শিশুপাঠে হস্তলিপির বহু পুরাতন এক বাক্য ‘পানির আরেক নাম জীবন’। শুধু বিশুদ্ধ পানি পান করেই ক’দিন প্রাণ ধরে রাখা যায়। আয়ুর্বিজ্ঞানও তাই বলে। তথাপি স্থান বিশেষে পানির গুরুত্ব ভিন্নতর, কোথাও কম, কোথাও বা বেশি। পার্বত্য এলাকাবাসীর দুরস্থিত পাহাড়ি ঝরনা বা ছড়ায় গোসল কাপড় কাচা সেরে হাঁড়ি-কলসি মাথায়ণ্ডকাঁখে করে রান্নাবান্না ও খাবার পানি নিয়ে আসতে দেখা যায়। আবার যারা একটু স্বচ্ছল তারা পয়সার বিনিময়ে লোক দিয়ে পানি আনিয়ে নেন। তাদের কারো বাড়িতেও থাকে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার জন্য টিনের চালের সঙ্গে টুলি দিয়ে সংযোগকারী টিন-নির্মিত বড় পানিধার। অপেক্ষাকৃত উন্নত পার্বত্য এলাকায় থাকে কতিপয় আবাস বা অফিসাদিতে পাইপের পানি সরবরাহ ব্যবস্থা। মাঝে মধ্যে সরবরাহ ব্যবস্থায় বিভ্রাট দেখা দিলে উৎস থেকে পানি বয়ে এনে সামাল দিতে হয়।
এমনকি দেশের উন্নত বড় শহর বা নগরের উঁচু ভূমিতে অবস্থিত অভিজাত আবাস বা বহুতল ভবন যেখানে গভীর নলকূপ কার্যকরী নয় সেখানে সরবরাহ বিভাগের পাইপের পানিই ভরসা। এমত সরবরাহে আকস্মিক বিপর্যয় দেখা দিলে প্রাইভেট ক্যারিয়ার পয়সার বিনিময়ে দুরস্থিত সমতল অঞ্চলের সংরক্ষিত কৃত্রিম লেক বা বৃহৎ জলাশয় থেকে ট্যাঙ্কার করে পানি এনে আবাসনের পানিধার পূর্ণ করে দিয়ে যায়।
আবার দেশের অনেক স্থান আছে যেখানে পানির উৎস যেমন ভাল, সরবরাহ ব্যবস্থাও সুদূর প্রসারী পরিকল্পনায় তেমনি উন্নত। এমনকি পথিপার্শ্বে সাধারণভাবে নির্মিত প্রস্রাবাগার (সুলভ শৌচালয় নয়) ও অনবরত ফ্লাশ হচ্ছে।
ভিন বিপরীত চিত্রও আছে। পাবলিক টয়লেট আছে, কিন্তু পানি ব্যবস্থা নিশ্চিত নয়। পানির অভাবে অচিরেই এমত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। প্রকৃতির সাড়ায় না জেনে কেউ সেখানে ঢুকে পড়লে তার কদর্য রূপ দেখে দৌড়ে বেরিয়ে হাঁফ ছাড়েন। নিরবচ্ছিন্ন পানি ব্যবস্থা না থাকায় বড় বড় রেলওয়ে জংশন স্টেশনেরও অপেক্ষমান যাত্রীদের টয়লেট সম্বন্ধে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়ে থাকে। বিগত দিনে, বিশেষত বিদ্যুৎ ব্যবস্থার আগে, কৃত্রিম উপায়ে পানি সরবরাহ প্রণালী প্রায় ছিলই না। সমতল অঞ্চলের গ্রাম বা মফস্বল শহরে বাড়ির ভিটে হত পুকুর খনন করেই। আর এ পুকুরই সংসারের নিত্যদিনের পানির সব চাহিদা মেটাত। হাঁড়ি কলসিতে পানি ভরে এনে পুটলি বাঁধা ফিটকিরি ঘুরিয়ে দিলেই পানীয় পানি হয়ে যেত। পুকুরকে দূষণমুক্ত রাখার প্রয়াসও থাকত। শীত-গ্রীষ্মে পানি নেমে দূষিত হওয়ার আশঙ্কায় পুকুরে চুন ছড়িয়ে নতুবা কলাগাছ (যাতে ক্ষার থাকে) কেটে ভাসিয়ে দেয়া হত। আবার বড় শহর বা নগর যেখানে ঘনবসতি এবং বাসযোগ্য জমিও দুর্লভ্য সেখানে থাকত অনেক সর্বজনীন বৃহৎজলাশয়। তার মধ্যে কতক থাকত পানীয় পানির জন্য সংরক্ষিত। ব্যাক ওয়াটার সিস্টেমে বাঁধা ঘাটও থাকত যাতে ঘাটে ব্যবহৃত পানি তার জলাশয়ে পড়ে পানিকে দূষিত না করে। সেদিনে পানি রক্ষক বলে একটা পদও ছিল যারা পুকুর, বিল ও খালের দেখাশোনা করতেন এবং কৃষিজমিতে পানি সেচ বন্টন করে দিতেন।
নদীর তীরে যাদের বাস তারা নদীর পানি দিয়েই কাজ সারতেন। নদীর পানিতে প্রদূষণ কথাটাও শুনা যেত না। তাই বোধহয়, জননী সারদার এক কথা প্রসঙ্গেই উপমা ছিল ‘গঙ্গা তীরে বাস করিয়ে কূপ করিতেছ কেন? কিছুদিন আগেও অন্তত মধ্যবিশ্বের আনুষ্ঠানিক ভোজের আসরে যে পানীয় জল দেয়া হত তা উপরোক্ত কোন জলাশয় থেকে তুলে আনা পানি। বড় জোর ফিটকিরি কর্পূর দিয়ে শোধন করা হত। কারো মনে কোনো দ্বিধা ছিল না। এখন যে লোকের আস্থা চলে গেছে তা বুঝা যায়। মিনারেল ওয়াটার না হলে লোকে স্বস্তি পান না।
