সকাল বেলার ঘুমটা কি আরেকটু আগে ভাঙলেই হতো না? আর আজই কেন বেছে বেছে পানি ছাড়তে ভুলে গেলেন বাড়িওয়ালা? রাস্তার জ্যামটাও কি অফিস টাইমটাকে আরো একটু পেছনে ঠেলে পাঠানোর ষড়যন্ত্র করছে? নাহঃ এতোসব যন্ত্রনা কাহাতক সহ্য করা যায়। তাই সুন্দর একটা সকালের স্বপ্ন নিয়ে আগের রাতে ঘুমুতে গেলেও জনৈক আদনান সাহেবের দিনটা শুরু হলো একরাশ ‘স্ট্রেস’ নিয়ে। তাই নিয়ে লিখেছেন রাশেদুল হাসান শুভ
দিন পাল্টেছে, পাল্টেছে নগর জীবনের ব্যস্ততার গতিপথও। আবার সময়ের সাথে সাথে অন্দরমহলের বাসিন্দাদের জীবনযাত্রাটাও যে একেবারে নিস্তরঙ্গ থাকছে না সেটা তো বলাই বাহুল্য। এর ফলে নানা ছুতোয় আর নানা বাস্তবতায় স্ট্রেস তথা মানসিক চাপ কিন্তু ঠিকই হানা দিচ্ছে আমাদের মনবাড়িতে। আর এই স্ট্রেস সামলাতে গিয়ে যারা হররোজ হাপিত্যেস করেও কূল-কিনার করতে পারছেন না তাদের জন্যই আমাদের এবারের আয়োজন।
প্রতিদিনের কাজে যে সব ‘স্ট্রেস’ এর মুখোমুখি আপনি হচ্ছেন সেগুলোকে বশ মানিয়ে চলতে হলে আগে থেকেই যৎকিঞ্চিত জেনে নিতে হবে ‘স্ট্রেস’ বিষয়টি সম্পর্কে। মূলত শারিরীক, মানসিক কিংবা ইমোশনাল কোনো বিষয় নিয়ে যে বাড়তি চিন্তা সেই চিন্তা থেকেই উদ্ভব ঘটে ‘স্ট্রেস’ এর। এই স্ট্রেস এর কারণ হতে পারে ঘড়ির সাথে তাল মিলিয়ে চলবার তাড়া, অফিসে কাজের চাপ, সংসার জীবনে ক্রমাগত কাজের ভারে হাপিয়ে ওঠা কিংবা সামাজিক দায়বদ্ধতার মতো যেকোনো কিছু। তবে কারণ যাই হোক না কেন অধিকাংশ স্ট্রেস থেকে বেঁচে চলবার মূলমন্ত্র কিন্তু আটকে থাকে দু’টি বিষয়ের ওপরই। এর একটি হলো প্রতিকূল পরিবেশের সাথে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করা এবং অন্যটি হলো টাইম ম্যানেজমেন্ট।
একথা হয়তো সত্য যে প্রতিটি মানুষের মাঝে মানসিক চাপ বা ‘স্ট্রেস’ তৈরি হবার আলাদা আলাদা পটভূমি থাকে। তবে ‘স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট’ এর যে দাওয়াই সেটা কিন্তু গড়পড়তা কাছাকাছি কিছু বিষয়ের ওপরই নির্ভর করে। সারাদিনের কর্মব্যস্ততার যে চাপ তার শুরুটা হয় একেবারে সকাল থেকেই। এজন্য সকাল বেলা নির্দিষ্ট সময়ের ১৫ মিনিট আগেই ঘুম থেকে ওঠার চেষ্টা করুন। এরপর খানিকটা সময় নিয়ে বারান্দায় বা ছাদে হাঁটুন। এর ফলে সারাদিনের চাপ সামলাতে আপনি একটা বাড়তি মানসিক শক্তি
পাবেন। হাঁটাহাঁটির পর আপনার প্রধান কাজ প্রাত:কৃত্য সম্পন্ন করে সকালের নাশতা করা। এক্ষেত্রে যতো তাড়াই থাক টাইম ম্যানেজমেন্টটি এমন ভাবে করার চেষ্টা করুন যাতে বেশ খানিকটা সময় নিয়ে ব্রেকফাস্ট করা যায়। এতে করে আখেরে আপনার লাভ হবে দু’টো। পয়লা লাভ – সারাদিনের কাজে কনসেনট্রেশন এবং এনার্জি লেভেল দিনের শুরুতেই অর্জন করা। আর দ্বিতীয় লাভ ব্লাড সুগার লেভেলের উপর নিয়ন্ত্রন।
