ফার্স্ট ফুড নয়, প্রচুর তাজা ফল সবজি খান। দৈনন্দিন জীবনযাপনে এরকম ছোটখাট পরিবর্তন আয়ু যেমন বাড়াবে তেমনি ডায়াবেটিসের মত ক্রনিক রোগ ও এর জটিলতা থেকেও বাচাঁবে।
স্বাস্থ্যকর খাবারের দিকে একদিন মন যাবেই। ভোরে উঠে এক গ্লাস কোমল পানীয় পান না করে যদি একগ্লাস পানি পান করা যায় তাহলে একটি স্বাস্থ্যকর পানীয় যোগ হলো দৈনিক আহারের সঙ্গে। কালক্রমে এরকম দুএকটি ছোটখাট পরিবর্তন যোগ হতে হতে একদিন স্বাস্থ্যকর আহার হবে গোটা দিনের জন্য। মনও তখন স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে চাইবে। পেষ্ট্রিশপে গিয়ে কেক, পেষ্ট্রি খাবার জন্য যে আগ্রহ ছিলো একদিন তা থাকবেনা। মন ছুটে যাবে কাঁচাবাজারে, তাজা ফল ও সব্জি কেনার জন্য।
দৈনন্দিন জীবনযাপনে এরকম ছোটখাট পরিবর্তন আয়ু যেমন বাড়াবে তেমনি ডায়াবেটিসের মত ক্রনিকরোগ ও এর জটিলতা থেকেও বাঁচাবে।
দেখা যাচ্ছে সারা পৃথিবীজুড়ে ২৮.৫ কোটি মানুষেরও বেশি মানুষের রয়েছে ডায়াবেটিস। এভাবে চললে আগামী দুই দশক পেরিয়ে তা দাঁড়াতে পারে ৪৪ কোটিতে। আর শিশু তরুণদের মধ্যে যেমন ডায়াবেটিস বাড়ছে তেমনি ডায়াবেটিসে মৃত্যু বেশি দেখা যাচ্ছে নারীদের মধ্যে ৫৫%। বাংলাদেশে রয়েছে ৬০ লক্ষ ডায়াবেটিক রোগী।
পাকস্থলির পেছনে রয়েছে দেহযন্ত্র অগ্ন্যাশয় বা প্যানক্রিয়াস, অগ্ন্যাশয়ের রোগ হল ডায়াবেটিস। অগ্ন্যাশয়ে রয়েছে কোষপুঞ্জ যা থেকে নি:সৃত হয় হরমোন ইনসুলিন। ইনসুলিন শরীরকে খাদ্যকে ব্যবহার করে একে শক্তিতে রূপান-রিত করতে সহায়তা করে। যাদের ডায়াবেটিস হয় তাদের মধ্যে কখনও যথেষ্ট ইনসুলিন নি:সরণ হয়না অথবা কারোকারো ক্ষেত্রে শরীর ইনসুলিন নি:সৃত হলেও একে ব্যবহার করতে পারেনা; অনেক সময় দু’ধরনের ক্রটিই থাকতে পারে একত্রে। ইনসুলিন রক্তের গ্লুকোজকে দেহকোষে প্রবেশ করাতে সাহায্য করে।
ইনসুলিন কম থাকলে বা ঠিকমত কাজ না করলে গ্লুকোজ দেহকোষে ঢুকতে পারেনা। রক্তে বাড়তে থাকে গ্লুকোজ, হাইব্লাড সুগার, কোষে জ্বালানির অভাব হয়, রক্তে গ্লুকোজ খুব বেড়ে গেলে মূত্রেও যায় গ্লুকোজ। এই অবস্থার নাম ডায়াবেটিস।
প্রচুর নাস-া খেলে, মিষ্টি, মিঠাই, চর্বিবহুল খাবার, কোমলপানীয় বা হাই এনার্জি খাদ্য খেলে কোমরে মেদজমে। গবেষক অধ্যাপক ড্যান রামডাথ মনে করেন, কোমরের বেড় বেশি বেড়ে গেলে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বেশ বেড়ে যায়। কেবল ধনীদেশ কেন উন্নয়নশীল ও গরীব দেশের তরুণরা বিশেষকরে যে খাবার খাচ্ছে একে অখাদ্য বা কুখাদ্য (চড়ড়ৎ ফরবঃ) বলছেন পুষ্টিবিদ ডরিন সেন্ট হিল। অনেকে হয়ত সুমিত খাদ্য খাচ্ছেন তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ফাস্টফুড ব্যবসা অনুপ্রবেস করেছে এবং আমাদের স্বাভাবিক খাদ্য অভ্যাসকে অতিক্রম করে ফাস্টফুড