বর্তমানে দেশে তীব্র পানি সঙ্কটের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন মিডিয়ার রিপোর্টে জানা যায় মহানগরী ঢাকাতে মাত্র ৫৫ শতাংশ আবাসিকের সরবরাহের পানির কানেকশন আছে। অন্যান্য ছোট-বড় শহর নগরেও পাইপের পানির সরবরাহের হার তার আপশাপেই হবে। এটা স্বীকার করে নিতে হবে যে বিশুদ্ধ পানীয় জল পান করা অতি আবশ্যক। কিন্তু সত্যি বলতে দ্বিধা নেই যে আমাদের দেশের শতকরা ৮০ জন লোকই বিশুদ্ধ পানীয় জল থেকে বঞ্চিত। কথাটার যথার্থতা প্রমাণিত হয় ফি বছর শীত, বসন্ত শেষে এবং গ্রীষ্মের শুরুতে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশিত সংবাদে। আজ একুশ শতকের আধুনিক জমানায় সরকারি ও প্রাইভেট ব্যবস্থায় সীমিত পাইপের পানি সরবাহের কারণে প্রায় পরিত্যক্তভাবে এখনো টিকে থাকা সে পুরোনো দিনের সর্বজনীন জলাশয়গুলো বৃহৎ অংশের পানির চাহিদা সমানতালে মিটিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেগুলো সংস্কারের অভাবে মজতে থাকা এবং ক্রমাগত আবর্জনা নিক্ষেপে ভরতে থাকা সত্ত্বেও নিরূপায় লোক শেষ বিন্দু পর্যন্ত তার পানি ব্যবহার করে চলছেন। এমত দৃশ্য আজকাল সর্বত্রই প্রায়ই দেখা যায়। সকাল থেকে রাত অবধি লোক এসব সর্বজনীন টিকে থাকা পুকুরঘাটে গোসল কাপড় কাঁচা সেরে হাড়ি-কলসিতে করে প্রয়োজনীয় পানি নিয়ে যাচ্ছেন। পানিবাহী শ্রমিকরাও বাড়ি-ঘর, দোকানপাট, হোটেল, রেস্টুরেন্ট ইত্যাদি ভারে করে বা ঠেলায় করে এসব জলাশয়ের পানিই যোগান দিচ্ছেন।
সহজ কথাটা আমরা মানতে নারাজ যে এসব জলাশয়ই বৃষ্টির পানির আধার। শুকনো মও০শুমে পানি নেমে গেলে বর্ষায় আবার টইটুম্বর হয়ে উঠে। লোকেরা নিশ্চিন্তে এসব জলাশয়ের উপরই বেশি নির্ভরশীল। প্রয়োজন শুধু দেখভাল করে এসব জলাশয়ের পানি ব্যবহার উপযোগী করে রাখা। বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমানে পাইপের পরিশোধিত পানি সরবরাহ যেখানে সীমিত এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, তখন বিভিন্ন জলাশয় বা পানিধার মারফত বৃষ্টির পানি আহরণও আবশ্যক এবং এতে আরো উন্নত প্রণালী প্রয়োগের দরকার। তাই আজকের দিনের বহুল আলোচিত বিষয় ‘রেইন ওয়াটার হারবেস্টিং’। সুস্থ জলাশয় প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখারও সহায়ক।
দেখা যায়, বিভিন্ন এলাকার পানির চাহিদা মেটাতে পুরোনো প্রথায় আজকের দিনেও সরকারি-ভাবে সর্বজনীন পুকুর খনন করতে হচ্ছে এসব অবশ্য গ্রামাঞ্চলেই বেশি দেখা যায়। কিন্তু আজকাল দেখা যায় শহরাঞ্চলে যেসব বড় বড় দালান বা জলাশয় আছে তা ভরাট করে আবাসন বা অফিস আদালত তৈরি করা হচ্ছে। এটা নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারার মতই অবস্থা। বিশুদ্ধ পানির ব্যাপারে আমাদের সকলেরই উদ্যোগী হতে হবে। আর এ ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য প্রতিবছর ২২শে মার্চ বিশ্বে পানি দিবস পালন করা হয়। কারণ অস্বাভাবিক পানি সঙ্কট এড়াতে সদা সচেষ্ট থাকা প্রয়োজন। সামনে চিন্তা-চর্চার প্রয়োজন।
আগামী দিনে অস্বাভাবিক জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং ধারণাতীতভাবে জলবায়ুর পরিবর্তনে এক ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টিতে পানীয় জলের সঙ্কট আরো তীব্রতর হওয়ার আশঙ্কা। তাই আরো বেশি সতর্কতার প্রয়োজন। আর তা হতে হবে এখন থেকেই, বিলম্ব করা ঠিক হবে না মোটেই।
আফতাব চৌধুরী
[লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট]
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, অক্টোবর ১০, ২০০৯
Leave a Reply