যারা কর্মজীবি এবং অফিসই যাদের ধ্যান-জ্ঞান তাদের জন্য মেন্টাল স্ট্রেস বা মানসিক চাপের একটা বড় অংশই তৈরি হয় অফিসের কাজকর্মকে ঘিরে। এসব ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময়েই বেলা বাড়ার সাথে সাথে কাজের চাপ বাড়তে থাকে। তবে সব চিন্তা একসাথে করতে যেয়ে কাজে যেন ভজঘট লেগে না যায় সেজন্য সকালে ১০ থেকে ১৫ মিনিট সময় নিয়ে কি কি কাজ করতে হবে তা আগে ভাবুন এবং সে অনুযায়ী একটা বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা তৈরি করুন। কোনো কাজে অন্যের সহায়তার প্রয়োজন হলে সেটাও সক্কাল সক্কাল তাকে জানিয়ে দিন। আর কাজের পরিমাণ যতোই পাহাড়সম হোক না কেন কখনোই একটানা কাজ করার মতো ভুল করবেন না। চেষ্টা করুন যেন প্রতি এক ঘন্টার কাজের পর অন্তত দশ মিনিট সিট থেকে উঠে হেঁটে আসা যায়। চাইলে এ সময়ে পরিবারের সদস্য বা বন্ধুদের খোঁজ নেয়ার মতো সামাজিক কাজগুলোও করতে পারেন। তবে এটাকে রুটিন বানিয়ে না ফেলে পুরো বিষয়টাকেই দেখতে হবে আয়েশের ভঙ্গিতে। আর অকারণে অন্যকে খুশি করা কিংবা অযাচিত ভয়ে সব কাজ মাথা পেতে নেবেন না। বরং মাঝে মাঝে আত্মবিশ্বাসের সাথে না বলার অভ্যাসটাও করুন। এর ফলে স্ট্রেস তৈরি হবার
সম্ভাবনাটা একেবারে গোড়াতেই দূর করা যাবে। তাছাড়া দুপুরের পর থেকে সাধারণত ক্লান্তি বাড়তে থাকে বলে এ সময় স্ট্রেস কন্ট্রোলের জন্য চাইলে কিছু যোগব্যায়ামও ‘ট্রাই’ করে দেখতে পারেন। উদহারণস্বরূপ দুপুরের লাঞ্চের পর যে সময়টাতে একটা ঘুম ঘুম ভাব চলে আসে সে সময়টাতে গভীর একটা শ্বাস নিয়ে তিন সেকেন্ড ধরে রাখুন। এভাবে পর পর পাঁচবার শ্বাস নেয়া আর ছেড়ে দেয়ার ব্যায়াম করলে শরীর কিছুটা চাঙ্গা হতে পারে।
চাকরীর পাশাপাশি যাদের সংসার কিংবা সামাজিক নানা ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হয় তাদের জন্য স্ট্রেস তৈরি হতে পারে বাড়িতেও। এছাড়া যারা সারা দিনমান ব্যস্ত থাকেন বাড়ির কাজে তাদেরকেও হরহামেশা মুখোমুখি হতে হয় নানা খুটিনাটি সমস্যার। এক্ষেত্রে প্রথম দলের জন্য আমাদের পরামর্শ – অফিস থেকে ফিরেই সংসারের কাজে ঝাপিয়ে পড়বেন না। বরং ঠান্ডার বাতিক না থাকলে একটা ফ্রেশ গোসল আর চা পর্ব সেরেই মাথা ঘামান বাড়ির কাজে। অন্যদিকে পরিবারের কর্তা কিংবা গিন্নি কাজ শেষে বাড়িতে ফিরলেই তার সামনে একগাদা নালিশ
দেবেন না। এতে ঐ মানুষটি সহজেই তার মেজাজ হারিয়ে ফেলতে পারেন এবং জন্ম নিতে পারে অযাচিত স্ট্রেসও। আর দ্বিতীয় দল অর্থাৎ যারা সারাদিন বাড়ির কাজের একশ একটা ঝামেলা পোহান তারা প্রথমেই বাড়ির দৈনন্দিন কাজগুলোকে একটা রুটিনের আওতায় আনার চেষ্টা করুন। সেই সাথে আলাদা একটা সময় বের করুন নিজের বিনোদন এর জন্য। এটা হতে পারে টিভি দেখা, বই বা পত্রিকা পড়া অথবা অন্য কোনো কিছূ। একটানা কাজে হাপিয়ে উঠলে এই বিনোদনগুলোই আপনাকে মানসিক চাপ সামলানোর দাওয়াই যোগাবে।
সারা দিনের ফিরিস্তি শেষে এবার ভাবা যাক রাতের কথা। রাত মানে অনেকের কাছে বিশ্রামের সময়। আর অনেকের কাছে রাতটা হলো আগামীকাল নিয়ে ভেবে ভেবে ঘুম হারামের কারণ। বুঝতেই পারছেন এই দ্বিতীয় দলই হচ্ছে মানসিক চাপের রোগী। আর তাই মানসিক চাপ তথা স্ট্রেস থেকে বাঁচতে হলে অহেতুক ভাবনা-চিন্তা মাথায় রেখে ঘুমের বারোটা বাজানো চলবে না মোটেই। সকালের ভাবনাটা নাহয় সকালেই দেখা যাবে। আর রাতটা বরাদ্দ থাক আরামদায়ক ডিনার, টিভি দেখা, গান শোনা কিংবা নেহাত খোশগল্পের জন্য।
সূত্রঃ দৈনিক ইত্তেফাক, নভেম্বর ১০, ২০০৯
Leave a Reply