ফাগুন এল বলে। ফাগুনের প্রথম দিনটা এখন ভালোই বোঝা যায় নাগরিক জীবনে। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় তো বটেই; চলতি পথে, অফিস-আদালতে মেয়েদের ছেলেদের পোশাক-আশাক বরণ করে নেয় বসন্তের প্রথম দিনটাকে। আর মেয়েদের চুলে অনিবার্য হয়ে ওঠে ফুল।
বসন্তবরণের কয়েক দিন পরই একুশে ফেব্রুয়ারি। শহীদ মিনারের বেদি ভরে ওঠে ফুলে ফুলে। প্রভাতফেরিতে সবার হাতে হাতে ফুল। এত মানুষ এত ফুল—বসন্ত বলে কথা।
এত ফুলের জোগান আসে কোত্থেকে? বড় একটা জোগান আসে যশোর অঞ্চল থেকে। এ কথা জানা ছিল। তাই আমাদের চারজনের দলটি অনেক দিন পর যখন যশোর ঘোরার সিদ্ধান্ত নিল, তখন ঢাকাতেই আহমেদ হাসান বললেন, ফুলের চাষ যেখানে হয়, সেখানে যাব। এর আগে ২৭ জানুয়ারি সন্ধ্যায় যশোর থেকে কেশবপুর হয়ে আমরা যাই সাগরদাঁড়ি—মধুকবির বাড়ি। ২৫ জানুয়ারি মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্মদিন উপলক্ষে এর আগে-পিছে সাত দিন ধরে চলে মধুমেলা। না গেলে বোঝা যাবে না। মধুসূদনের বাবা রাজনারায়ণ দত্তের ভিটেবাড়ি ঘিরে কপোতাক্ষ নদের তীরে এ যেন এক মহাযজ্ঞ। লোকজ মেলা, মধুসূদন নিয়ে আলোচনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখতে লাখো মানুষের ভিড়। মধুমেলা দেখে ফিরতে ফিরতে রাত ১০টা।
আমাদের দলে বিশ্বজিৎ মুনশী আর জাবেদ সুলতানের আগ্রহ ফুলের পাইকারি বাজার মানে আড়ত নিয়ে। প্রথম আলোর যশোর প্রতিনিধি মনিরুল ইসলাম জানালেন, সকাল সাতটার মধ্যেই যেতে হবে ফুলের বাজার দেখতে। জায়গাটা ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালী। বিখ্যাত সেই যশোর রোডের ওপরেই।
যশোর থেকে বেনাপোলের দিকে যে সড়কটি গেছে, সেটা এমনিতে সুন্দর। প্রাচীন সব গাছ ছায়া বিছিয়ে আছে সড়কময়। তবে এখন কিছুটা পত্রহীন। এই সড়কে ১৮ কিলোমিটার গেলেই গদখালী বাজার। সড়কের ওপর ভোর থেকেই বসে ফুলের আড়ত। এখান থেকেই ফুল যায় ঢাকার খামারবাড়ীর পাইকারি বাজারে। আগে যেত শাহবাগে। সাইকেল, রিকশা, নছিমন, ভ্যান-রিকশা—নানা যানবাহনে আশপাশের ফুলখেত থেকে সব রকম ফুল আসে এই বাজারে। ২৮ জানুয়ারি বাজারে দেখা গেল কয়েক রডের গ্ল্যাডিওলাস, গাঁদা, রজনীগন্ধা, গোলাপ, জিপসি আর জারবারা। সবই এখানে প্রতি শ বা প্রতি হাজার হিসাবে বিক্রি হয়। পুরো বাজার ফুলে ফুলে রঙিন আর সৌরভে ভরা। মহাসড়কের ওপর শাকসবজির বাজার হয়তো চোখে পড়ে, কিন্তু ফুলেল বাজার আছে এই গদখালীতে। জানা গেল, মেহেরপুরের মুজিবনগরে গাঁদা ফুলের এমন বাজার নাকি আছে।
গদখালীর ফুল ব্যবসায়ী মো. সুজন রেজা জানালেন, প্রতিদিন ৮ থেকে ২০ লাখ টাকার ফুল কেনাবেচা হয়। সব ফুলচাষি এখন প্রস্তুত হচ্ছেন একুশে ফেব্রুয়ারি আর তার আগের পয়লা বসন্তের জন্য। ওই দিনগুলোর জন্য ফুল সরবরাহের প্রস্তুতি নিচ্ছেন সবাই।
বাজার দেখা হলো। ফুলের খেত দেখতে হবে এবার।
দু-তিন কিলোমিটার এগিয়েই মহাসড়ক থেকে দেখা গেল বাসন্তী রঙের খেত। গাঁদার চাষ হচ্ছে সেখানে কয়েক বিঘা জমিতে। জানা গেল, গদখালী বাজার ঘেঁষে বাঁ দিকে যে সড়কটা গেছে, সেটা ধরে গেলে আরও অনেক ফুলেল জমি পাওয়া যাবে। আমরা তাই চললাম পানিসারা গ্রামের দিকে। একের পর এক গোলাপ, গ্ল্যাডিওলাস খেত। মনে হলো, ক্যালেন্ডারে দেখা বিদেশের পুষ্পভরা কোনো বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বুঝি চলে এসেছি। রঙিন সব ফুল ফুটেছে প্রতিটি খেতে। পাওয়া গেল এস এন ফ্লোরিটেকের জারবারা ফুলের নার্সারি। নার্সারির স্বত্বাধিকারী শের আলী সরদার জানালেন, জারবারার একেকটা গাছ পাঁচ বছর বাঁচে। এর মধ্যে অনেকবারই ফুল সংগ্রহ করা যায়। ভারতের পুনে থেকে প্রতিটি চারা তিনি কিনে এনেছেন ১০০ রুপি করে। তারপর গ্রিন হাউস বানিয়ে ফোটাচ্ছেন জারবারা ফুল। লাল, বেগুনি, নীল, সাদা, হলুদ, কমলা—কী রঙের জারবারা নেই এই নার্সারিতে! গদখালী থেকে পানিসারা কয়েক কিলোমিটার রাস্তার দুই পাশজুড়েই পুষ্পভরা খেত। যশোরে গেলে রঙিন এ অঞ্চল ঘুরে আসা যায় সহজেই। নিয়ে আসা যায় রঙিন কিছু অভিজ্ঞতা।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারী ০৮, ২০১০
Leave a Reply