এমন কিছু মানুষ আছেন পৃথিবীতে, আমাদের চারপাশে, কেউ দূরে। এমন সব অসুখ হয়েছে তাঁদের, যে জন্য তাঁদের জীবন একটা সীমার মধ্যে, একটা গণ্ডির মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছে। বেদনাকাতর, অথচ প্রশমনের কেউ নেই, কিছু নেই।
যে অসুখ তাঁদের হয়েছে, এর নিরাময় সাধ্যের মধ্যে নেই, তবু যত দিন এ জীবন তাঁরা টেনে নিয়ে যাবেন, সে সময়টুকু একটু প্রশান্তি, একটু উপশম তাঁদের দিলে কত সুখ যে তাঁরা পাবেন, তা কেবল ঈশ্বরই জানেন। অনিবার্য পরিণতি সামনে রেখেও তাঁরা বেঁচে আছেন। তাঁদের পাশে দাঁড়াতে হবে সবাইকে। কেবল আত্মীয়স্বজন নয়, তাঁদের পাশে চাই কুশলী ও দক্ষ চিকিত্সক এবং চিকিত্সাকর্মীদের, যাঁরা এসব প্রান্তিক রোগের উপশম কীভাবে দিতে হয়, সে সম্পর্কে জানেন।
আছেন মৃত্যুপথযাত্রী মানুষ, বিছানায় লেগে থাকা অস্থিচর্মসার শরীর অনেকের, তাঁদের জন্য উপশম, প্রশমন চাই।
আমাদের প্রাচ্যে প্রান্তিক রোগে নিদারুণ অসুস্থ মানুষের পাশে আজও দাঁড়ায় আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব; কিন্তু এ শুধু কেবলই ভালোবাসা ও দরদে মেশানো পরিচর্যা। এও কম নয়, তবে এর সঙ্গে যদি দক্ষ চিকিত্সাকর্মী কুশলী হাতে প্রশমনের চেষ্টা করেন, তাহলে সেসব মানুষের দুঃখতাপে ব্যথিত চিত্তে কেবল সান্ত্বনা নয়, দেহ-মনে প্রশান্তি ও প্রশমনও হয়। জীবনের শেষ দিনগুলো তাঁদের সহনীয় হয়ে ওঠে।
মানুষের দেহের সঙ্গে মনে-প্রাণে শান্তি দেওয়াটা চিকিত্সার একটি বড় অনুষঙ্গ বিবেচিত হলেও এ ব্যাপারে কুশলী চিকিত্সা, মনোযোগ ও সেই সঙ্গে সব আয়োজন না থাকায় রোগে কাতর মানুষের সার্বিক পরিচর্যার ক্ষেত্রে একটি বড় ফাঁক থেকেই যাচ্ছে।
এ ছাড়া প্রশমন সেবা (প্যালিয়েটিভ কেয়ার)—পুরোটাকে ঘিরে ‘প্যালিয়েটিভ মেডিসিন’ বিষয়ে তেমন গুরুত্ব নেই এ দেশে। গত ৪০ বছরে পৃথিবীতে এ ক্ষেত্রে অনেক অভিজ্ঞতা ও তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে এবং তা থেকে এই চিকিত্সার একটি বৈজ্ঞানিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠার জন্য যুক্তি জোরালো হয়েছে।
তবে অনেক উন্নয়নশীল দেশ, এমনকি বাংলাদেশেও নিরাময়-অযোগ্য ও অসুখে কাতর অনেক রোগীর সমস্যা সমাধানের জন্য তেমন উদ্যোগ নেই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকজন উত্সাহী চিকিত্সক এবং বাইরের আরও কজন চিকিত্সক বিশেষজ্ঞ মিলে একটি প্রশমনকেন্দ্র গড়ে তুলছেন মাত্র। যুক্ত আছেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রবার্ট টাইক্রশ, আর এ প্রকল্পের সঙ্গে আরও যুক্ত ভারতের কেরালার প্যালিয়েটিভ মেডিসিন ইনস্টিটিউট। বাংলাদেশ থেকে গ্রন্থ ও তথ্যকণিকাও প্রকাশিত হয়েছে। এর প্রেক্ষাপটে ১০ অক্টোবর বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে বিশ্ব হসপিস ও প্রশমনসেবা দিবস। হসপিস বা মরণাপন্ন রোগীদের চিকিত্সালয় হলো মৃতপ্রায় বা মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের জন্য গড়ে ওঠা হাসপাতাল—সোজা কথায় প্রশমন নিকেতন।
