প্রতিবছর ১৪ নভেম্বর বিশ্বজুড়ে পালিত হয় বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস। দিবসটি পালনের প্রতিপাদ্য বিষয় ডায়াবেটিস সচেতনতা ও প্রতিরোধ। ২০০৯ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত এ কয়েক বছর এই থিম অবলম্বন করে পালিত হবে বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস।
ক্রমে ডায়াবেটিস বাড়ছে দেশে দেশে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। এভাবে চললে আগামী বছর ৪০ লাখ লোক প্রাণ হারাবে ডায়াবেটিস রোগে। ২০০৯ সালের ১৯ অক্টোবর আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশন (আইডিএফ) ‘ডায়াবেটিস এটলাস’-এর সাম্প্রতিক সংস্করণ থেকে জানা গেল, বর্তমানে পৃথিবীজুড়ে ২৮৫ মিলিয়ন লোকের রয়েছে ডায়াবেটিস। নিম্ন আয় ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে এ রোগের প্রকোপ বেশি।
অচিরেই উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রতি পাঁচজনের মধ্যে চারজনের হতে পারে ডায়াবেটিস আর আক্রান্ত অধিকাংশেরই তা হবে সংসারে উপার্জনক্ষম বয়সের মধ্যে। দুই দশকের মধ্যে বিশ্বজুড়ে ডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যা দাঁড়াবে ৪৪ কোটিতে।
রোগীর ক্রমবর্ধমান সংখ্যা সত্ত্বেও অধুনাচিহ্নিত অনেক ডায়াবেটিক রোগীকে হয়তো হাঁটতে হবে একা, নিঃসঙ্গ পথে, সেই পথে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যাবে নানা জটিলতায়, বিষণ্নতার নীল জগতে—মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতির সীমায় এক অকালমৃত্যুর অন্ধ গহ্বরে।
তাই চাই ডায়াবেটিস রোগ সম্পর্কে সচেতনতা, মানুষকে দিতে হবে ডায়াবেটিস শিক্ষা, যাতে ডায়াবেটিস রোগটি আগাম চিহ্নিত হয়, নিশ্চিত করা যায় যে নতুন চিহ্নিত ডায়াবেটিক রোগীরা হাঁটবেন নির্ভয়ে, পরিচালিত হবেন চিকিত্সা ও পরিচর্যার প্রশস্ত পথে, সেই ক্ষমতায় বলীয়ান হয়ে তারা এড়াতে পারবে এ রোগের জটিলতা।
দেশের সরকার ও স্বাস্থ্য পরিচর্যা কর্মীদের দায়িত্ব অনেক। মানুষকে পরামর্শ দিতে হবে, যাতে তারা ডায়াবেটিস মোকাবিলার চাপ অতিক্রম করতে পারে। একে মোকাবিলার জন্য তারা যেন সব পদক্ষেপ নিতে পারে। তথ্য ও প্রমাণনির্ভর শিক্ষা দিতে হবে জনগণকে, যাতে উদ্যম ও নির্ভরতার সঙ্গে তারা এ রোগ মোকাবিলা করতে পারে।
ডায়াবেটিস সচেতনতার ক্ষেত্রে আমরা এখনো অনেক পিছিয়ে। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে আরও লাখ লাখ মানুষ আক্রান্ত হতে পারে এ রোগে। অথচ এদের চিকিত্সা করার মতো অর্থ থাকবে না। তাই একে প্রতিরোধ করার জন্য সক্রিয় পদক্ষেপ নিতে আর যেন দেরি না হয়। ডায়াবেটিসের পথে যাত্রা শুরুর আগেই মানুষকে থামাতে হবে। রোগ হওয়ার আগেই প্রতিরোধ করতে হবে। হয়তো চ্যালেঞ্জটা অনেক বড়। প্রয়োজন অনুযায়ী জীবনাচরণে পরিবর্তন আনা, স্বাস্থ্যকর পরিবেশ বিধান করার মতো কাজ অত সহজ নয়। সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর পথে শক্তিশালী সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক বাধাগুলো দাঁড়াতে পারে, এগুলো অতিক্রম করতে হবে। জীবনের পছন্দগুলো স্বাস্থ্যকর