প্রতিটি মানুষের শরীরেই ক্যানসার-কোষ থাকে। সাধারণ পরীক্ষায় এসব কোষ তত দিন পর্যন্ত দেখা যায় না, যত দিন পর্যন্ত এগুলো বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়ে নিযুত কোটি সংখ্যায় দাঁড়ায়। চিকিত্সকেরা যখন ক্যানসার চিকিত্সা শেষে রোগীকে বলেন, তার শরীরে আর কোনো ক্যানসার-কোষ নেই, তার অর্থ এই যে শনাক্ত করার মতো যথেষ্ট পরিমাণ ক্যানসার-কোষ তার শরীরে নেই।
একজন মানুষের জীবনে ছয় থেকে দশবার ক্যানসার-কোষ তৈরি হয়। যখন শরীরে প্রতিরোধের ব্যবস্থা শক্তিশালী থাকে তখন ক্যানসার-কোষগুলো বাড়তে পারে না, টিউমারও হয় না।
ক্যানসার রোগীর শরীরে বহুবিধ পুষ্টির অভাব দেখা যায়। পুষ্টির এ অভাব হতে পারে জেনেটিক বা বংশগত কারণে। পরিবেশগত, খাদ্যাভ্যাস ও জীবনব্যবস্থার কারণেও হতে পারে।
খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন, প্রয়োজনীয় পুষ্টি ও ভিটামিন গ্রহণের মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধের ব্যবস্থা জোরদার ও বহুবিধ পুষ্টির অভাব দূর করা সম্ভব।
কেমোথেরাপি যেমন দ্রুত বৃদ্ধিপ্রাপ্ত ক্যানসার কোষকে ধ্বংস করে, তেমনি ধ্বংস করে অস্থিমজ্জা ও খাদ্যনালির সুস্থ কোষকেও।
কেমোথেরাপি লিভার, কিডনি, হার্ট এবং ফুসফুসেরও ক্ষতি করতে পারে।
এক্স-রে বা রেডিয়েশন থেরাপি ক্যানসার-কোষ ধ্বংস করে। সেই সঙ্গে শরীরের সুস্থ কোষকলা ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্ষতি করে।
শুরুতে কেমোথেরাপি ও রেডিয়েশন চিকিত্সা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে টিউমারের আকার হ্রাস করে। তবে দীর্ঘদিন কেমোথেরাপি ও রেডিয়েশন চিকিত্সা করলে টিউমারের আকার আর তেমন হ্রাস পায় না। কেমোথেরাপি ও রেডিয়েশনের ফলে শরীরে যখন অতিরিক্ত পরিমাণ দূষিত পদার্থ জমা হয়, তখন শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায় বা ধ্বংস হয়ে যায়, ফলে শরীরে সহজেই নানা রকম ইনফেকশন ও জটিলতার সৃষ্টি হয়।
কেমোথেরাপি ও রেডিয়েশন ক্যানসার-কোষ বিভাজনের কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং এমন প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায় যে ক্যানসার-কোষ ধ্বংস করা কঠিন হয়ে পড়ে। অস্ত্রোপচারের সময়ও ক্যানসার-কোষ শরীরের অন্যান্য অংশে বিস্তার লাভ করতে পারে।
কার্যকরভাবে দূর করতে হলে ক্যানসার-কোষকে অভুক্ত রাখতে হবে, যাতে এটি আর বৃদ্ধি পেতে না পারে।
ক্যানসার-কোষ সাধারণত যেসব খাদ্যের ওপর নির্ভরশীল
চিনি ক্যানসার-কোষের খাদ্য সরবরাহ করে। চিনি খাওয়া বন্ধ করলে ক্যানসার-কোষের একটা গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। চিনির বিকল্প, যেমন নিউট্রাসুইট, ইকুয়াল—এগুলো শরীরের ক্ষতি করে। তবে মধু বা গুড় অল্প পরিমাণে ব্যবহার করা যেতে পারে। সাদা লবণের চেয়ে বিট লবণ ভালো। কারণ লবণ সাদা করতে কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়, যা শরীরের জন্য ভালো নয়।
