বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অব মেন্টাল হেলথ অন্যান্য বছরের মতো এবারও ১০ অক্টোবর বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস পালন করেছে। এ বছরের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যায় মানসিক স্বাস্থ্য: চিকিত্সা সম্প্রসারণ ও মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন’। বর্তমান সময়ে সমগ্র পৃথিবীতে প্রায় ৪৫০ মিলিয়ন মানুষ কোনো না কোনো মানসিক সমস্যায় ভুগছে আর বাংলাদেশে মানসিক রোগীর হার হচ্ছে মোট প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার প্রায় ১৬.১ শতাংশ।
১৯৪৮ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ‘স্বাস্থ্য’র যে সংজ্ঞা দিয়েছিল তা আজও অমলিন। সেখানে বলা হয়েছিল, ‘কেবল নীরোগ থাকাটাই স্বাস্থ্য নয়; বরং শারীরিক, মানসিক, আত্মিক ও সামাজিকভাবে ভালো থাকার নামই স্বাস্থ্য।’ অথচ কার্যত এই সংজ্ঞাটির খণ্ডিত ব্যাখ্যা দেওয়া হয় প্রতিনিয়ত, কখনো সচেতনভাবে আবার কখনো অসচেতনতায়।
ফলে দীর্ঘদিন ধরে ‘স্বাস্থ্য’ শব্দটি সীমাবদ্ধ হয়ে ছিল ‘শারীরিক’ অংশটুকুর মধ্যে। তবে আশার কথা এই যে, উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেরিতে হলেও বাংলাদেশে ‘মানসিক স্বাস্থ্য’ বিষয়টি ধীরলয়ে প্রবেশ করছে স্বাস্থ্যব্যবস্থার মূল আঙিনায়।
১৯৭৮ সালে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের আলমা প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার খুঁটিনাটি বিবৃত হয়েছিল। প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার উপাদানের মধ্যে ছিল স্বাস্থ্যশিক্ষা, রোগনিয়ন্ত্রণ, সম্প্রসারিত টিকা কার্যক্রম, মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্যের উন্নয়ন, প্রয়োজনীয় ওষুধের সরবরাহ নিশ্চিত করা, পুষ্টি ও পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করা এবং সাধারণ রোগের চিকিত্সা। আপাতদৃষ্টিতে এগুলোর মধ্যে সরাসরি মানসিক স্বাস্থ্যের কথা বলা না হলেও প্রায় প্রতিটি উপাদানের সঙ্গেই মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি জড়িত।
সাধারণ স্বাস্থ্যশিক্ষা কখনোই পূর্ণাঙ্গ হবে না, যতক্ষণ মানসিক স্বাস্থ্যশিক্ষা না হচ্ছে। রোগ নিয়ন্ত্রণ করতে হলে শারীরিক-মানসিক সব রোগকেই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, বিশেষত কিছু শারীরিক সমস্যায় মানসিক রোগ-লক্ষণ প্রকাশ পায়, আবার কিছু মানসিক সমস্যা শারীরিক লক্ষণ নিয়ে প্রকাশ পেতে পারে। মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটাতে পারলে শিশুর মানসিক প্রতিবন্ধকতাসহ নানা জন্মগত ত্রুটির পাশাপাশি মায়ের প্রসব-পরবর্তী মানসিক সমস্যা দূর করা সম্ভব।
পুষ্টিমান নিশ্চিত করা না গেলে বুদ্ধির বিকাশ ও মানসিক বৃদ্ধি যেমন ব্যাহত হয়, তেমনি অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে মানসিক সুস্থতা বজায় থাকে না। অপরিহার্য ওষুধের সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং বিভিন্ন ওষুধের অপব্যবহার রোধ করাও প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার অংশ ছিল সেই ১৯৭৮ সাল থেকে। কিন্তু হঠাত্ করেই আবার প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যায় মানসিক স্বাস্থ্যের সরাসরি অন্তর্ভুক্তি কেন?
এ জন্য আগেই বলেছি, কেবল বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের সর্বত্র মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়টি নানা কারণে অন্ত্যজ হয়ে আছে, আর আমাদের দেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে মানসিক রোগ নিয়ে আছে নানা অন্ধবিশ্বাস, মিথ ও অপচিকিত্সার ছড়াছড়ি। তাই প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যায় মানসিক স্বাস্থ্যকে সক্রিয়ভাবে উপস্থাপন করাই এ বছর বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসের লক্ষ্য।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রচারপত্রে মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার অন্তর্ভুক্ত করার পক্ষে সাতটি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। কারণগুলো হচ্ছে—
মানসিক রোগের আধিক্য
মানসিক ও দৈহিক স্বাস্থ্য সমস্যা এবং দেহ-মনের পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া
মানসিক রোগের চিকিত্সা গ্রহণে অনাগ্রহ ও চিকিত্সা না পাওয়া
মানসিক রোগের চিকিত্সা সহজলভ্য করা
মানসিক রোগীর মানবাধিকার নিশ্চিত করা
মানসিক স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় হ্রাস
প্রাথমিক পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম থাকলে সার্বিক স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়ন।
আহমেদ হেলাল
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, অক্টোবর ১৪, ২০০৯
Leave a Reply