হৃদরোগ বলতে এখানে রক্তপ্রবাহ ব্যাঘাতজনিত হৃদরোগ বলা হচ্ছে। এ ধরনের রোগীদের আমরা চর্বি জাতীয় খাবার পরিহার করার পরামর্শ দিয়ে থাকি। তার সাথে ধূমপানও বন্ধ করতে বলি। অনেক রোগী কি খাবেন, কি খাবেন না এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চান।
হৃদরোগীদের খাদ্য তালিকায় প্রথমেই যোগ করতে হবে উজ্জ্বল রঙের শাক-সবজি, যেমন- শসা, গাজর, ঢেঁরস, টমেটো, ডাটা, পালংশাক, লালশাক ইত্যাদি। প্রতিদিন কিছু না কিছু টাটকা মৌসুমী ফল যেমন- আম, জাম, পেয়ারা, কমলা, কলা, আপেল, পেঁপে ইত্যাদি খাওয়া যেতে পারে।
মাংসের মধ্যে হৃদরোগীদের জন্য উপযোগী হচ্ছে বাচ্চা মুরগির মাংস। তবে মুরগির চামড়া, মগজ অবশ্যই বাদ দিতে হবে। কুসুম বাদ দিয়ে ডিমের সাদা অংশটুকু খেতে হবে। নির্দ্ধিধায় খাওয়া যাবে ছোট মাছ যেমন-মলা, কাচৃকি, টাকি, বেলে ইত্যাদি। এছাড়াও বেছে নেওয়া যেতে পারে পাবদা, শিং, কৈ ও মাগুরকে। ইলিশ মাছ বেশী করে খাবেন এতে উপকারী চর্বি ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড বেশী পরিমাণে থাকে।
এছাড়া আরও অনেক মাছ আছে যেগুলোতে চর্বি নেই সেগুলো খাওয়া যাবে। একটু সতর্ক দৃষ্টি রাখলেই আপনি বুঝতে পারবেন মাছটি চর্বিযুক্ত কি না। মিঠা পানির তৈলাক্ত মাছ না খাওয়াই ভাল। তবে যে কোন সামুদ্রিক মাছ খাওয়া যাবে। গবেষকরা মনে করেন, সামুদ্রিক মাছ হৃদপিন্ডের সুস্থতা রক্ষায় সহায়ক। তবে মিঠা পানির বড় মাছের চর্বি বাদ দিয়ে শুধু মাছটুকু খাওয়া যাবে। আটার রুটি খাওয়া যেতে পারে। ভাত কম খাবেন। ভুঁড়ির প্রতি লক্ষ রাখবেন। প্রতিদিনই ভাতের সঙ্গে ১/২ চামচ ডাল খাওয়া যেতে পারে। রান্নার জন্য সয়াবিন ও ভেষজ তেল ব্যবহার করবেন। সাধারণ মাখনের পরিবর্তে ভেষজ মাখন (মার্জারিন) খাওয়া যেতে পারে।
হৃদরোগীদের খাবারের বিধিনিষেধ:
হৃদরোগীদের ক্ষেত্রে রক্তের কোলেস্টেরলের স্বাভাবিক মাত্রা বজায় রাখার জন্যে খাদ্য অভ্যাসে কিছুটা পরিবর্তন আনতে হয়। এ ক্ষেত্রে রক্তের টোটাল কোলেস্টেরল ২০০ মি.গ্রাম/ডিএল এর কম, এল ডি এল ১০০ মি.গ্রাম/ডিএল এর কম, এইচ ডি এল ৪০ মি.গ্রাম/ডিএল এর বেশী ও ট্রাইগ্লিসারাইড ১৫০ এর কম রাখতে হয়। এর জন্য প্রয়োজন দৈনিক টোটাল ক্যালরির ৭% এর কম সম্পৃক্ত চর্বি ও ২০০ মি.গ্রাম এর কম কোলেস্টেরলের খাওয়া । দৈনিক ১০-২৫ গ্রাম ফাইবার জাতীয় খাবার খেতে হবে। মাখন, ঘি, বাটার অয়েল বর্জন করতে হবে। দুগ্ধ ও দুগ্ধজাত খাবার মিষ্টি, পেষ্ট্রি, কেক, পায়েস ইত্যাদি খাওয়া যাবে না। গরু, খাসি, হাঁস এবং প্রাণীজ চর্বি ও চর্বিযুক্ত মাংস পরিত্যাগ করতে হবে। মগজ, হাড়ের ভিতরের মজ্জা, চামড়া, ভুঁরি ইত্যাদি যে কোন প্রাণীরই হউক না কেন তা ত্যাগ করতে হবে। ডিমের কুসুমটুকু খাওয়া যাবে না। নারিকেল না খাওয়াই ভাল। মিঠা পানির তৈলাক্ত মাছ যেমন-পাঙ্গাস, বোয়াল, রুই, কাতলা এগুলো এড়িয়ে চলাই ভাল। খোলসযুক্ত জলজ প্রাণী যেমন চিংড়ি, খাওয়া উচিত হবে না। কখনোই পেট পুরে খাওয়া যাবে না। পেট পুরোপুরি ভরার অনুভূতি হওয়ার আগে খাওয়া বন্ধ করতে হবে।