অনেকেরই পছন্দের তালিকায় ঢুকে পড়েছে। বেশিরভাগ ফাস্টফুডেই চর্বি খুব বেশি। মাঝে মধ্যে খাবারের মেনুতে স্বাস্থ্যকর পছন্দ বা ‘হেলদি চয়েস’ স্থান করে নিলেও দুর্ভাগ্যবসত: অনেকে আবার তা পছন্দ করছেননা কারণ তারা দীর্ঘদিনের প্রিয়খাবার ফ্রাইড চিকেন ও ফ্রাইকেই বেছে নিচ্ছেন। ডরেন সেন্ট হিলের বক্তব্য।
এমনও হয় যে সারাদিনের কঠোর শ্রমের পর টেকওয়ে শপ বা কর্নার থেকে ফাস্টফুডের প্যাকেট নিয়ে খেয়ে ফেলা অনেকে বেস পছন্দ করেন। কারণ সহজে, বিনাশ্রমে তৈরি খাদ্য, ছাড়া অত সোজা নয়। কালেভদ্রে, বন্দুবান্ধবের চক্করে পড়ে হঠাৎ একদিন ফাস্টফুড খাওয়ার মধ্যে দোষ নেই তবে প্রতিদিনের খাদ্য এটি নয়, মধ্যম চলাই উত্তম পন্থা। কেক খেতে পারেন মাঝে মাঝে, তবে দেখবেন টুকরাটি যেন খুব ছোট হয়।
সেন্ট হিল বলেন, স্বাস্থ্যকর খাওয়া মানে কেবল বিধি নিষেধ নয়, এর মানে হলো সুষম খাদ্য ও মেপে মেপে খাওয়া। মডারেসন হলো চাবিকাঠি। অনেকের ভূলধারণা আছে যে স্বাস্থ্যকর আহার মানে পছন্দের সব খাবার বর্জন করা, আসলে তা নয়। বলেন সেন্ট হিল। বাইরে যখন খাবেন তখন লক্ষ্য করুন টুকরোর আয়তন কত বড় হয়। ফ্রাইড চিকেনের মত ফাস্টফুড যদি রেসে-ারায় কোনদিন খেতে হয় বন্ধুদের সাথে তখন নিয়ন্ত্রন যেন থাকে, সঙ্গে যেন স্যালাডও থাকে। সাইড ওর্ডার হিসেবে আইসক্রিম/পেষ্ট্রি/বা মিঠাই যেন না থাকে, আর একে এড়ানো তেমন কঠিন নয়।
পরিবর্তন শুরু করা ভালো প্রাত:রাশ দিয়ে। সকালে চিকেন ফ্রাই/বার্গার বা আলুর চিপস্ ফ্রেঞফ্রাই এসব দিয়ে খাওয়া শুরু করবেন? হয়ত প্রাত:রাশ খানইনা। এর কোনওটিই ঠিকনা। প্রাত:রাশ খুবই গুরুত্বপূর্ন আরও অনেকেই জানেননা যে সার্বিক স্বাস্থ্য ও কুশলের জন্য সকালের খাবার কত গুরুত্বপূর্ণ। ভেবে দেখুন পেট্রল বা গ্যাস ছাড়া কি গাড়ি চালাতে পারবেন? না। আর ভূল বা ত্রুটিপূর্ণ জ্বালানি নিলে কি গাড়ি ভালো চলবে? না। সেরকমই, সকালে উঠে দিনে সামনের দিকে এগোবার জন্য প্রয়োজন সঠিক জ্বালানি নিজের দেহের জন্য।
কাজের মধ্যে হোক বা ব্যস- চলার মধ্যে হোক, চর্বিবহুল, নোনা সব স্ন্যাকস্ যেমন পটেটো চিপস্ বা চিনিবহুল খাবার যেমন ক্যান্ডিবার, টেক্ওয়ে সপ থেকে নিয়ে, খেয়ে ফেলা সোজা। তবে প্রাকটিক্যাল টিপস্ হলো, এমনসব স্ন্যাকস্ খাওয়া যাতে থাকে মূল্যবান পুষ্টিউপকরন। ফল হতে পারে অত্যন- ভালো উপশন্ । সেন্ট হিলর ত্রিনিদাদের উদাহরণ দিয়ে বলেন, পেয়ারা, পাও পাও, কলা রয়েছে। এতএতফল আর স্বাস্থ্যের জন্য এত ভালো। তবে আম ও পাকাপেপে কম খেতে হবে ডায়াবেটিস থাকলে।
