৬ সেপ্টেম্বর দেশে পালিত হলো ডায়াবেটিস সেবা দিবস। এ দেশে চিকিত্সাক্ষেত্রে প্রবাদপ্রতিম পুরুষ এবং ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা জাতীয় অধ্যাপক মোহাম্মদ ইব্রাহিমের মহাপ্রয়াণ দিবস। এদিন গরিব-ধনী নির্বিশেষে সবাই এই প্রতিষ্ঠানে চিকিত্সা পাবে এবং অর্থের সংকটের জন্য কোনো চিকিত্সা না পেয়ে ফিরে যাবে না—এমন দৃঢ় সংকল্প করেছিলেন মহান এই মানুষ। এ ঐতিহ্য এখনো ডায়াবেটিক সমিতির সব প্রতিষ্ঠানে, বিশেষ করে ইব্রাহিম মেমোরিয়াল ডায়াবেটিক সেন্টারে (বারডেম) চলছে এবং ভবিষ্যতেও চলবে বলে আশা করি।
অধ্যাপক ইব্রাহিম ডায়াবেটিক চিকিত্সার যে সুবর্ণ সূত্রের সন্ধান আমাদের দিয়েছিলেন, তা হলো তিনটি ‘ডি’—মানে ডায়েট, ড্রাগ ও ডিসিপ্লিন। সেই সূত্রটি বিশ্বজুড়ে অনুসৃত। তবে ব্যক্তিভেদে, অবস্থাভেদে ও পরিস্থিতিভেদে বছর বছর চিকিত্সা-নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে, পরিবর্তনও হচ্ছে। ধারাটি যুক্তিসংগতও বটে। তবে অনেক সময় চিকিত্সা-নির্দেশনার জন্য বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়, মতানৈক্যও ঘটে বিজ্ঞানীদের মধ্যে।
স্বাস্থ্যপরিচর্যার উন্নতির জন্য এ কাজ আপাতদৃষ্টে সহজই মনে হয়। গাইডলাইন বা চিকিত্সা-নির্দেশনা প্রণয়ন করা—কেমন করে বিশেষ কোনো অসুখের চিকিত্সা করলে সবচেয়ে ভালো ফল পাওয়া যাবে, আর এরপর চিকিত্সককে এটি অনুসরণ করতে বলা। পার্লামেন্টে স্বাস্থ্যপরিচর্যা নিয়ে যেসব দেশে বড় বড় বিতর্ক হয়, সেসব দেশেও এই কৌশল প্রয়োগ করেন পরিকল্পনাবিদ ও বীমা কোম্পানিগুলো।
এর লক্ষ্য অবশ্য চিকিত্সার উন্নতি এবং সেই সঙ্গে এ ক্ষেত্রে অর্থব্যয় কমানো। তবে প্রতিটি রোগীর জন্য ভালো, এমন পথনির্দেশিকা অনেক সময় বেশ গোলমেলে হয়ে যেতে পারে। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ এমনও বলেন, এ ধরনের বড় আকারের জাতীয় পরিকল্পনায় বেশ বড় ঝুঁকিও থাকে। ইদানীং বিশ্বজুড়ে অন্যতম প্রধান রোগ ডায়াবেটিসের চিকিত্সা-নির্দেশনা নিয়েও একটি সমস্যা হয়েছে।
২০০৮ সালে জাতীয় নির্দেশনা গ্রুপ হঠাত্ প্রত্যাহার করে নিল ২০০৬ সালে প্রণীত একটি বিতর্কিত ডায়াবেটিস স্ট্যান্ডার্ড, যাতে ডায়াবেটিসকে আগ্রাসী নিয়ন্ত্রণের জন্য সুপারিশ করা হয়েছিল। এই পরিবর্তনটি এল এই কারণে যে, বড় ধরনের একটি গবেষণা থেকে জানা গেল, কোনো কোনো রোগীর ক্ষেত্রে খুব দ্রুত রক্তের গ্লুকোজ নামিয়ে আনলে বা খুব বেশি নেমে গেলে রোগীর জীবনসংশয় পর্যন্ত হতে পারে।
অবশ্য নির্দেশনাটি যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল গাইডলাইন। তবে একে নিয়ে আলোচনা প্রাসঙ্গিক এ কারণে যে, বিশ্বের নানা দেশে, এমনকি আমাদের দেশেও চিকিত্সা-নির্দেশিকা গ্রহণে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল গাইডলাইন এবং সে দেশের ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশনের নির্দেশিকা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হয়ে থাকে।
