জীবনে চলতে-ফিরতে যেসব আইনি জটিলতায় পড়তে হয়, পাঠকের উকিল বিভাগে ১৫ দিন পরপর তারই সমাধান পাওয়া যাবে।পাঠকের উকিল বিভাগে আইনি সমস্যার সমাধান দেবেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট নাহিদ মাহতাব। স্পষ্ট করে নিজের সমস্যাটি লিখে পাঠান। প্রয়োজনীয় কাগজের অনুলিপি দিন।
খামের ওপর লিখুন: পাঠকের উকিল, নকশা,
দৈনিক প্রথম আলো, সিএ ভবন, ১০০ কাজী নজরুলইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা।
প্রেম করে বিয়ে করি। আমরা দুজনই প্রাপ্তবয়স্ক। আমাদের বিয়ের ব্যাপারটা কিছুদিন আগে জানাজানি হয়। একপর্যায়ে ওর বাবা ওকে ভয়ভীতি দেখিয়ে জোরপূর্বক কাজি অফিসে নিয়ে তালাকনামায় সই করান। প্রায় এক মাস হয়ে গেল তালাকনামায় সই করিয়েছেন; কিন্তু এর মধ্যে আমার কাছে কোনো তালাকের নোটিশ বা তালাকনামা বা অন্য কোনো কাগজ পাঠাননি। আমার জিজ্ঞাসা, এতে কি তালাক কার্যকর হয়েছে? হয়ে থাকলে কাবিননামায় উল্লিখিত দেনমোহর কি আমাকে পরিশোধ করতে হবে?
স্বপন
সিলেট
চিঠির তথ্য অনুযায়ী আপনাদের তালাক কার্যকর হয়নি। সুতরাং আপনাদের বিয়ে এখনো বৈধ আছে। এখানে আরও উল্লেখ্য, তালাকের সঙ্গে দেনমোহরের কোনো সম্পর্ক নেই। দেনমোহর হচ্ছে স্বামীর কাছে স্ত্রীর এক ধরনের পাওনা এবং তা চাহিবামাত্র পরিশোধযোগ্য।
আমার বড় বোন তাঁর এক ছেলে ও মেয়ে রেখে মারা যাওয়ার পর ওই বোনজামাইয়ের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়। বর্তমানে আমারও এক ছেলে ও এক মেয়ে। আমার স্বামী গত বছর মারা যান। আমি যে বাড়িতে বসবাস করছি, তা আমার বড় বোনের নামে। এখন সেই বাড়ি কি শুধু আগের দুই ছেলেমেয়েই পাবে? না আমার পরের দুই সন্তানেরও অংশ আছে? আর যদি তারা অংশ পায়, তবে কীভাবে তা ভাগ হবে। আমার সব সন্তানের মধ্যেই যথেষ্ট সদ্ভাব এবং বোঝাপড়া আছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
পাবনা
প্রথমত, মুসলিম উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী আপনার স্বামী তাঁর প্রথম স্ত্রীর অর্থাৎ আপনার বোনের পুরো সম্পত্তির চার ভাগের এক ভাগের অধিকারী। প্রথম স্ত্রীর বাকি সম্পত্তিতে তাঁর ছেলেমেয়েরা অংশীদার হবে এবং আপনি এবং আপনার ছেলেমেয়েরা সেখানে কোনো অংশ পাবে না। তবে আপনার স্বামীর প্রাপ্য চার ভাগের এক ভাগে আপনারা সবাই অংশীদার হবেন।