যেন হয়, এগুলো সহজপ্রাপ্য ও সুলভ যেন হয়, এমন লক্ষ্য অর্জন করাও সহজ নয়। কোমল পানীয় ও ফাস্ট ফুড সংস্কৃতির আগ্রাসন ঠেকানো কম বড় কাজ নয়। ছেলেমেয়েদের জন্য প্রতিটি স্কুলে খেলার মাঠ যাতে থাকে—এমন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সহজ কাজ নয়। যে বাণিজ্যযন্ত্র টাইপ-২ ডায়াবেটিসের দিকে মানুষকে পরিচালিত করছে, অসংক্রামক অন্যান্য রোগের দিকেও যে ঠেলে দিচ্ছে, একে ঠেকানো কঠিন; তবে একে সবাই মিলে ঠেকাতে হবে। বিভিন্ন বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন ও বিপণন, যা মানুষকে প্রতারিত করে এবং চর্বিবহুল, শর্করাবহুল, লোনা খাবারের দিকে মানুষকে প্রলুব্ধ করে, একে সহজে তো ঠেকানো যায় না। অস্বাস্থ্যকর খাবার থাকে বাহারি মোড়কে, সাশ্রয়ী দামে, দরজায় পৌঁছে যায় এসব পণ্য—এভাবে এগুলো মানুষের প্রিয় খাবার হয়ে ওঠে।
এসব শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে জেতা কঠিন, তবে এ লড়াইয়ে লড়তে হবে। এ বছরের প্রথম দিকে জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন ঘোষণা দিয়েছিলেন যে ডায়াবেটিস ও অন্যান্য অসংক্রামক ব্যাধি বর্তমানে এইচআইভি/এইডস, ম্যালেরিয়া ও যক্ষ্মা রোগের মতো সংক্রামক রোগের চেয়েও বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। মহাসচিব একে বলেছেন ‘আ পাবলিক হেলথ ইমারজেন্সি ইন স্লো মোশন’। বর্তমানে ডায়াবেটিসের রোগীর চিকিত্সা ও প্রযুক্তিকৌশল এমন মানে এসে দাঁড়িয়েছে, যার সুফল লাভ করে রোগী রোগকে সফলভাবে মোকাবিলা করতে পারবে এবং একটি পরিপূর্ণ ও অর্থবহ জীবনধারণে সক্ষম হবে। আর অজ্ঞানতার জন্য, সচেতন না থাকার জন্য, সম্পদের সীমাবদ্ধতা ও শিক্ষার অভাবে, স্বাস্থ্য-অবকাঠামোর ঘাটতির জন্য রোগী যদি পরিপূর্ণ জীবন লাভে ব্যর্থ হয়, তাহলে হূদয়বিদারক ঘটনা। পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে শতকরা ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ রোগী টাইপ-২ ডায়াবেটিসে ভুগে থাকে। অথচ সুনিয়ন্ত্রিত জীবন যাপনের মাধ্যমে একে অনেকটাই প্রতিরোধ করা সম্ভব। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বাংলাদেশে ডায়াবেটিসের রোগীর সংখ্যা ৩০ লাখ ৮০ হাজার অথবা জনসংখ্যার শতকরা ৮ দশমিক ৪ ভাগ। ২০২৫ সালের মধ্যে এ সংখ্যা বেড়ে ৭০ লাখ ৪০ হাজার বা মোট জনসংখ্যার শতকরা ৬ দশমিক ১ ভাগে দাঁড়াবে। এর ফলে বিশ্ব প্রেক্ষাপটে ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্তদের সংখ্যার বিচারে বাংলাদেশ শীর্ষ দশে স্থান পাবে।
আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিক ফেডারেশনের পরামর্শ হলো, যত্রতত্র স্ক্রিনিং করে এবং নিজে নিজের স্ক্রিনিং করে টাইপ-২ ডায়াবেটিসের যাদের উচ্চ ঝুঁকি রয়েছে, তাদের শনাক্ত করা যাবে। বয়স, কোমরের মাপ, পারিবারিক ইতিহাস, হূদরোগের ইতিহাস ও গর্ভধারণকালে রক্তের সুগার বেশি ছিল কি না, এসব বিষয়ে সহজ প্রশ্নমালার মাধ্যমে উচ্চ ঝুঁকিসম্পন্ন লোকদের চিহ্নিত করা সম্ভব।
