ক্যানসার জয় করা খুব কঠিন হলেও যত্নে ও সঠিক চিকিত্সায় সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য। প্রাথমিক অবস্থায় রোগ নির্ণয় করা গেলে কাজটি আরও সহজ হয়ে যাবে।
আমি একজন অত্যন্ত জ্ঞানী-গুণী, ক্যানসারকে পরাজিত করা বয়োজ্যেষ্ঠ মানবদরদির সাহচর্য পেয়েছি। তাঁকে এ দেশের প্রায় সবাই চেনে। ব্যারিস্টার রফিক-উল হক। তাঁকে দেখে যেকোনো সাধারণ নাগরিক সহজেই বুঝতে পারে যে ক্যানসার দুরারোগ্য হলেও নিরাময়যোগ্য ব্যাধি। ক্যানসার থেকে মুক্ত হয়ে মৃত্যুঞ্জয়ীরা সাধারণ নাগরিকদের মতোই সুস্থ জীবন যাপন করতে পারেন। এ প্রসঙ্গে একটা বিশেষ তথ্য সবারই জানা উচিত। তাঁরা সমাজের যেকোনো কর্মকাণ্ডে, অর্থাত্ চাকরিতেও স্বাভাবিক জীবন যাপন করেন। যদি কোনো কর্মকর্তা কোনো ক্যানসার-জয়ী চাকরিজীবীকে তাঁর কাজ ও কর্তব্য থেকে বিরত রাখেন বা অব্যাহতি দেন, তাহলে সেই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় গ্রহণ করা যেতে পারে। কোনো ক্যানসার-জয়ী এ ধরনের অসুবিধায় পড়লে আমাদের অনকোলজি ক্লাবের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তাঁকে সবরকম আইনি সহায়তা দেওয়ার জন্য আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
তবে ক্যানসার চিকিত্সা দিন দিন ব্যয়বহুল হয়ে দাঁড়াচ্ছে। চিকিত্সার আগের খরচও নেহাত কম নয়। আধুনিক প্রযুক্তিতে নতুন নতুন আবিষ্কারে এই ব্যয়ভার বিপুলভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। গবেষণাগারে রোগ নির্ণয়ের চাবিকাঠিটি ঘোরাতেও প্রযুক্তি দিন দিন অগ্রসর হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, একেবারেই নতুন পদ্ধতি সিটি-পিইএল স্ক্যানের নাম নেওয়া যেতে পারে। এ প্রযুক্তিটি দেশে এখনো চালু হয়নি। তবে কাছের দেশগুলোয় এর একটি স্ক্যানের খরচ প্রায় ৩০ হাজার থেকে এক লাখ টাকার মতো। খুব সহজ ভাষায় বললে, কখনো সুচিকিত্সার ফলে ক্যানসারের জীবাণু ধ্বংস হলেও সেই ধ্বংসস্তূপের মধ্যে কোনো জীবন্ত বা সুপ্ত ক্যানসার টিস্যু কিংবা অনুকোষ আছে কি না, তা বুঝতে গেলে একমাত্র উপায় সিটি-পিইএল স্ক্যান।
এটি বিক্রি করে একটি বিদেশি সংস্থা। বর্তমানে সংস্থাটি একটি অমানবিক নীতিমালায় প্ররোচিত হয়ে আমাদের জন্য কোনো সহায়তার হাত বাড়াচ্ছে না। তারা মুখে বলে সাহায্য করবে কিন্তু এখন পর্যন্ত তারা এ ব্যাপারে এক পা অগ্রসর হয়নি। এটা খুবই দুঃখজনক।
এটা মনে রাখা উচিত, বাংলাদেশে প্রায় বারো লাখ লোক ক্যানসারে আক্রান্ত। যে পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ক্যানসারে আক্রান্ত হয়, তাদের রোগ নির্ণয় ও চিকিত্সাব্যয় প্রায় আকাশচুম্বী এবং মধ্য বা নিম্নবিত্তের আয়ের পরিবার এতে নিঃস্ব হয়ে পড়ে।
ক্যানসার প্রতিরোধের নিয়ম সম্পর্কে সচেতন হলে আমরা এই বিশাল বিপদ থেকে মুক্ত থাকব। যে কয়টা নিয়ম মানা একেবারেই প্রয়োজন, সেগুলো মানা কোনো কঠিন কাজ নয়। যেমন—
তামাক ও ধূমপান সর্বতোভাবে পরিত্যাগ করতে হবে। সেই সঙ্গে পান-সুপারি, জর্দার অভ্যাস চিরতরে বন্ধ করতে হবে।
খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে সর্বদা সচেতন থাকতে হবে। গ্রামের মানুষ সাধারণত শাক, ভাত, ডাল ও মাছ খেয়ে জীবন নির্বাহ করে। সেই সঙ্গে সামান্য গাজর, লেবু, সালাদ বা দেশীয় ফলমূল খেলে খাবারটা অত্যন্ত সুষম হবে। মনে রাখা প্রয়োজন, তামাক ও ধূমপান বর্জন করে সুষম খাদ্যাভ্যাস করে আমরা প্রায় ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রে ক্যানসার থেকে মুক্ত থাকতে পারি।
সুষম খাদ্যাভ্যাসের পরিপ্রেক্ষিতে শহরের বিশেষ করে ধনী সম্প্রদায়ের জন্য একটা সাবধানবাণী আমি সর্বদা বলে থাকি। এই সম্প্রদায়ের বেশির ভাগ মানুষই তাদের খাবারের ব্যাপারে উদাসীন থাকে এবং বাবুর্চির মর্জি অনুযায়ী খাবারের মেন্যু হয়ে থাকে। এ ছাড়া বিরিয়ানি, পোলাও, চর্বিওয়ালা খাসি, গরুর মাংস, মিঠাই-মণ্ডা, আইসক্রিম ও ফাস্টফুডের দোকানে অস্বাস্থ্যকর খাবারের বদভ্যাসের প্রায় প্রতিযোগিতা অনেক ধনী সম্প্রদায়ের সন্তানদের মধ্যে বিদ্যমান। ফলমূল, মাছ, ডাল, দুধ ও ভাত—এগুলো গরিবের খাবার বলে মনে করে অনেকে। সেই সঙ্গে মোটরগাড়ি ব্যবহারের সুযোগে শারীরিক পরিশ্রমের বালাই নেই বললেই চলে। এ ধরনের জীবন যাপনে হূদরোগ ও ক্যানসারের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। এ ক্ষেত্রে সচেতনতা বৃদ্ধি নিতান্তই প্রয়োজন। সচেতন হয়ে এই অভ্যাসগুলো বর্জন করা খুব একটা কঠিন হবে না। সহজ ভাষায়, দৈনিক নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম ক্যানসার প্রতিরোধের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
আমাদের পরিবেশ সাধারণত শহরগুলোয় খুবই কলুষিত। তাই কলুষমুক্ত পরিবেশে ফিরে যাওয়া বেশ কঠিন। তবে কয়েকটা পদক্ষেপে আমরা ধীরে ধীরে কলুষমুক্ত পরিবেশের দিকে ফিরে যেতে পারি। কলকারখানার বর্জ্য ও গাড়ির কালো ধোঁয়া, ক্যানসার ছড়ায় যেকোনো রাসায়নিক, সার ও কীটনাশক সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করা সরকারের প্রধান দায়িত্ব। এ ব্যাপারে গণসচেতনতামূলক আন্দোলন গড়ে তুললে দেশের মঙ্গল হবে। সুখের কথা, পরিবেশ বাঁচানোর আন্দোলন সব দেশেই পথেঘাটে আজকাল দেখা যায়।
প্রতিটা ক্ষেত্রেই গণসচেতনতার কথা উঠে আসে। এই সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য রাষ্ট্রীয় কর্তব্যের প্রয়োজন রয়েছে। গণসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য একটা নতুন কাঠামো প্রয়োজন। মাঠপর্যায়ের লোকবল আমাদের কিন্তু খুব কম নয়। বেসরকারি সংস্থার মাঠকর্মী, পরিবার পরিকল্পনার লোকবল, পুলিশের সহকারী, চৌকিদার-দফাদার এবং এ-জাতীয় মাঠকর্মীকে সামান্য কিছু ভাতা দিয়ে প্রশিক্ষণ দিলেই কাজটা সহজ হবে। গ্রামে গ্রামে স্বেচ্ছাসেবী তৈরি করে তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন, যাতে ক্যানসারবিরোধী কার্যক্রম সাধারণ মানুষ পালন করে কি না সেদিকে নজর রাখা যায়।
যদিও আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় যে আর্থিক দিক থেকে এসব ব্যবস্থা সহজেই করা যায়। কিন্তু এসব ব্যবস্থার জন্য একটা বাজেট প্রণয়ন করলে বোঝা যাবে যে মোট খরচ অনেক বেশি এবং এই দুর্মূল্যের বাজারে সরকারের পক্ষে এ ব্যয়ভার বহন করা প্রায় অসম্ভব। এ কারণে আমি প্রথম থেকেই নতুন কিছু পরিকল্পনা এর আগেও প্রকাশ করেছি।
