১ ডিসেম্বর বিশ্ব এইডস দিবস – এইডস রোধ করুন, অঙ্গীকার রক্ষা করুন
এইডস (AIDS) শব্দের অর্থ অ্যাকিউরড ইমিউন ডেফিসিয়েন্সি সিনড্রোম। এইডস হলে রোগীর দেহে প্রতিরোধ ব্যবস্থা এত দুর্বল হয়ে যায় যে সাধারণ সংক্রমণের সঙ্গেও তা লড়াই করতে পারে না।
সেই ১৯৮০ সালের দিকে এইডস প্রথম শনাক্ত হয়েছিল। এর পর থেকে পৃথিবীজুড়ে অনেক অনেক মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হয়েছে।
এ রোগের পেছনে রয়েছে একটি ভাইরাস—হিউম্যান ইমিউন ডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস (এইচআইভি)। এখন পর্যন্ত যেসব তথ্য পাওয়া গেছে, তাতে দেখা যায়, সারা বিশ্বে এইচআইভি/এইডস সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা ৩৩ মিলিয়ন।
জাতিসংঘ এ রোগ মোকাবিলার জন্য বড় উদ্যোগ নিয়েছে। ইউএনএইডস এইচআইভি/এইডস সম্বন্ধে জাতিসংঘের যুগ্ম কর্মসূচি, জাতিসংঘ পরিবারের এই সম্মিলিত উদ্যোগের মাধ্যমে সারা বিশ্বে নতুন এইচআইভি সংক্রমণ, প্রতিরোধ, এইচআইভি সংক্রমিত মানুষের পরিচর্যা, এই মহামারির প্রভাবকে দমানোর মতো কাজে যথেষ্ট সহায়তা দিচ্ছে জাতিসংঘের ১০টি বিভিন্ন সংস্থা। ইউএনএইডসের সঙ্গে রয়েছে ইউএনএইচসিআর, ইউনিসেফ, ডব্লিউএফপি, ইউএনডিপি, ইউএনএফপিএ, ইউএনওডিসি, আইএলও, ইউনেসকো, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বিশ্বব্যাংক।
বিজ্ঞানের এত অগ্রগতি সত্ত্বেও এইডসের পেছনে রয়েছে যে ভাইরাস, এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট ধারণা এখনো পাওয়া যায়নি।
এইডস প্রতিরোধকবিহীন মিলনের মাধ্যমে শরীরে হয়তো ছড়ায়, কখনো কখনো অসতর্ক মুহূর্তে! অথচ জীবনের জন্য এ বড় বিপজ্জনক।
এইডস সম্বন্ধে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য বিশ্ব এইডস দিবসে লাল রঙের রিবন পরিধান করতে হয়। নিউইয়র্কের ভিজুয়াল এইডস শিল্পী কাওকাস ১৯৯১ সালে এর প্রচলন করেন। সচেতনতা বৃদ্ধির এই নিদর্শন হলো লাল রিবন, এর পেছনে বাণিজ্যিক কোনো প্রচেষ্টা নেই। বিশ্ব এইডস দিবস পালিত হচ্ছে ১ ডিসেম্বর ১৯৮৮ সাল থেকে।
এ দিবস পালনের যৌক্তিকতা এ রোগ প্রতিরোধ ও চিকিত্সার জন্য অর্থ সংগ্রহ, সচেতনতা বাড়ানো; এ ব্যাপারে যে জনমনে কুসংস্কার আছে, তা দূর করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ এবং এইডস সম্বন্ধে শিক্ষা। এ বছর বিশ্ব এইডস দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো, এ ব্যাপারে মানুষকে সারা বিশ্বের আওতায় আনা এবং মানবাধিকার। এ দিবসটি হলো প্রতিজ্ঞা রক্ষার দিন।
২০০৮ সালের মতো প্রতিবছরের বিশ্ব এইডস দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় নির্বাচন করে বিশ্বের এইডস অভিযানের বৈশ্বিক স্টিয়ারিং কমিটি; এইচআইভি/এইডস প্রতিরোধ ও চিকিত্সায় নিয়োজিত সরকার, সংস্থা এবং জনগণের সঙ্গে ব্যাপক আলোচনা করে তবে থিমটি নির্বাচন করা হয়। ২০০৫ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে এইডস দিবস পালনের প্রতিপাদ্য বিষয় থাকবে, ‘এইডস রোধ করুন, অঙ্গীকার রক্ষা করুন।’
মূল প্রতিপাদ্যের সঙ্গে প্রতিবছর একটি সে বছরের প্রতিপাদ্য থাকে। যেমন এবার হলো, ইউনিভার্সাল একসেস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস। এই প্রতিপাদ্যের মাধ্যমে রাজনৈতিক নেতাদের ২০১০ সালের মধ্যে এইচআইভি/এইডস প্রতিরোধ, চিকিত্সা, পরিচর্যা ও অবলম্বন যাতে বিশ্বজুড়ে সবার আওতার মধ্যে আসে, সে ব্যাপারে উত্সাহিত করা।