আমার বয়স ২৫ বছর। আমি একটি মেয়েকে ভালোবাসি, যার বয়স ২১ বছর। ১৯ বছর বয়সে ওর পরিবার ওকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে প্রবাসী এক লোকের সঙ্গে বিয়ে দেয়। তখন আমি কিছু করতে পারিনি শুধু কাঁদা ছাড়া। কারণ, আমার কোনো চাকরি ছিল না। এখন পরিবারের প্রতি সম্মান রেখে আমরা দুজনেই চাচ্ছি আমাদের জীবনটা নতুন করে গড়ে তুলতে। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই ওর বা আমার পরিবার কিছুতেই এটা মেনে নেবে না। ও তালাক দিলে বাসায় থাকতে পারবে না। আমি সব দিক থেকেই প্রস্তুত। আমার প্রশ্ন, যেহেতু ওকে কাবিননামা দিচ্ছে না বা কোথা থেকে রেজিস্ট্রি করা হয়েছে, তা-ও বলছে না, তাই কাবিননামা না পাওয়া গেলে কী করব? অথবা কাবিননামা ছাড়া কি তালাক সম্ভব? ওই লোকটা বিদেশে থাকা অবস্থায় কি তালাক দেওয়া যাবে? কাবিননামায় যদি ওর তালাক দেওয়ার অধিকার না থাকে, তাহলে আইন অনুসারে কী করতে পারি? যেহেতু তালাক কার্যকর হতে ৯০ দিন সময় লাগে এবং ওই সময়টা আমরা নিরাপত্তাহীন অবস্থায় থাকব, তাই ওই সময়টা আমরা একই ছাদের নিচে থাকলে কি কোনো ধরনের আইনি জটিলতার সৃষ্টি হবে?
সুমন
মিরপুর, ঢাকা।
মুসলিম পারিবারিক আইনের আওতায় তালাক-এ তাওফিজ-এর ক্ষমতাবলে একজন মহিলা তালাকের নোটিশ পাঠাতে পারেন। কিন্তু কাবিননামায় এই ক্ষমতার কথা উল্লেখ করতে হবে। যেহেতু কাবিননামায় তালাক দেওয়ার অধিকার দেওয়া আছে কি না, সে ব্যাপারে আপনারা নিশ্চিত নন, সেহেতু মেয়েটি মুসলিম বিবাহবিচ্ছেদ আইন, ১৯৩৯-এর আওতায় বিবাহবিচ্ছেদের মামলা করতে পারেন। এখানে উল্লেখ্য, অর্পিত ক্ষমতাবলে একজন স্ত্রী প্রবাসী স্বামীকে তালাক দিতে পারেন এবং উক্ত তালাকটি ৯০ দিন পর কার্যকর হবে। এই ৯০ দিন মেয়েটির আলাদা থাকাই বাঞ্ছনীয়।
আমি স্নাতক (সম্মান) চতুর্থ বষের শিক্ষার্থী। আমরা তিন ভাই। আমার দুটি নাম। একটি ডাক নাম, অন্যটি সার্টিফিকেট বা জাতীয় পরিচয়পত্রের নাম। আমার বাবা যে জমি কিনেছেন, সেগুলো আমাদের তিন ভাইয়ের নামে রেজিস্ট্রেশন করেছেন এবং তাতে আমার দুটি নামই ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থাৎ কোনো জমি রেজিস্ট্রেশনে ডাকনাম; আবার কোনোটিতে সার্টিফিকেটের নাম ব্যবহার করা হয়েছে। এতে কি আমার কোনো সমস্যা হবে? যদি নাম সংশোধন করতে হয়, তা কি আমার লেখাপড়া শেষে করা যাবে? নাকি এখনই করতে হবে?