ক্যানসার কর
একটা আইন করে ক্যানসার করের প্রবর্তন করতে হবে। শতকরা ১০ ভাগ করের আওতায় প্রস্তাব করা যেতে পারে।
চার বা পাঁচ তারকা হোটেলের বা রেস্তোরাঁর প্রতিজনের খাবারের বিলের ওপর এবং এই হোটেলে রাত যাপনের খরচের ওপর কর।
সিগারেটের প্যাকেটের ওপর। যেকোনোভাবে তামাক বিক্রির ক্ষেত্রেও এ ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।
বিমানের প্রতিটা বিজনেস ও প্রথম শ্রেণীর টিকিটের ওপর।
মদ বিক্রির প্রতিটা বোতল ও গ্লাস বা পেগের ওপর।
রেলের প্রথম শ্রেণীর শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কক্ষের প্রতিটা আসনের যাত্রীর ভাড়ার ওপর।
যে অনুষ্ঠান বা ভোজসভার খরচ তিন লাখ টাকার ওপরে।
শীতাতপনিয়ন্ত্রিত গাড়ি বিক্রির সময় গাড়ির মূল্যের ওপর।
শতকরা পাঁচ ভাগ ক্যানসার কর ধার্য করা উচিত
যেসব রেস্তোরাঁয় প্রতিবার খাওয়ার জন্য ৪০০ টাকা দিতে হয়।
শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বাসের প্রতিটি সিট ভাড়ার ওপর।
বড় টিভি, দামি ক্যামেরা, দামি মোবাইল, দামি শাড়ি-গয়না, হাতঘড়ি, কলম, শীতাতপনিয়ন্ত্রণযন্ত্রের মূল্যের ওপর।
ব্যাংকের লেনদেন ৫০ লাখ টাকার ওপর হলে।
লাখের ওপর যেকোনো ঠিকাদারি কাজের ফরম ও কাজের বিল পাওয়ার সময়।
শতকরা দুই ভাগ কর ধার্য করা যেতে পারে
তামাক জন্মানোর জন্য উত্সাহিত করে দাদন দেওয়ার সময়।
উড়োজাহাজে ব্যবহূত কীটনাশকের ওপর।
১৫ বছরের বেশি পুরোনো বাস, মিনিবাস, ট্যাক্সিক্যাব বা ট্রাকের নিবন্ধনের সময়।
ইটের ভাটার ইট বিক্রির ওপর।
যেকোনো রাসায়নিক দ্রব্য, ফরমালিন বা এসিড বিক্রির ওপর।
খাসি বা গরুর মাংসের ওপর, বিশেষ করে কোনো ক্রেতা যখন পাঁচ কেজির বেশি মাংস কেনে।
প্রকাশ্যে যারা ধূমপান করবে তাত্ক্ষণিক ১০০ টাকা জরিমানা করা যেতে পারে। এই টাকা ক্যানসার কর বলে গণ্য করা যাবে। গাড়ি চালানোর সময় ধূমপানরত চালক ও উপস্থিত মালিক, উভয়কে ২০০ টাকা করে জরিমানা করা যেতে পারে।
এভাবে চিন্তাভাবনা করে ক্যানসার করের আওতায় আরও কিছু করা যেতে পারে। এই করের মূলমন্ত্র হবে, যেকোনো মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত মানুষকে অহেতুক করের বোঝা যেন বহন না করতে হয়। তবে তার বদভ্যাস ত্যাগ করার জন্য তাকে সব ধরনের সহায়তা করা হবে।
এই কর প্রণয়ন করে ক্যানসারবিরোধী কার্যকলাপ ছাড়াও এই তহবিল থেকে শতকরা ৩০ ভাগ সরিয়ে রেখে তা থেকে ক্যানসারের ওষুধ এ দেশেই তৈরি করার জন্য একটা আধুনিক কারখানা তৈরি করা সম্ভব। এতে মাত্র ৭০ থেকে ৮০ কোটি টাকার মতো খরচ হবে। তবে সরকার অনুরোধ করলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এ কাজে এগিয়ে আসবে, এমন প্রতিশ্রুতি আমরা পেয়েছি।
এ বি এম এফ করিম
ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ও অধ্যাপক
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, অক্টোবর ১৪, ২০০৯
Leave a Reply