ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহতাব খানম দীর্ঘদিন ধরে কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিষয়টি পড়াচ্ছেন। তিনি আপনার মানসিক বিভিন্ন সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান দেবেন। অল্প কথায় আপনার সমস্যা তুলে ধরুন। আপনার সঠিক পরিচয় না দিতে চাইলে অন্য কোনো নাম ব্যবহার করুন। —বি.স.
সমস্যা: আমি সম্মান দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। ২০০৩ সালে আমার চাচাতো ভাইয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্কের শুরু। সে আমাকে খুব ভালোবাসত। হঠাৎ যখন আমার বাড়ি থেকে আমাকে বিয়ে দিতে চাইল, আমি তখন তাকে জানালাম। কিন্তু সে আমাকে প্রত্যাখ্যান করল। সেও একজন ছাত্র। তার পরও আমি তাকে বললাম আমরা লুকিয়ে বিয়ে করতে পারি, কিন্তু সে রাজি হলো না। সে এখন আর আমাকে ভালোবাসে না। সে ভালোবাসে তার বন্ধুর বোনকে। আগে কিন্তু সে আমার জন্য মরতেও রাজি ছিল।
আমি এখনো ওকে খুব ভালোবাসি। একদিকে বাবা-মা, অন্যদিকে ও। বাবা-মা চান আমি যেন বিয়ে করি। কিন্তু আমি ওকে ভুলতে পারছি না। আমি তাকে বলেছিলাম, আমরা দুজন লেখাপড়া শেষ করে আমাদের সম্পর্কের কথা বাবা-মাকে জানাব, কিন্তু সে রাজি হয়নি। তাই এখন আমি কী করব ভাবতে পারছি না। ওকে ভুলতেও পারব না। এখন আমার কী করা উচিত?
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
পরামর্শ: চাচাতো ভাইয়ের সঙ্গে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক ছিল বলেই তোমার এখন এত বেশি কষ্ট হচ্ছে। তবে যেহেতু সে তোমাকে প্রত্যাখ্যান করেছে এবং অন্য একটি মেয়েকে ভালোবাসে, কাজেই তার ভালোবাসার জন্য অপেক্ষা করতে থাকলে তোমার নিজের প্রতি কিন্তু অবিচার করা হবে। যখন তুমি তাকে লুকিয়ে বিয়ে করতে বলেছিলে, তখন তার পক্ষে সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয়নি। হয়তো বা এর মূল কারণ তখন সে ছাত্রাবস্থায় ছিল। কিন্তু সে আন্তরিকভাবে চাইলে তোমাদের সম্পর্কটি টিকে থাকত। তোমরা দুজনই লেখাপড়া শেষ করে তারপর সিদ্ধান্ত নিতে পারতে। তোমার এখন প্রথম দায়িত্ব হচ্ছে মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করে পরীক্ষায় ভালো করা। এরপর কাউকে ভালোবেসে বা বাবা-মায়ের পছন্দে বিয়ের কথা ভাবতে পারো। প্রত্যেক মেয়ের কিন্তু নিজস্ব পরিচিতি নিয়ে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে জীবনের পথে চলার ব্যবস্থা করে নেওয়াটা খুব জরুরি। মেয়েরা যদি নিজের কথা সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে শুধু স্বামী-সংসার আর সন্তানদের নিয়ে একটি সংকীর্ণ জগতের বাসিন্দা হয়ে জীবন কাটাতে থাকে, তাহলে নিজের সত্তাকে খুব অপমান করা হয়। কাজেই, সারাক্ষণ অতীতের কথা না ভেবে তুমি বর্তমানের দিকে তাকাও এবং কী করে নিজের জন্য একটি সফল ভবিষ্যৎ গড়ে নেবে সেই লক্ষ্যে কাজ করো। যে তোমার ভালোবাসাকে মর্যাদা দেয়নি, তার কথা ভেবে নিজেকে আর কষ্ট দিয়ো না। তোমার চলার পথে বাবা-মায়ের দোয়া যে অনেক প্রয়োজন, সে কথাও সব সময় মনে রাখবে, কেমন।
সমস্যা: আমি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছি। আমার বয়স ২৯। সাত মাস ধরে মনোরোগ চিকিৎসকের চিকিৎসা নিচ্ছি। আমি বিষণ্নতা ও দুশ্চিন্তায় আক্রান্ত। এখন আগের চেয়ে অনেক ভালো বোধ করি, কিন্তু বিষণ্নতা রোগের ওষুধ আমার স্মরণশক্তি দুর্বল করে দিচ্ছে এবং শ্রবণশক্তির ক্ষতি করছে। এখন আপনার কাছে আমার বিনীত জিজ্ঞাসা, আমার কি জীবনের শেষ পর্যন্ত বিষণ্ন্নতার ওষুধ খেয়ে যেতে হবে?