বাসায় নাস-া? সেন্টহিলের পরামর্শ:- স্বাদু সব সব্জি যেমন গাজর ও শশা ফালি ফালি করে কেটে রেখে দিতে পারেন ফ্রিজে, পরে খাবেন। হাইক্যালোরি আইসক্রিম না খেয়ে লো-ফ্যাট দধি অনেকভালো। কুড়মুড়িয়ে চিবিয়ে খাবেন। বাদাম চিবালে ভালো হবে। কত বিকল্প রয়েছে, স্বাস্থ্যকর বিকল্প। বেছে নিয়ে শুরু করলেই হলো।
যখন তৃষ্ণা লাগে, তখন ঠান্ডা কোমল পানীয় বা ফলের জুস হকারের কাছ থেকে নিয়ে পান করা এড়ানো কঠিন, হয়ত কদাচিৎ পান করলেন, দোষ নাই; তবে ঠান্ডা একগ্লাস জল পান করা সবচেয়ে ভালো, এভাবে পিপাসা মিটানো ভালো।
১২ আউন্সের একবোতল কোমল পানীয়তে আছে ১৫০ ক্যালোরি। আর সেই ক্যালোরি আসছে কেবলমাত্র চিনি থেকে। এতে কোনও পুষ্টি নেই। বরং একটুকরো তাজাফল ও একগ্লাস জল অনেক ভালো এর চেয়ে। কোমল পানীয়ের মধ্যে এত বেশি চিনি রয়েছে যে এটি পান করা মোটেই স্বাস্থ্যকর নয়। ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে যেমন বাংলাদেশেও তেমন মধ্যাহ্ন ভোজন বা উৎসবে বিরিয়ানি, খাসির রেজালা, মোরগের রোর্স্ট, চর্বি, তেল মিঠাই রমরমা, সঙ্গে সামান্য স্যালাড ও বোরহানি থাকলেও একে স্বাস্থ্যকর খাবার বলেনা। আচ্ছা পোলাও যদি এক আধদিন করতেই হয়, ঘরে রান্না করে নিলে হয়। একে প্রকৃতিজাত সিজনিং দিয়ে সুবাসিত করুন, তেল দেবেন কম, ঘি ডালডা অবশ্যই দেবেননা। জনপ্রতি এক চামচ তেল যথেষ্ট। পোলাওতে নারকেলের দুধ না দিলে চলেনা? একজনকে বলতে শুনেছি, তেল চর্বিতে ঝক্ঝক্ না দেখালে এটি পোলাও হল? হতে পারে তা স্বাদু, কিন্তু স্বাস্থ্যকর নয়। ম্যাকারনি পাই দুএকদিন খেতে হতে পারেন, এতে পনির কম দিলে হয়না ? পটেটোস্যালাডে এত ম্যায়োনিজ কেন? ময়দার রুটি না খেয়ে আটার রুটি অনেক ভালো। লাল ঢেকিছাঁটাচাল অনেক ভালো। মিষ্টি আলু? অনেক আঁশ, সিদ্ধ করে সেকে নিলে খেতে মজা। পেয়ারা, জাম্বুরা, কুল, নাসপাতি, ভালো ফল। তবে রুটিতে যে ফল ও সব্জিতে ফিরে যাবে তানা, ধীরে ধীরে আসতে হবে। ছোটখাট, প্যাকটিক্যাল পরিবর্তন যা টিকে থাকে, তাই হবে লক্ষ্য, কাল ক্রমে দেখা যাবে, সত্যি বড় একটি পরিবর্তন এসেছে, আর ডায়াবেটিস প্রতিরোধে নিজের ভূমিকা পালন করা গেছে।
অধ্যাপক ডা. শুভাগত চৌধুরী
পরিচালক ল্যাবরেটরী সার্ভিসেস বারডেম, ঢাকা।
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, নভেম্বর ২১, ২০০৯
Leave a Reply