আর এ বছর এ দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো ‘জেগে উঠুক আপনার কণ্ঠ’। যেসব রোগী দুরারোগ্য রোগে ভুগছেন, তাঁদের স্বজন ও পরিচর্যাকারী যাঁরা রয়েছেন, এই প্রশমন চিকিত্সার ব্যাপারে তাঁদের কথা শোনাই হলো এ দিবস পালনের লক্ষ্য। উন্মোচিত হবে তাঁদের কণ্ঠস্বর, তাঁদের কথা, আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যাশা এবং উঠে আসবে চাহিদা।
কেবল তা-ই নয়, এই বিষয় নিয়ে পৃথিবীজুড়ে ও দেশ-জাতির প্রেক্ষাপটে নীতিনির্ধারকেরা কী ভাবেন, এ ব্যাপারে তাঁদের বক্তব্য কী, তাও আবিষ্কার করা এ দিবস পালনের একটি উদ্দেশ্য। তাঁদের সবারই কণ্ঠস্বর শ্রুত হওয়ার জন্য, সজোরে উচ্চারিত হওয়ার জন্য পৃথিবীর ৭০টি দেশে হবে নানা আয়োজন।
এ দিবসের জন্য বাণী এসেছে জগতের নানা প্রান্ত থেকে গুণীজন ও সংস্থার।
হসপিস ও প্রশমনসেবা রোগীদের গৃহে ও লোকসমাজে নানা প্রেক্ষাপটে দেওয়া হয়। ফলে রোগী ও স্বজনদের জীবনের গুণগত মানের উন্নতি ঘটে। জীবনসংশয়ী রোগে মৃত্যুপথযাত্রী মানুষকে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ পরিচর্যা ও উপশম দেওয়া এসব প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য। দুঃসহ ব্যথা-বেদনায় উপশম দেওয়াও এদের একটি লক্ষ্য। এ জন্য দেওয়া হয় প্রায়োগিক সহায়তা, মনোগত ও আত্মিক অবলম্বন।
জীবনসংশয়ী রোগে যাঁরাই ভুগছেন, তাঁদের সবার জন্য চাই উচ্চমানের হসপিস ও প্রশমনসেবা। মানুষ হিসেবে এ তাঁদের অধিকার। ব্যথা-বেদনা ও দুর্ভোগ প্রশমিত হয়ে স্বস্তি ও মর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকাও তাঁদের অধিকারের পর্যায়ে পড়ে।
এ দুর্ভোগের মধ্যে যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের কথা শোনার জন্য প্রচেষ্টা এ দিবস পালনের আয়োজনে থাকবে। বলবেন এ সম্পর্কে তাঁদের স্বজন, বান্ধব, নীতিনির্ধারকেরা। দেশে দেশে প্যালিয়েটিভ কেয়ার জাতীয় স্বাস্থ্য পরিচর্যা কর্মসূচিতে থাকবে। প্যালিয়েটিভ কেয়ারকে প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যায় অনুর্ভুক্ত করার জন্যও জোরালো আবেদন থাকবে।
জীবনসংশয়ী রোগ, বিশেষ করে ক্যান্সার ও এইচআইভি/এইডস রোগীদের জন্য পরিচর্যা ও প্রশমন অবশ্যই জোরালো দাবির পর্যায়ে পড়ে।
