ডায়াবেটিস যে ক্রমেই পৃথিবীতে প্রায় মহামারির আকারে আসছে, এ নিয়ে তথ্যাভিজ্ঞ মহল প্রায় নিশ্চিত। গত সপ্তাহে কানাডার মন্ট্রিলে বিশ্ব ডায়াবেটিস কংগ্রেসের অধিবেশনে বিশেষজ্ঞরা ডায়াবেটিস চিকিত্সার তিনটি নীতিসূত্র প্রকাশ করেছেন। গর্ভকালে ডায়াবেটিস, মুখের স্বাস্থ্য ও ডায়াবেটিস এবং রোগী দ্বারা রক্তের গ্লুকোজমান নিজে তদারক করা—এসব নীতিসূত্রের মূল বিষয়।
আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিক ফেডারেশন মানচিত্রের মাধ্যমে যে নতুন তথ্য-উপাত্ত প্রকাশিত হয়েছে, এ থেকে বোঝা যায় যে ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে বিশ্বজুড়ে বর্তমান অবস্থা ধারণার চেয়ে খারাপ। বিশ্বজুড়ে আনুমানিক ২৮ কোটি পাঁচ লাখ লোকের রয়েছে ডায়াবেটিস। আইডিএফ টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান ডা. স্টিফেন কলানিয়ারি বলেন, বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে ২০ বছরে এই সংখ্যা দাঁড়াবে ৪৩ কোটি পাঁচ লাখে।
অস্ট্রেলিয়ার সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেটাবলিক হেলথ বিষয়ে অধ্যাপক কলানিয়ারি বলেন, ‘দুর্ভাগ্যবশত বছরে ৪০ লাখ মানুষের মৃত্যুর কারণ হলো ডায়াবেটিস এবং এর ব্যয়ভার বিপুল—৩৭৬ বিলিয়ন ডলার।’
ক্রমবর্ধমান মহামারি মোকাবিলা করার জন্য ডায়াবেটিস পরিচর্যার ক্ষেত্রে সর্বশেষ উন্নতি এবং তথ্য সম্বন্ধে স্বাস্থ্য পেশাজীবীদের অবহিত হওয়া প্রয়োজন। টাইপ-২ ডায়াবেটিস বা বয়স্ককালীন ডায়াবেটিস হলো মোট ডায়াবেটিসের ৯৫ শতাংশ।
গর্ভাবস্থা বিবেচনা করে আইডিএফ প্রচার করেছে গাইডলাইন। গর্ভকালীন ডায়াবেটিস এবং যাঁদের ইতিমধ্যে ডায়াবেটিস হয়েছে ও গর্ভবতী হয়েছেন—এঁদের চিকিত্সা বিশ্বজুড়ে যাতে একই নীতিসূত্র অনুযায়ী হয় সেজন্য এই গাইডলাইন। এই পরামর্শ লিপিবদ্ধকারী ডা. লয় জোভানোভিক বলেন এ কথা।
ক্যালিফোর্নিয়ার সান্তাবারবারায় সানসুম ডায়াবেটিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের প্রধান বিজ্ঞানী ও নির্বাহী কর্মকর্তা জোভানোভিক আরও বলেন, ‘গর্ভকালে ডায়াবেটিস থাকলেও চিহ্নিত না হওয়া এবং রক্তের উচ্চমান সুগার থাকলেও শনাক্ত না হওয়ার জন্য পরবর্তীকালে মা ও শিশুর ঘটে নানা ধরনের জটিলতা।’ সবচেয়ে ভয়াবহ জটিলতাগুলো হলো, গর্ভের ভ্রূণের অস্বাভাবিক গঠন, গর্ভের শিশুর মৃত্যু বা অস্বাভাবিক বাড়ন বা বিকাশ। গর্ভের ভেতরে শিশুর বাড়ন এবং অতিবাড়ন—দুই ধরনের জটিলতাই হতে পারে।
জোভানোভিক আরও বলেন, ‘এই গাইডলাইন প্রয়োজন ছিল এ কারণে যে, গর্ভকালে ডায়াবেটিস বা রক্তে সুগার বেড়ে গিয়ে গর্ভের জটিলতা বিশ্বজুড়ে এখন শতকরা দশ ভাগেরও বেশি ক্ষেত্রে ঘটছে। গর্ভকালে প্রধান চিকিত্সাসমস্যা যেগুলো হয়, এর প্রায় কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে ডায়াবেটিসজনিত জটিলতা।
দুই ধরনের সমস্যাই পরবর্তীকালে মায়ের বা শিশুর অ্যাডাল্ট মেটাবলিক সিনড্রোম বা ডায়াবেটিস ঘটাতে পারে।
ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিক ফেডারেশন (আইডিএফ) মুখের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য জরুরি পরামর্শ দিয়েছেন, আর টাইপ-২ ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য বিশেষ করে নিজের রক্তের সুগার নিজে তদারক করার পরামর্শ দিয়েছেন।
ডায়াবেটিক রোগীদের দাঁত ও মাড়ির সঠিক পরিচর্যা নেওয়া শিক্ষা দিতে হবে। মুখগহ্বরের স্বাস্থ্য ভালো না থাকলে মাড়ির প্রদাহ (জিনজিভাইটিস) হতে পারে। তা থেকে ক্রমে হতে পারে বড় রকমের প্রদাহ, সংক্রমণ এবং ক্রমে ক্রমে ‘পেরিওডোন্টাল রোগের’ মতো জটিলতা। প্রদাহ হলে ইনসুলিন সংবেদনশীলতা কমে যায় এবং এভাবে দেহের অভ্যন্তরে রক্ত-গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণে ঘটে গোলযোগ।
আইডিএফ সহসভাপতি ও ওরাল হেলথ গাইড লাইনস গ্রুপ কমিটির চেয়ারম্যান ডা. ম্যাসিমো ম্যাসি ব্যানিডিটি বলেন, যাঁদের ডায়াবেটিস আছে তাঁদের নিয়মিত পরিচর্যার সময় মুখের স্বাস্থ্যের দিকটা অবহেলিত হয়। তাঁর বক্তব্য, গবেষণার মাধ্যমে এর সঠিক সূত্রটি এখনো নিরূপিত না হলেও ডায়াবেটিস, ‘পেরিওডোন্টাইটিস’ রোগের সূচনা ও অগ্রগতি বেশ অনুকূলভাবে প্রভাবিত করে।
তাই সাধারণ মানুষের মধ্যে মুখের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার নীতিটি জোরদার করে বোঝানো এবং এটি প্রয়োগের চেষ্টা করতে হবে।
অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরী
পরিচালক, ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস, বারডেম হাসপাতাল, সাম্মানিক অধ্যাপক
ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ, ঢাকা
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, অক্টোবর ২৮, ২০০৯
Leave a Reply