একবার চিহ্নিত হলে উচ্চ ঝুঁকিসম্পন্ন লোকদের রক্তের গ্লুকোজের মান ল্যাবরেটরিতে মাপিয়ে দেখা উচিত। যদি দেখা যায় কারও রক্তের গ্লুকোজের মান (উপবাসী রক্তে) বেশি, তবে ডায়াবেটিস হওয়ার মতো মান অতিক্রম করেনি বা রক্তের গ্লুকোজের মান আহারের বা গ্লুকোজ দ্রবণ গ্রহণের দুই ঘণ্টা পর বেশি, তবে তা ডায়াবেটিস চিহ্নিত হওয়ার মতো মান অতিক্রম করেনি। তাহলে রোগীদের ডায়াবেটিসের উচ্চ ঝুঁকি রয়েছে তা প্রতিপন্ন হবে। এদের ক্ষেত্রে ডায়াবেটিস প্রতিরোধ বা হলেও তা দেরিতে হওয়ার পরিবেশ তৈরির জন্য কর্মসূচি গ্রহণ করা উচিত। স্বাস্থ্যকর দেহ ওজন বজায় রাখলে এবং মাঝারি ধরনের শরীরচর্চা করলে টাইপ-২ ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করা যায়, তা আজ পরীক্ষিত সত্য। প্রাথমিক প্রতিরোধের এই কর্মসূচিতে বড় ভূমিকা রয়েছে ডায়াবেটিস এডুকেটরের, তাঁরা মানুষকে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি সম্পর্কে জানাবেন, বোঝাবেন এবং স্বাস্থ্যের উন্নয়নের জন্য বাস্তবসম্মত লক্ষ্য নির্ধারণে সহায়তা করবেন। আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিক ফেডারেশন একটি লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে—যেমন প্রতিদিন ৩০ মিনিট ব্যায়াম, দ্রুত হাঁটা/সাঁতার কাটা/সাইকেল চালানো বা নৃত্য করার মতো ব্যায়াম। যেমন প্রতিদিন নিয়মিত আধঘণ্টা হাঁটলে টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি ৩৫-৪০ শতাংশ কমায়।
বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবসে বিশ্ব ডায়াবেটিসের ঝুঁকিগুলো সম্পর্কে আরও বেশি অবহিত করতে এবং এ রোগ প্রতিরোধ কর্মসূচি আরও বেশি জোরদার করার তাগিদ থাকবে। ডায়াবেটিসের এ অভিযানের মধ্য দিয়ে জাতিসংঘের সব সদস্য-দেশকে ডায়াবেটিসের ব্যাপারে জাতিসংঘের প্রস্তাবনা ও সিদ্ধান্ত অনুসরণের অঙ্গীকার পূরণের জন্য আহ্বান আসবে এবং ডায়াবেটিস প্রতিরোধ, চিকিত্সা ও পরিচর্যার ক্ষেত্রে নীতি বাস্তবায়নেরও তাগিদ আসবে।
টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকিগুলো হলো:
স্থূলতা ও বেশি ওজন
শরীরচর্চা না করা
আগে রক্তের গ্লুকোজ বাড়া
যথাযথ খাবার না খাওয়া
বার্ধক্য
উচ্চ রক্তচাপ বা উচ্চমান কোলেস্টেরল বা চর্বি
ডায়াবেটিসের পারিবারিক ইতিহাস থাকা
গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের ইতিহাস
ডায়াবেটিসের সতর্কসংকেত
বারবার প্রস্রাব হওয়া
অতিরিক্ত পিপাসা লাগা
অতিরিক্ত ক্ষুধা
ওজনহানি
ক্লান্তিবোধ
কাজে মনোযোগ ও সমন্বয়ের অভাব
বমি ও পেটব্যথা (ফ্লু বলে ভুল হতে পারে)
হাত ও পায়ে ঝিনঝিন বা অবশ অনুভূতি
ঝাপসা দৃষ্টি
বাবা-মায়ের সংক্রমণ
ক্ষত শুকাতে দেরি হওয়া
টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগীর মধ্যে লক্ষণ-উপসর্গ মৃদু থাকতে পারে, নাও থাকতে পারে। এসব লক্ষণ দেখা দিলে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকের পরামর্শ নিতে হবে।
শুভাগত চৌধুরী
পরিচালক, ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস
বারডেম হাসপাতাল, সাম্মানিক অধ্যাপক
ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ, ঢাকা
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, নভেম্বর ১১, ২০০৯
Leave a Reply