তখন আমি তরুণ ডাক্তার। চল্লিশ বছর আগের কথা।
যে রোগীকে দেখছিলাম তিনিও বয়সে তরুণ। রোগী, পরীক্ষার উচু শয্যায় বসলেন। চোখে মুখে দুঃখ, অসুখর চিত্র, অবিরাম কাশছেন, চোখ জবাফুলের মত লাল, মাঝে মাঝে কেঁপে কেঁপে উঠছিলেন, ভারী কম্বলে মোড়া শরীর শীত মান্ছিল না। জ্বর মেপে পাওয়া গেলো ১০৩ ডিগ্রি। রোগীর সঙ্গে কথা বলে, শরীর পরীক্ষা করে মনে হলো ইনফ্লুয়েঞ্জা। তখন টেস্ট করার বালাই ছিল না, টেস্ট এত আবিস্কৃতও হয়নি। তখন ডাক্তাররা নাভি টিপে, রোগী পরীক্ষা করে কথা বলেই বেশিরভাগ রোগ নির্ণয় করতেন। জ্বর হলে একটি লাল বর্ণের মিক্সচার ছিল বোতলে ভরে, গায়ে গাগ কাটা সেঁটে দিতেন কম্পাউন্ডার। এক দাগ করে তিনবেলা সেবন। বড়ির মধ্যে এপিসি ট্যাবলেট। মাথা ধরলে স্যাবিড়ন। কফ কাশে তুলসী পাতার রব, নয়ত বাসক সিরাপ।
আমি দিলাম এপিসি বড়ি, গরমজল দিয়ে গড়গড়া করার পরামর্শ ও বাসক সিরাপ। ‘বাড়ি যান এবং বিশ্রাম করুন’ বলাম আমি।
চোখ তুলে তিনি তাকালেন আমার দিকে। ‘বাসায় গিয়ে বিছানায় শোব? আমাকে এখন কাজে যেতে হবে।’ ভারী চাদর দিয়ে শরীর মুড়িয়ে হনহন করে ছুটলেন তিনি।
অবাক লাগলো। এই অবস্থায় কাজ করা? এমন জ্বর নিয়ে কাজ করার কথা ভাব্লেন তিনি কি করে? আর ফ্লু ভয়ানক ছোঁয়াচে, কর্মস্থলে কত লোকের হবে সংক্রমন!
তবে তার প্রতি সামান্য ভালবাসা মিশ্রিত শ্রদ্ধাও জানাতে ইচ্ছা হলো। বেশ শক্ত সমর্থ মানুষতো। ধূমজ্বর, শরীর অসুস্থ কিছুই তাকে কাজ থেকে বিরত করে পারলোনা।
আমার হাউস জব মাত্র শেষ হয়েছে। হাউস ফিজিওশিয়ান থাকার সময় সবচেয়ে বড় অপরাধ হলো অসুস্থ হওয়া। এর মানে হলো অন্য কেউ আপনার কাজটা কবে দেবে- রোগী ভর্তি করবে, ফোন কল কবে, আইভি দেবে শিরায়, জরুরি অবস্থা মোকাবেলা করবেঃ। যখন হাউস অফিসার ছিলাম তখন আমার মনে আছে, শরীর অসুস্থ হওয়ার কারণে একদিনও কাজে গরহাজির হইনি। সামান্য জ্বর সর্দি হলেও এড়িয়ে গেছি। তবে এরপরে যে অসুখের জন্য অল্প ছুটি-ছাটা কর্মজীবনে নিয়েছি, এও ঠিক। তবে পরে কর্মজীবনে দেখেছি, পেশাগত জীবনে, সর্দি জ্বর ও ফ্লুর জন্য কাজে হাজির থাকবেনা এমন লোক কমই। সরকারি কাজে যারা, এরা ছুটি নিলেও প্রাইভেট জব যাদের এরা চাকরি হারানোর ভয়ে, আবার অনেকে কর্মদিবসে ছুটি নিলে ঘরে চাল জুটবে না, দিন আনে দিন খান এমন লোক কাজ থেকে ছুটি নিতে চাইতেন না। অসুখ হয়ে ঘরে শুয়ে থাকার দিন নয়। অনেক রোগী সহানুভূতি, সমবেদনা এবং বন্ধুসুলভ পরামর্শেও টলেন না। এরা ডাক্তারের চেম্বারে যেন আসেন এন্টিবায়োটিক ব্যবস্থাপত্রের জন্য।
ফ্লু ও সর্দি জ্বর চিকিৎসায় এন্টিবায়োটিক দিয়ে কাজ হয়না একথা ডাক্তাররা জানেন, জানেন অনেক রোগীও। ভাইরাল জ্বরে এর প্রয়োগ মোটেও যুক্তিযুক্ত নয়। আর এসব ওষুধের বিপদ ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াতো আছেই।
অনেক সময় চিকিৎসকরা যে এর ব্যবস্থাপত্র দেন না, তা নয়, রোগীরাও নিজেরা অনেক সময় সেবন করে ফেলেন। ওষুধের এমন অপব্যবহারে ড্রাগ-রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া বা ‘সুপার বাগ’ সমস্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব এলার্জি ও ইনফেকশাস ডিজিজের ডিরেক্টার ডাঃ এন্থনি ফসি বলেন, ‘ডাক্তারের চেম্বারে, ক্লিনিকে এবং জনগোষ্ঠিতে এন্টিবায়োটিকের অপব্যবহারে ড্রাগ রেজিস্ট্যান্সের সমস্যা বাড়ছে।’ বিশ্বজুড়ে সমস্যার চিত্র একইরকম। ‘যেহেতু বেশিরভাগ ব্যাকটেরিয়া সংখ্যা বৃদ্ধি ঘটে দ্রুত এরা খুবই দ্রুত এন্টি মাইক্রোবিয়াল ওষুধের বিরুদ্ধে রেজিস্টান্স গড়ে তুলে।’
সোয়াইন ফ্লু এখন দেখা দিয়েছে, অসুস্থ রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। অসুখে যাতে এন্টিবায়োটিক ওষুধ ব্যবহৃত হয় যথাযথ ক্ষেত্রে, তাও রোগীদের অবহিত করতে হবে। উপসর্গের উপশমে পরামর্শ দিতে হবে। মানুষ অসুস্থ হতেই পারে। সর্দি জ্বর, ফ্লু হতেই পারে। এজন্য কাজ থেকে ছুটি নিয়ে বাসায় শুয়ে বিশ্রাম নেওয়া ঠিক হবে। সারাদিন গরম চা, গরম স্যুপ খাওয়া ভাল হবে। হয়ত পুরো এক হপ্তা। রোগী যেমন সেরে উঠবে তেমনি রোগী অন্তরীন থাকাতে ভাইরাস ছড়াবেনা অন্য শরীরে।
আর ফ্লু ঘর নিয়ে কাজে গেলে প্রশংসা কুড়াবার মত কাজ হলো না, মনে রাখা ভাল।
আমাদের দেশে সোয়াইন ফ্লু’র প্রাদুর্ভাব এখনও নেই তবে ইনফ্লুয়েঞ্জা জ্বর তো হচ্ছে, আর তাই এরকম ব্যবস্থা তো নেয়া ভালই।
সবশেষ জানা গেল, একজন সোয়াইন ফ্লু রোগী শণাক্ত হয়েছে দেশে, তবে উদ্বেগের কারণ নেই, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে।
অধ্যাপক ডা. শুভাগত চৌধুরী
পরিচালক, ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস, বারডেম, ঢাকা
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, অক্টোবর ২৬, ২০০৯
Leave a Reply