উচ্চ রক্তচাপ থাকলে খাওয়ার সময় পাতে কাঁচা লবণ, লবণ দিয়ে সংরক্ষিত খাবার, যেমন- চিপস, আচার, চানাচুর, লোনা মাছ এসব একদম খাওয়া যাবে না। তাই টেবিল থেকে লবণদানিটি সরিয়ে ফেলাটাই বরং ভাল। তাছাড়া রান্নায়ও অতিরিক্ত লবণ ব্যবহার করা যাবে না।
হৃদরোগীদের অন্যান্য করণীয়ঃ
যে কোন মূল্যে ধূমপান ত্যাগ করতে হবে। সাদা পাতা, জর্দা, নস্যি, পান ইত্যাদি পরিহার করতে হবে। পরিমিত ব্যায়াম ও কায়িক পরিশ্রম করতে হবে। শারীরিক পরিশ্রম কতটুকু করা যাবে তা ইটিটির মাধ্যমে নির্ধারণ করে নেওয়া প্রয়োজন। তবে রোগী বেশী অসুস্থ থাকলে সে ক্ষেত্রে ব্যায়াম ও পরিশ্রমের ব্যাপারে অনেক বিধি নিষেধ মানতে হবে। তাই তখন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের কথামত চলতে হবে। হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের কাছ থেকে জেনে নিতে হবে, কতটুকু হাটাচলা রোগীর জন্যে নিরাপদ হবে। রোগী ক’তলা পর্যন- নিজে নিজে সিঁড়ি ভেঙে উঠতে পারবেন, আদৌ সিঁড়ি বেয়ে উঠতে পারবে কিনা-এ বিষয়গুলো চিকিৎসকের কাছ থেকে পরিষ্কারভাবে জেনে নেয়া বাঞ্জনীয়। তবে কমপক্ষে দৈনিক ৩০ থেকে ৬০ মিনিট করে সপ্তাহে ৩-৪ বার হাঁটা, জগিং, সাইকেল চালানো অথবা অন্যান্য মুক্ত বাতাসে ব্যায়াম করা যেতে পারে। উত্তম হলো সপ্তাহে প্রতিদিন এ পরিমাণ ব্যায়াম করা। জন্মনিরোধ বড়ি খাওয়ার আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। বাড়তি ওজন অবশ্যই কমাতে হবে। ওজন কমানোর জন্য চর্বিযুক্ত খাবার সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে খাবার গ্রহণ করতে হবে। শরীরের ওজন স্বাভাবিক রাখার মাত্রা হলো বিএমআই ১৮.৫-২৪.৯ কেজি/মি২ মধ্যে রাখা। আর কোমরের ব্যাস পুরুষের ক্ষেত্রে ৪০ ইঞ্চি বা তার কম এবং মহিলাদের ক্ষেত্রে ৩৫ ইঞ্চি বা তার কম রাখতে হবে। উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস অবশ্যই নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। হৃদরোগীদের ক্ষেত্রে রক্তচাপ ১৪০/৯০ এর কম রাখতে হয়। তবে হার্টফেলিউর অথবা কিডনীজনিত সমস্যা থাকলে ১৩০/৮৫ এর কম এবং ডায়াবেটিস থাকলে ১৩০/৮০ এর কম রাখতে হবে।
ডাঃ মোহাম্মদ শফিকুর রহমান পাটওয়ারী
মেডিসিন ও হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা।
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, নভেম্বর ২১, ২০০৯
Leave a Reply