হসপিস ও প্রশমনসেবা সমন্বিতভাবে এমবিবিএস ও স্নাতকোত্তর শিক্ষা কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত হবে—এমন আবেদনও করা হবে এ দিবস পালনের আয়োজনে।
প্রশমন সেবা অন্তিম চিকিত্সা নয়, বরং রোগের চিকিত্সা, যেমন এভিআর বা ক্যান্সার চিকিত্সার সঙ্গেই পরিচর্যা হিসেবে রোগীকে দেওয়া হবে।
আমরা হয়তো লক্ষ করি না, পৃথিবীজুড়ে অসংখ্য মানুষ জীবনসংশয়ী রোগে ভুগছে, অনাবশ্যক ব্যথা-বেদনায় কাতর হচ্ছে। তাদের প্রশমনের জন্য উদ্যোগ নেই। থাকলেও আওতার মধ্যে নেই। উন্নয়নশীল দেশেও এর চাহিদা কিন্তু মোটেও কম নয়। এ কেবল বুড়োদের জন্যই নয়, সব বয়সী মানুষের জন্য।
এই প্রশমনসেবা দেওয়ার জন্য চাই বিশেষজ্ঞ প্রশিক্ষণ। অথচ এ ব্যাপারে সমাজপতি ও নীতিনির্ধারকদের উচ্চকণ্ঠ শোনা যায় না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলে, ক্যানসার নিয়ন্ত্রণের আবশ্যকীয় অংশ হলো প্রশমনসেবা, যা দেওয়া যায় কম খরচে ও সহজে। এইডস রোগীদের জন্য প্রশমনসেবা বড় দুর্বল দেশে দেশে।
প্রশমনসেবা মানে মৃত্যুপথযাত্রীকে মৃত্যুপথে ঠেলে দেওয়া নয়, বরং এর উদ্দেশ্য হলো দুরারোগ্য অসুখ নিয়েও কাউকে যত দূর সম্ভব স্বস্তিতে বেঁচে থাকতে সাহায্য করা।
এই প্রশমন পরিচর্যা মানে কেবল ব্যথা-বেদনার উপশম নয়, যদিও বেদনা প্রশমনের একটি উদ্দেশ্য, তবে এই পরিচর্যার মধ্যে রয়েছে কঠিন রোগে ভুগছে যেসব মানুষ, তাদের মনোগত, সামাজিক, আত্মিক ও প্রায়োগিক চাহিদার প্রতি খেয়াল করা, যথাসম্ভব সমাধান করা।
এই পরিচর্যা নানাভাবে হতে পারে, কেয়ারিং ও শেয়ারিং এর উদ্দেশ্য। উচ্চমূল্য হবে কেন এ পরিচর্যা? কম মূল্যেও এ সেবা দেওয়া সম্ভব। তাই এ দিবসে বিশ্বজুড়ে হসপিস ও প্রশমনসেবাকে সম্প্রসারণ করা হবে লক্ষ্য। এ বিষয়ে রোগীদের কথা শোনানো; নীতিনির্ধারক, সমাজপতি ও বিত্তশালীদের এ উদ্যোগে সাড়া দেওয়ার জন্য উদ্যোগ হবে এ দিবস পালনের উদ্দেশ্য।
এ বিষয়ে গড়ে তুলতে হবে ব্যাপক গণসচেতনতা। এ উদ্যোগ বাস্তবায়নে অর্থ বিনিয়োগের জন্য বিত্তশালী ও অর্থশালী প্রতিষ্ঠানকে আকৃষ্ট করা হবে লক্ষ্য। তাহলে দুঃসহ বেদনায় কাতর মানুষ, দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত মানুষ পাবে কিছুটা হলেও স্বস্তি; পাবে মর্যাদা, পাবে মানুষের অধিকার। তাদের সেবা করে আমরাও হব গৌরবান্বিত।
অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরী
পরিচালক, ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস, বারডেম হাসপাতাল, সাম্মানিক অধ্যাপক
ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ, ঢাকা
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, অক্টোবর ০৭, ২০০৯
Leave a Reply