বিশ্ব এইডস দিবসের লক্ষ্যই হলো, এই মহামারির বিশ্বব্যাপী চ্যালেঞ্জ ও পরিণতির দিকে জনগণের দৃষ্টি আকৃষ্ট করা, যাতে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন ঘটে। ১৯৮৮ সালে লন্ডনে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মন্ত্রীদের শীর্ষ সম্মেলনে অনুধাবন করেন সংশ্লিষ্টজনেরা— এইচআইভি/এইডসের বিস্তার রোধে প্রয়োজন বিশ্বজুড়ে সম্মিলিত একটি প্রচেষ্টা। প্রতিবছর এ দিবসটি উদ্যাপনের উদ্দেশ্যই হলো, এইডস এবং এইচআইভি বিস্তার রোধে সচেতনতা সৃষ্টি করা।
১ ডিসেম্বর তাই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রস্তাবিত বিশ্ব এইডস দিবস পালিত হওয়া শুরু হয় ১৯৮৮ সাল থেকে এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা সংস্থা, সরকার ব্যক্তি পর্যায়ে পরস্পর তথ্য আদান-প্রদান ত্বরান্বিত করারও উদ্যোগ ধন্যবাদের পাত্র।
আগে উল্লিখিত এ বছরের প্রতিপাদ্য বিষয়টি নির্বাচন করা হয় এ কথা ভেবে যে এ ব্যাপারে যেন হয় মানবাধিকার রক্ষা এবং এইচআইভি প্রতিরোধ, চিকিত্সা, পরিচর্যা ও অবলম্বন যেন বিশ্বজুড়ে সবার আওতার মধ্যে আসে।
এইচআইভি সংক্রমিত নারী, পুরুষ ও প্রান্তিক জনগণকে অন্যদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করা, তাদের জন্য বৈষম্যমূলক আইন করা—এসবের বিরুদ্ধে সোচ্চার বক্তব্য দেওয়া হবে এ বছরের প্রতিপাদ্যের মধ্য দিয়ে।
ইউএনএইডসের অনুমান অনুযায়ী, বর্তমানে এইচআইভি সংক্রমিত লোক হলো ৩৩ দশমিক ২ মিলিয়ন, তাদের মধ্যে রয়েছে আড়াই মিলিয়ন শিশু।
২০০৭ সালে আরও আড়াই মিলিয়ন লোক নতুন করে সংক্রমিত হয়েছে।
তরুণেরাই এইচআইভির প্রধান শিকার
এইচআইভি সংক্রমিত ব্যক্তিদের অর্ধেকের সংক্রমণ ঘটে ২৫ বছর হওয়ার আগেই এবং মৃত্যু হয় ৩৫ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই।
আরও একটি তথ্য হলো, এ রোগের মূল লক্ষ্য উন্নয়নশীল দেশগুলো। এইচআইভি/এইডস সংক্রমিত ব্যক্তিদের মধ্যে শতকরা ৯৫ জন হলো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। তবে পৃথিবীর প্রতি দেশে, মহাদেশে তরুণ, পূর্ণবয়স্ক নারী, পুরুষ সবার জন্যই এইডস এখন বড় হুমকি।
এইচআইভি/এইডসের ব্যাপারে যে বিভেদ, বৈষম্য, কুসংস্কার—এগুলো এখন বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এইডস আক্রান্ত মানুষ ক্রমান্বয়ে এসবের শিকার হচ্ছে—সমাজচ্যুত হচ্ছে অনেকে, অনেকে আক্রমণের শিকার হচ্ছে, অনেককে বসতবাটি থেকে বহিষ্কার করা হচ্ছে, অনেকে এ কারণে চাকরি হারাচ্ছে, অনেকের ভ্রমণে বাধা আসছে—এসব বিষয় কীভাবে রোধ করা যায়, এবারের স্লোগানে তাই জোরের সঙ্গে বলার চেষ্টা করা হবে।
এইচআইভি পজিটিভ এমন ব্যক্তিদের প্রবেশ, অবস্থান এবং বসবাসে এখনো বিধিনিষেধ বা আইন রয়েছে বিশ্বের ৫৯টি দেশে। তাদের অবাধ চলাফেরা ও কাজের অধিকার দেওয়ার ব্যাপারেও রয়েছে বৈষম্যমূলক আইন। এদিকে এইচআইভি সংক্রমিত মানুষকে বৈষম্য থেকে সুরক্ষার জন্য জেন্ডার-বৈষম্য ও শারীরিক মিলন আক্রমণ থেকে নারীদের সুরক্ষার জন্য যে বিধি ও আইন, এগুলো পুরোপুরি বাস্তবায়িত হচ্ছে না।
তাই এইচআইভি সংক্রমিত ব্যক্তিদের সমাজচ্যুত না করে তাদের সমাজে গ্রহণ করা, তাদের নিরাপত্তা দেওয়া, চিকিত্সা দেওয়া, অধিকার নিয়ে বাঁচতে দেওয়ার স্লোগান রয়েছে এবারের এইডস দিবসে।