দুধ শরীরে মিউকাস তৈরি করে, বিশেষ করে খাদ্যনালিতে। ক্যানসার-কোষের খাবারই হচ্ছে মিউকাস। সুতরাং দুধ বা দুধজাতীয় খাদ্যের পরিবর্তে সয়া দুধ ব্যবহার করলে ক্যানসার-কোষ অভুক্ত থাকবে।
শরীরে এসিডের পরিমাণ বৃদ্ধি ক্যানসার-কোষ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। মাংসজাতীয় খাদ্য এসিড তৈরি করেবেশি। সে জন্য মাছ খাওয়া ভালো। ছোট মুরগি অল্প পরিমাণে খাওয়া ভালো। গরু বা খাসির মাংসে পশুর অ্যান্টিবায়োটিক, গ্রোথ হরমোন ও প্যারাসাইড থাকে, যা শরীরের জন্য ক্ষতিকারক, বিশেষ করে ক্যানসার রোগীর জন্য।
স্বাস্থ্যকর খাদ্য, যার মধ্যে ৮০ শতাংশ তাজা সবজি, সবজির রস, ঢেঁকিছাঁটা চাল, ডাল, বিচিজাতীয় খাবার, বাদাম ও ফল থাকে, যা শরীরে অ্যালক্যালাইন পরিবেশ সৃষ্টি করে অর্থাত্ ক্যানসার কোষের জন্য বৈরী পরিবেশ সৃষ্টি করে। ২০ শতাংশ খাবার রান্না করা হতে পারে, যার মধ্যে শিম থাকতে পারে। তাজা সবজির রসে তাজা এনজাইম থাকে, যা খাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে শরীরে অনুপ্রবেশ করে এবং শরীরে সুস্থ কোষ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। শরীরে সুস্থ-সবল কোষ তৈরির জন্য এনজাইমের প্রয়োজন। আর এই এনজাইম পাওয়া যায় তাজা শাকসবজির রসে। শরীরে এনজাইম গ্রহণের জন্য তাজা সবজির রস, যেমন—গাজর, বাঁধাকপি, ডালের অঙ্কুরের রস পান করা অত্যন্ত উপকারী। মনে রাখা প্রয়োজন, (১০৪০ ফারেনহাইট) অতিরিক্ত তাপে রান্না করা খাবারের এনজাইম ধ্বংস হয়ে যায়। এ ছাড়া দিনে দু-তিনবার কাঁচা শাকসবজি সালাদ হিসেবে খাওয়া প্রয়োজন।
কফি, চা ও চকলেটে ক্যাফেইন থাকে। সুতরাং এগুলো না খাওয়াই ভালো। তবে সবুজ চা খুবই উপকারী। এতে রয়েছে ক্যানসার-নিরোধক ক্ষমতা। ফিল্টার করা বিশুদ্ধ পানি পান করা দরকার বেশি পরিমাণে। ট্যাপের পানিতে দূষিত পদার্থ থাকে। তা পরিহার করতে হবে।
মাংসের প্রোটিন হজম করা কঠিন এবং হজমের জন্য অনেক এনজাইমের প্রয়োজন হয়। হজম না হওয়া মাংসকণা পচন ধরা অবস্থায় খাদ্যনালিতে জমা হয় এবং বিষাক্ত পদার্থ তৈরিতে সহায়তা করে।
ক্যানসার-কোষের চারদিকে প্রোটিনের প্রলেপ থাকে। মাংস না খেলে বা কম খেলে শরীরে এনজাইমের পরিমাণ বেশি থাকে। এই এনজাইম ক্যানসার-কোষের শক্ত প্রলেপ ধ্বংসে সহায়তা করে এবং শরীরের নিজস্ব প্রতিরক্ষা বাহিনী বা শত্রু ধ্বংসকারী কোষ ক্যানসার-কোষ ধ্বংস করতে সহায়তা করে।
কিছু উপাদান শরীরের রোগপ্রতিরোধের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে (যেমন ভিটামিন, অ্যান্টি অক্সিডেন্ট, খনিজ ইত্যাদি) এবং শরীরের নিজস্ব ধ্বংসকারী কোষগুলোকে ক্যানসার-কোষ ধ্বংস করতে সাহায্য করে। এ ছাড়া ভিটামিন ‘ই’তে এমন কিছু উপাদান আছে যা শরীরে স্বাভাবিক নিয়মে ক্ষতিগ্রস্ত, অনাকাঙ্ক্ষিত ও অপ্রয়োজনীয় কোষগুলোকে শরীর থেকে বের করে দিতে পারে।
সাঈদা খান
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, অক্টোবর ২৮, ২০০৯
Leave a Reply