১৬ অক্টোবর পালিত হলো বিশ্ব অ্যানেসথেসিয়া দিবস। ১৮৪৬ সালের এই দিনে বিখ্যাত ডেন্টাল সার্জন জি মর্টন আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতালে প্রথম অ্যানেসথেসিয়ার সফল প্রয়োগ করেন। এরপর দীর্ঘ দেড় শ বছর অনেক পথ পাড়ি দিয়ে চিকিৎসাসেবায় অ্যানেসথেসিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।
বর্তমান সময়কে শল্যচিকিৎসার স্বর্ণযুগ বলা হয়। মস্তিষ্ক, হূৎপিণ্ডসহ সব ধরনের অস্ত্রোপচার এখন বাংলাদেশেই সম্ভব। এর জন্য দরকার নিরাপদ অ্যানেসথেসিয়া। আধুনিক প্রযুক্তি ও গবেষণার কল্যাণে অ্যানেসথেসিয়া এখন এক অতি নিরাপদ প্রক্রিয়া। উন্নত বিশ্বে অ্যানেসথেসিয়ার কারণে মৃত্যুর হার লাখে মাত্র একজন। কিন্তু বাংলাদেশের চিত্র ঠিক উল্টো। এ দেশে এখনো রোগীরা অজ্ঞান হলে জ্ঞান ফিরে পাওয়ার উৎকণ্ঠায় থাকে। এর কারণ পর্যাপ্ত অ্যানেসথেটিস্টের অভাব। যদিও সত্তরের দশকে যেখানে শুধু মেডিকেল কলেজভিত্তিক অ্যানেসথেটিস্ট পাওয়া যেত, সেখানে ২০০০ সালে দেশের প্রায় সব শহরসহ উপজেলা পর্যন্ত অ্যানেসথেটিস্টরা কাজ করছেন।
দেশে এখন প্রায় ৮০০ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অ্যানেসথেটিস্ট আছেন। এঁদের প্রায় ৫০০ জনই বিশেষজ্ঞের সনদপ্রাপ্ত। কিন্তু জনসংখ্যার তুলনায় এটা নিতান্তই অপ্রতুল। আমাদের প্রয়োজন প্রায় ১৫ হাজার অ্যানেসথেটিস্ট। এই লোকবল কি অ্যানেসথেসিয়া কম হওয়ার কারণ?
সাধারণভাবে বলা যায়, দেশে চিকিৎসকের সংখ্যাই অপর্যাপ্ত। তারপর রয়েছে চিকিৎসকদের মেডিসিন, সার্জারিসহ অন্যান্য রোগের বিশেষজ্ঞ হতে চাওয়ার প্রবণতা। তা ছাড়া অ্যানেসথেসিয়ার প্রশিক্ষণে পদের সংখ্যা খুবই কম। অনেক মেডিকেল কলেজেই এখনো অ্যানেসথেটিস্টের পদ প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম।
সার্জারি বিভাগে এ সংখ্যা পদের বিপরীতে ১০ জনে একজন। এ ছাড়া চিকিৎসাবিজ্ঞানে অ্যানেসথেসিয়াকে পর্দার আড়ালের বিষয় বলে ধরা হয়। রোগীদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ কম হওয়া এর মূল কারণ। এসব কারণে চিকিৎসকেরা এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হতে কম আগ্রহী হন। সরকার বিশেষ ব্যবস্থা না নিলে এ সংকট ঘনীভূত হয়ে চিকিৎসাসেবার সম্প্রসারণে এটা বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়াবে। অ্যানেসথেসিয়া বিষয়ে দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণের দরকার। উন্নত বিশ্বে, যেমন যুক্তরাষ্ট্রে অ্যানেসথেসিয়ায় প্রশিক্ষণের মেয়াদ পাঁচ বছর, যুক্তরাজ্যে সাত বছর; কিন্তু আমাদের দেশে এটা এক থেকে দুই বছর। তাই বাংলাদেশে অ্যানেসথেসিয়ার প্রয়োগে মৃত্যুর হারও বেশি। গত তিন মাসে পত্রপত্রিকার মাধ্যমে অ্যানেসথেসিয়ার কারণে আটজন রোগীর মৃত্যুর খবর জানা গেছে। বাংলাদেশ সোসাইটি অব অ্যানেসথেসিওলজিস্টের প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানা গেছে, আটটির মধ্যে সাতটি অ্যানেসথেসিয়াই প্রয়োগ করেছিলেন সংশ্লিষ্ট ক্লিনিকের ওয়ার্ডবয়, ব্রাদার বা কখনো সার্জন নিজে। আর মাত্র একটি ক্ষেত্রে অ্যানেসথেটিস্টের হাতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এতে ভালোভাবেই বোঝা যায়, দেশে অ্যানেসথেটিস্টের স্বল্পতার কারণেই আনাড়িরা এ কাজে হাত দিয়ে রোগীকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দিচ্ছেন, যা দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার জন্য মোটেই সুখপ্রদ নয়।
অ্যানেসথেসিয়া শুধু প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসকেরাই প্রয়োগ করুন-এটাই আমাদের আহ্বান। এ আহ্বানে সংশ্লিষ্ট সবাই সাড়া দেবেন-সে প্রত্যাশা রইল।
লেখকঃ ডা· মো· খলিলুর রহমান
উৎসঃ দৈনিক প্রথম আলো, ২৪ অক্টোবর ২০০৭
Leave a Reply