তাই মূল স্লোগান হবে, সবাইকে নিজ নিজ অধিকার নিয়ে বাঁচতে দিতে হবে। সবারই রয়েছে বেঁচে থাকার অধিকার, সবারই রয়েছে স্বাস্থ্য সুবিধার আওতার মধ্যে আসার অধিকার। মানবাধিকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো এইচআইভি প্রতিরোধ, চিকিত্সা, পরিচর্যা ও সাপোর্ট। অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এতে সাড়া দিয়েছেন। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা আমেরিকায় এইচআইভি সংক্রমিত লোকজনের প্রবেশ ও চলাফেরার ওপর বাধা-নিষেধ তুলে নিয়েছেন।
এ রোগের বিরুদ্ধে সংগ্রামে নেমেছেন বিল গেটস। তিনি ও তাঁর স্ত্রী মেলিন্ডা একটি ফাউন্ডেশন গঠন করেছেন, যা এইডস, ম্যালেরিয়া ও যক্ষ্মার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অর্থ সাহায্য দেবে ৫০০ মিলিয়ন ডলার।
অনেকেই এইচআইভি রোগীদের ক্ষেত্রে সহানুভূতিশীল। মমতার স্পর্শ তাঁরা দেন এদের দেহে, শোনান আশার বাণী। অনেকে সচেতন করেন অন্যদের।
শিক্ষা দেন, উচ্চঝুঁকিপূর্ণ দেহ-তরল, যার মাধ্যমে সংক্রমণ বেশি ঘটে সেগুলো হলো, সংক্রমিত রক্ত, শারীরিক মিলনরস, সামান্য হলেও মায়ের দুধ।
বড় কথা হলো, এইডস নিয়ে যেসব বিষয়, যেসব সমস্যা, এর সমাধান দেওয়া, এ ব্যাপারে একটি চিন্তা ও কাজের পার্থক্য নিয়ে আসার জন্য সবচেয়ে বড় প্রয়োজন রাজনৈতিক অঙ্গীকার।
অনেকেই আছেন যাঁরা দুস্থ ও অসুস্থ ব্যক্তিদের প্রতিও ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত রেখে চলেন। তাদের ঘৃণা করেন না, বরং স্নেহ ও মমতার বন্ধনে বাঁধেন।
চিকিত্সাবিজ্ঞানীরা এ রোগ নিয়ে করে যাচ্ছেন গবেষণা—নিরন্তর গবেষণা। এ নিয়ে ধারণা স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে।
অনেক ধর্মে এইডস আক্রান্ত মানুষের ভোগ-ভোগান্তিতে সান্ত্বনার বাণী রয়েছে।
অনেকে এ রোগে মৃত ব্যক্তিদের কারণে শোকার্ত হচ্ছেন।
উদ্দেশ্য হলো, তাদের জন্য আশার ভুবন তৈরি করা, তাদের মমতা ও স্নেহের বন্ধনে আবদ্ধ করা।
বোঝাতে হবে, সবাইকে নিরাপদ শারীরিক মিলনজীবনে অভ্যস্ত হতে হবে। নিজেকে রক্ষা করতে হবে, অন্যকেও রক্ষা করতে হবে। ধর্মীয় মূল্যবোধ, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি যা প্রাচ্যে রয়েছে, এ জন্যই আমাদের দেশে এর প্রকোপ এখনো কম। নিরাপদ শারীরিক মিলন হওয়া উচিত পৃথিবীজুড়ে মানুষের আচার।
সাহায্য চাইছে আফ্রিকার অসংখ্য শিশু। তাদের সাহায্য দিতে হবে। এইডস একটি দীর্ঘমেয়াদি ঘটনা। এ সমস্যা মোকাবিলা বেশ জটিল। তবে অতীত ও বর্তমানের সাফল্য আমাদের পথ দেখায়, নির্দেশনা দেয়, প্রত্যয় দেয় যে আমরা সর্বোত্কৃষ্ট সফলতা অর্জন করতে পারব।
এইডস নিয়ে গবেষণা ও নতুন রোগ নির্ণয়পদ্ধতি উদ্ভাবনে বিনিয়োগ প্রয়োজন। আমাদের আবিষ্কার করতে হবে আরও নিরাপদ, আরও কার্যকর নতুন ওষুধ। এ নিয়ে কুসংস্কার ও বৈষম্যের বেড়াজাল ভেদ করে বেরিয়ে আসতে হবে নতুন আলোর ভুবনে।
রোধ করতে হবে এইডস। এইডস সংক্রমিত মানুষের মনে যেন আশা জাগে বেঁচে থাকার, বাঞ্ছিত মানুষ হয়ে বেঁচে থাকার; তাদের মনের আঘাত যেন শুকিয়ে যায়। এইডস দিবস যেন মানবতাকে একত্র করে। এইচআইভি/এইডস সংক্রমিত মানুষের জন্য যেন আমাদের মনে জাগে সহানুভূতি, মমতা; তাদের জন্য আমরা বাড়াই সাহায্যের হাত।
শুভাগত চৌধুরী
পরিচালক, ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস
বারডেম হাসপাতাল, সাম্মানিক অধ্যাপক
ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ, ঢাকা
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, নভেম্বর ২৫, ২০০৯
Leave a Reply