সাগর চন্দ্র রায়
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
সাধারণত মানুষের নাম তার শিক্ষাগত যোগ্যতার সার্টিফিকেট অনুযায়ী নির্ধারিত হয়ে থাকে। রেজিস্টার্ড দলিলে আপনার ডাক নাম ও সার্টিফিকেট নাম থাকলে বিশেষ কোনো সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তবে ভবিষ্যতে আপনি দলিলে আপনার নাম সংশোধনের আবেদন করতে পারবেন।
আমি একজন অসহায় মেয়ে। জন্মের দুই-তিন ঘণ্টা পরই আমার মা-সহ পরিবারের লোকজন আমাকে হাসপাতালে রেখে পালিয়ে যায়। তার পর থেকে তাঁদের সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ নেই এবং তাদের ঠিকানাও জানি না। আমার খোঁজও তারা রাখেনি। তখন থেকে হাসপাতালের একজন নার্স আমাকে নিয়ে মেয়ের মতো লালনপালন করে বড় করে তুলেছেন। তিনিই এখন আমার মা-বাবা। আমার কোনো ভাইবোন নেই। পরিবারের সদস্য বলতে শুধু মা আর আমি। মায়ের স্বামী অর্থাৎ আমার বাবাও বেঁচে নেই। বাবার পক্ষের আত্মীয়ের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ নেই। মায়ের পক্ষের মামাতো ও খালাতো ভাইবোন আছে। মা যদি আমাকে সম্পত্তি লিখে দিয়ে না যান, আমি কি ওই সম্পত্তির মালিক হতে পারব? মা আমাকে তাঁর সবকিছু উইল করে গেলে তা মুসলিম আইন অনুযায়ী কতটুকু কার্যকর হবে। তাঁর ব্যাংক অ্যাকাউন্টের নমিনি আমি; সেই অর্থ আমার হবে কি না?
জয়তা
মিরপুর, ঢাকা।
মুসলিম আইন অনুযায়ী একজন ব্যক্তি যেকোনো গরওয়ারিশকে তার সম্পত্তির এক-তৃতীয়াংশ অসিয়ত বা উইল করতে পারেন। আপনার মায়ের অ্যাকাউন্টে আপনাকে নমিনি করা হলে মায়ের মৃত্যুর পর ওই অ্যাকাউন্টের অর্থ আপনার হবে। আপনার মা জীবদ্দশায় তাঁর পুরো সম্পত্তি হেবার মাধ্যমে আপনাকে হস্তান্তর করতে পারেন। তবে বর্তমান আইন অনুযায়ী হেবার দলিলটি অবশ্যই রেজিস্টার্ড হতে হবে।
পারিবারিক সম্মতিতেই ২০০৮ সালে আমাদের বিয়ে হয়। বিয়ের দুই মাস পর বুঝতে পারলাম, আমার স্বামীর সঙ্গে তাঁর বড় ভাইয়ের স্ত্রীর প্রেমের সম্পর্ক রয়েছে। তাঁর স্বামী বিদেশ থাকেন। আমাদের বিয়ের তিন মাস পর আমার শ্বশুর এবং চার মাস পর আমার বাবা মারা যান। ফলে তাঁরা আরও উচ্ছৃঙ্খল হয়ে পড়েন। এর মধ্যে আমার স্বামী আমাকে বাপের বাড়িতে রেখে চলে যান। এখন তিনি ভাবিকে দিয়ে আমাকে চাপ দিচ্ছেন, যেন আমিই তাঁকে তালাক দিয়ে দিই। আমাদের বিয়েতে কাবিন হয়েছিল চার লাখ টাকা। তাই তিনি চাচ্ছেন, যাতে আমিই তাকে তালাক দিয়ে দিই। ছয় মাস যাবৎ তিনি আমার কোনো খরচ বহন করেন না। এমতাবস্থায় আমি কীভাবে আইনের সাহায্য নিতে পারি।
রেশমা
মতলব, চাঁদপুর
কাবিননামার অর্থ বা দেনমোহর স্ত্রীর কাছে স্বামীর একধরনের ঋণ। এই ঋণ চাহিবামাত্র পরিশোধযোগ্য। সুতরাং আপনার স্বামী বা আপনি যে পক্ষই তালাক দেন না কেন, কাবিননামার চার লাখ টাকা আপনার স্বামী আপনাকে দিতে বাধ্য। ভরণ-পোষণের জন্য আপনি মুসলিম পারিবারিক আদালতে মামলা করতে পারেন।