আমান উদ্দিন
পরামর্শ: তোমার চিঠিতে যথেষ্ট তথ্য নেই বলে তোমার বিষণ্নতা ও দুশ্চিন্তার বিষয়টি ঠিক বুঝতে পারিনি। এই নেতিবাচক আবেগগুলো তোমার কী কী অসুবিধা করছিল তা যদি লিখে জানাতে, তাহলে ভালো হতো। এই আবেগগুলো তৈরির ক্ষেত্রে অনেক সময় আমাদের জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো প্রভাব ফেলে। আবার কখনো কারও ক্ষেত্রে বাইরের ঘটনা খুব বেশি দায়ী থাকে না, এ ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের নিউরোট্রান্সমিটারের কেমিক্যালের মধ্যে ভারসাম্যহীনতার জন্য কিছু নেতিবাচক আবেগ, চিন্তাধারার সামঞ্জস্যহীনতা এবং আচরণের অসংগতি দেখা দিতে পারে। রোগীর সব উপসর্গ জানার পর প্রয়োজনবোধে ওষুধ প্রয়োগ করে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করা হয়। এগুলোকে ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশন এবং অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার বলা হয়। যদি শুধু জীবনে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনার জন্য আমরা সাময়িকভাবে বিষণ্নতা ও দুশ্চিন্তার শিকার হই, তাহলে কিছুদিন কাউন্সেলিং বা সাইকোথেরাপির সাহায্য নিলে সুস্থভাবে জীবনধারণ সম্ভব হয় এবং কোনো ওষুধ সেবনের প্রয়োজন হয় না। তোমাকে বুঝতে হবে যে, তোমার বিষণ্নতা ও দুশ্চিন্তার বিষয়টি কোনো মানসিক রোগের পর্যায়ে পড়ে কি না অর্থাৎ নিউরোকেমিক্যালের ভারসাম্যের অভাবের কারণে হয়েছে কি না। এ ব্যাপারে পরিষ্কার ধারণা পাবার জন্য তুমি যদি কোনো ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টের সাহায্য নাও, তাহলে খুব ভালো হয়। তাঁরা তোমাকে বলে দিতে পারবেন, তোমার কি ওষুধ ও সাইকোথেরাপি দুটোই লাগবে, নাকি শুধু সাইকোথেরাপির মাধ্যমে আরোগ্য লাভ করতে পারবে। তুমি যে মনোরোগ চিকিৎসকের সাহায্য নিচ্ছ, তাঁর সঙ্গেও সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখো। অবস্থার উন্নতি ঘটলে তাঁরা ধীরে ধীরে ওষুধের মাত্রা কমিয়ে দেন এবং একসময় বন্ধও করে দেন। যদি শুধু সাইকোথেরাপি নিয়ে তুমি উপকৃত হতে পার, তাহলে ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে পারবে।
তুমি চাকরিরত এবং ওষুধ খাচ্ছ বেশিদিন হয়নি। এ কারণে, মনে হচ্ছে, তোমার মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা খুব খারাপ নয়। তবে আমি আশা করি, তুমি দেরি না করে চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানীদের সাহায্য নেবে। শুভকামনা রইল।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারী ২২, ২০১০
Leave a Reply