এ সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানীমহলে তোলপাড় হলো। অনেকে, যাঁরা ২০০৬ সালের এই নির্দেশনার বিরুদ্ধে ছিলেন, তাঁরা বেশ মুখর হলেন। মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ রডনি এ হেওয়ার্ড বলেন, এই নির্দেশনার প্রণেতারা রোগীর ভালো করার চেয়ে বরং ডায়াবেটিসের দিকেই বেশি নজর দিয়েছিলেন। হেওয়ার্ডের মতো কড়া সমালোচকেরা এমনও বলেছেন যে এ ক্ষেত্রে ওষুধ কোম্পানিগুলো এই নির্দেশনাকে প্রভাবিত করেছিল, যাতে গ্লুকোজ কমানোর ওষুধ, যেমন—ইনসুলিনের মতো ওষুধের বিক্রি বাড়ানো যায়। ওয়াশিংটনের একটি সংস্থা ন্যাশনাল কমিটি ফর কোয়ালিটি অ্যাশিউরেন্স এই গাইডলাইনের প্রণেতা এবং ওই সংস্থা এ জন্য অর্থও পেয়েছিল এমন সংবাদও আছে। তবে সে সংস্থা এবং একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকেরাও অবশ্য এমন তথ্য অস্বীকার করেছেন। হার্ভার্ডের মেডিসিন বিষয়ের অধ্যাপক জেরোমে ই গ্রুপম্যান বলেন, এমন ধরনের নির্দেশনা প্রণয়নের জন্য ওষুধশিল্প-প্রতিষ্ঠানের অর্থসাহায্য গ্রহণ অনুচিত।
মূল সমস্যা হলো, এমন ধরনের অনেক নির্দেশনা প্রণীত হয় ক্লিনিক্যাল স্টাডিজের ওপর ভিত্তি করে, কিছু চিকিত্সা সাক্ষ্যপ্রমাণের ওপর ভিত্তি করে। আর এতে যদি ওষুধশিল্প-প্রতিষ্ঠান বা গোষ্ঠীস্বার্থের প্রভাব পড়ে, তাহলে সেটা উদ্বেগের বিষয়।
এই বির্তকের সূচনা কীভাবে হলো? বেশ কয়েকটি গবেষণায় দেখা গেল, ডায়াবেটিসের রোগীরা তাঁদের রক্তের সুগার কড়াকড়িভাবে নিয়ন্ত্রণ করলে সুফলতা লাভ করেন। ফলে ২০০৫ সালে অন্যদের সঙ্গে মার্কিন ডায়াবেটিক সমিতি, ন্যাশনাল কমিটি অব কোয়ালিটি অ্যাশিউরেন্সকে গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণের একটি আগ্রাসী স্ট্যান্ডার্ড প্রণয়নের আহ্বান জানায়।
আপাতদৃষ্টে গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে এ ধরনের প্রস্তাব অর্থবহ মনে হওয়া স্বাভাবিক। রক্তে গ্লুকোজের মান বেশি থাকলে ডায়াবেটিসের কিছু জটিলতা হতে পারে; যেমন—অন্ধত্ব ও কিডনি নিষ্ক্রিয় হওয়া। আবার গ্লুকোজের মান বেশি কমিয়ে আনলে কিছু রোগী, যেমন—বয়স্ক লোক, রুগণ্ মানুষ—এদের হঠাত্ চোখে অন্ধকার দেখা, খিঁচুনি হওয়ার মতো ঘটনা ঘটতে পারে। বিশেষ করে হূদরোগী ও কিডনি রোগী, যাঁদের ডায়াবেটিসও রয়েছে, তাঁদের রক্তে গ্লুকোজের মান কত নিচে কমালে সুফল লাভ হয়, সেটিও বিবেচনার বিষয়। তাই নির্দেশনা প্রণয়নের আগে পূর্বাপর বিবেচনা, নিদানিক বিষয় পুনর্নিরীক্ষণ ও বিভিন্ন ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের যৌক্তিকতা স্বীকার্য। আর এ ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ ও শৃঙ্খলমুক্ত মন নিয়ে বিশ্লেষণ বিশেষ প্রয়োজন।
অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরী
পরিচালক, ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস, বারডেম হাসপাতাল, সাম্মানিক অধ্যাপক
ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ, ঢাকা
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, সেপ্টেম্বর ৩০, ২০০৯
Leave a Reply