আমি স্নাতক (সম্মান) তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। সিলেটে এক আত্মীয়ের বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করি। আমার গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহ। সেখানে এক মেয়ের সঙ্গে আমার প্রেমের সম্পর্ক ছিল। হঠাৎ মেয়েটি আমাকে না জানিয়ে সিলেট চলে আসে। এক বন্ধু তাকে আমার ঠিকানা দেয়। তারপর মেয়েটি আমাকে বাধ্য করে বিয়ে করতে। যদিও তখন আমার বয়স ২১ বছর হয়নি। নোটারি পাবলিকে আমাদের বিয়ে সম্পন্ন হয়। বিয়ের দু-তিন দিন পর মেয়েটির স্বীকারোক্তিসহ আমি প্রমাণ পাই, মেয়েটির আগে অন্য ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল। এমন সম্পর্ক আমি কোনো দিন মেনে নিতে পারব না। সেজন্য আমি বিয়ের পর তাকে তালাক দিই। কিছুদিন পর মেয়ের বাবা আমার বিরুদ্ধে যৌতুকের অভিযোগে মামলা দায়ের করেন। এরপর মেয়ে বাদী হয়ে আমার পরিবারের সবাইকে বিবাদী করে নারী নির্যাতন মামলা করে। নারী নির্যাতন মামলায় সবার জামিন হলেও আমার হয়নি। আমি মানসিকভাবে খুব দুর্বল হয়ে পড়েছি। একদিকে আমার পড়াশোনা, অন্যদিকে মামলা। কীভাবে এ বিপদ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে?
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
যেহেতু আপনার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে, সেহেতু আপনাকে আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন চাইতে হবে। মামলা দায়েরের ফলে আপনার ওপর আইনগত বাধ্যবাধকতার সৃষ্টি হয়েছে। মামলার বিষয়বস্তু মিথ্যা বা সঠিক যা-ই হোক, তা নির্ধারিত হবে আদালতের মাধ্যমে। তা ছাড়া নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে আপনার তালাকটি আইনানুগ হয়নি। তালাকের ক্ষেত্রে আপনাকে মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১-এর ধারা ৭ অনুযায়ী চেয়ারম্যানকে নোটিশ দিতে হবে। এই নোটিশের কপি আপনার স্ত্রীকেও পাঠাতে হবে এবং তিন মাস পর তালাকটি কার্যকর হবে।
আমরা চার ভাই ও পাঁচ বোন। সবাই বিবাহিত। বাবা ও মা দুজনই মারা গেছেন। সব ভাইয়েরই পুত্রসন্তান আছে। আমার একটিমাত্র কন্যা, বয়স পাঁচ বছর। আমার মৃত্যুর পর আমার স্ত্রী ও কন্যা কীভাবে আমার সম্পত্তির মালিক হতে পারে? সমস্যা হলো, আমার বাবার রেখে যাওয়া সম্পত্তি অর্পিত হিসাবে আছে, যা ১৯৬৩-৬৪ সালে রেজিস্ট্রেশন করা অবস্থায় কেনা ছিল। এই সম্পত্তিতে আমরা চার ভাই ভোগদখলে আছি। আমাদের চার ভাইয়ের নামে আলাদা একটি বাড়ি কেনা আছে, যার নাম খারিজ করা হয়নি। কারণ, সেই সম্পত্তি অর্ধেক অর্পিত হিসেবে আছে, যা রেজিস্ট্রেশন দলিলমূলে কেনা ১৯৯০ সালে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
মুন্সিগঞ্জ
আপনি আপনার জীবদ্দশায় আপনার স্থাবর সম্পত্তি স্ত্রী ও কন্যাকে দান করতে পারেন। দানের ক্ষেত্রে দানপত্রটি লিখিত ও রেজিস্ট্রি করা দলিলের মাধ্যমে সম্পন্ন করতে হবে। বাবার সম্পত্তি অবৈধভাবে অর্পিত সম্পত্তিতে তালিকাভুক্ত হলে আপনাদের তা অবমুক্ত করার পদক্ষেপ নিতে হবে। সে ক্ষেত্রে প্রশাসনিক বা আইনগত এই দুই ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারী ০৪, ২০১০
Leave a Reply