ভরে উঠেছে নতুন পাতায়। পলাশ, শিমুল, অশোক আর পারিজাতের (মান্দার) রঙে ছেয়ে গেছে আকাশ। বাতাসে ভেসে বেড়ায় দোয়েল, কোকিল, বসন্তবাবুই আর বুলবুলির গান। ঝাপটা দিয়ে হু হু করে বয়ে যায় দখিনা বাতাস। এই তো সেদিন—শেষ রাতে ফেরার পথে দেখি ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের দুই পাশের গাছপালা থেকে ঝরে পড়ছে পুরোনো পাতা। বাতাসের দোলায় পাতাগুলো উড়ছিল রাস্তাজুড়ে। গাড়ির হেডলাইটের হলুদ আলোয় গাছের বিবর্ণ ডালে দেখা গেল নতুন পাতার বিচ্ছুরণ। শীতল হাওয়ায় এমন মনোময় দৃশ্য দেখে টের পেলাম—বসন্ত জাগ্রত দ্বারে…।
ফুল আর পাখির কারণে বসন্তের আছে রাজখ্যাতি। বসন্তের আবাহনে ফুলগুলোও যেন রূপ-লাবণ্যের পাপড়ি মেলে ধরেছে। ছড়িয়ে দিয়েছে সৌরভ। আগুনঝরা পলাশ জানান দিচ্ছে বসন্তের আগমনী বার্তা। থোকা থোকা ফুল যেন আগুন জ্বালিয়ে দেয় প্রকৃতিতে। এ কারণেই বুঝি একে ডাকা হয় অরণ্যের অগ্নিশিখা। রুদ্র পলাশের রক্তিম বর্ণচ্ছটাও পলাশের মতোই। আবহমান গ্রামবাংলায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে শিমুলের গাছ। আকাশে রঙের মেলায় শিমুল যেন ডেকে যায় মধুপায়ী পাখিদের। শ্বেত-শিমুলের ডালেও দেখা মেলে বুলবুলির নাচন।
অজস্র ফুলে সৌন্দর্যের ডালি সাজিয়ে রেখেছে অশোকের ডাল। কাঞ্চনের গন্ধ নেই, তবে দৃষ্টিনন্দন। এর আবার তিনটি জাত—দেবকাঞ্চন, রক্তকাঞ্চন ও শ্বেতকাঞ্চন। রক্তকাঞ্চন ফোটে বসন্তের শুরুতে। সিঁদুর বর্ণ নিয়ে বসন্তকে স্বাগত জানাচ্ছে পারিজাত। বসন্তকে আমন্ত্রণ জানিয়েই যেন শেষ হয়ে যায় মাধবী। ক্ষণস্থায়ী এর যৌবন। মাধবী দুষ্প্রাপ্য, আছে গানে আর বনে। সাদাটে ফুলের সুভাস ভেসে বেড়ায় বনময়। সুগন্ধে সারাক্ষণই মৌমাছি উড়ে বেড়ায় কনকচাঁপার গায়ে। নীলমণি লতায় যেন নীলের ছড়াছড়ি। বেগুনি মণিমালার অবারিত উচ্ছ্বাস সহজেই মন কেড়ে নেয় পথিকের। বসন্তের শেষ দিকে ফোটে হাপরমালি ও পানিফুল। রমনা নার্সারিতে গিয়ে দেখা গেল দুর্লভ সুরভির। ছবিতে সুবাস ধারণ করা গেলে পাঠক ছোট্ট সুরভি ফুলে পেতেন পাকা বেলের গন্ধ। পলাশ ও শিমুলের রং যখন ম্লান হয়ে যায়, তখন শুভ্রতার প্রস্ফুটনে বসন্ত যৌবনের ইতি টানে কুরচি।
বসন্তে আরও ফোটে মহুয়া, গ্লিরিসিডিয়া, আকরকাঁটা, গামারি, সজনা, উদাল, জিকা, কুসুম ও বকুলসহ নানা বনফুল। অন্যদিকে প্রকৃতি বিভোর হয়ে আছে লটকন, গোলাপ জামের ফুল আর আমের মঞ্জুরিতে। শহর, নগর, গ্রাম—সর্বত্রই আছে ফুলগুলো। নগর সংসদ ভবন, শেরেবাংলা নগর এলাকা, রমনা উদ্যান, বোটানিক্যাল গার্ডেন, কার্জন হল, চারুকলা অনুষদ, বলধা গার্ডেন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় এসব ফুল। ঝরা পাতার মর্মর ধ্বনি আর কোকিলের কুহু কুহু ডাক তো শোনা যাবেই।
সাহাদাত পারভেজ
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ০৯, ২০১১
Leave a Reply