প্রতিবছর সেপ্টেম্বরের শেষ রোববারে পালিত হয় বিশ্ব হার্ট দিবস। আয়োজন করে থাকে বিশ্ব হার্ট ফেডারেশন ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এ বছর সেটি হলো ২৭ সেপ্টেম্বর। এ দিনটিতে সারা বিশ্বে এই মেসেজটি ছড়িয়ে দেওয়া হয় যে বর্তমান বিশ্বে হূদরোগ আর মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণই (ব্রেন স্ট্রোক) হচ্ছে এক নম্বর মরণব্যাধি। প্রতিবছর এক কোটি ৭২ লাখ মানুষ মারা যায় এই দুটো কারণে এবং যার ৮০ শতাংশ ঘটে মাঝারি আর নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে। বর্তমান প্রবণতা বহাল থাকলে ২০১৫ সাল নাগাদ এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে দুই কোটির বেশি। এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো, এদের অর্ধেকই মারা যাবে তাদের কর্মসক্ষম বছরগুলোতে। অর্থাত্ পরিবারের যে মানুষটির ওপর নির্ভর করছে সবার আর্থিক নিরাপত্তা, সে-ই চলে যাচ্ছে সবাইকে শুধু শোকের সাগর নয়, অনিশ্চয়তার অথই পাথারে ফেলে। অথচ সামান্য কিছু পদক্ষেপ আর লাইফ স্টাইল পরিবর্তন করলে, বিশেষত তামাকজাতীয় দ্রব্য বর্জন, নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম আর স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণের অভ্যাসটুকু করলে প্রায় ৮০ শতাংশ অসময়োচিত কার্ডিও ভাসকুলার মৃত্যু (হূদরোগ + স্ট্রোক) এড়ানো সম্ভব।
বর্তমানে বিরাজমান আর্থিক অনিশ্চয়তার বছরগুলোতে এই কর্মসক্ষম জনসংখ্যার অসময়োচিত মৃত্যু আর রোগে আক্রান্ত হওয়ার ইকোনমিক ফলাফল কিন্তু সাংঘাতিক। উত্পাদন কমে যাওয়া আর স্বাস্থ্য খাতে খরচ বৃদ্ধির একটি হিসাব করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। বলা হচ্ছে, ২০০৫ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে এই আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ হবে চীনে ৫৫৮, ভারতে ২৩৭ আর রাশিয়ায় ৩০৩ বিলিয়ন ডলার। সবচেয়ে বড় কথা, শারীরিক অক্ষমতা, কর্মক্ষেত্রে অনুপস্থিতি এবং কর্মক্ষেত্রে নানা রকম দুর্ঘটনা যেগুলো ঘটে এসব রোগের কারণে, এতে প্রোডাকশনের ক্ষতির পরিমাণ কিন্তু চিকিত্সার খরচের চেয়ে অনেক অনেক বেশি; ৪০০ শতাংশেরও বেশি। এসব কথা বিচেনায় নিয়েই এ বছরের বিশ্ব হার্ট দিবসের স্লোগান হচ্ছে ‘স্বাস্থ্যকর কর্মপরিবেশ, সুস্থ হূদ্যন্ত্র’।
২০০৩ সালের একটি গবেষণায় বলা হচ্ছে, কর্মক্ষেত্রে যদি স্বাস্থ্যকর পরিবেশ গড়ে তোলা হয়, তবে অসুস্থতার কারণে ছুটি নেওয়া কমে যায় ২৭ শতাংশ, স্বাস্থ্য খাতে খরচ কমে ২৬ শতাংশ, কর্মীদের অক্ষমতা ও কমপেনসেশন ভাতার দাবি কমে যায় ৩২ শতাংশ। সবচেয়ে বড় কথা, স্বাস্থ্য উন্নয়ন খাতে এক ডলার খরচ করলে এর সেভিংস বা রিটার্ন হলো প্রায় ছয় ডলার। কাজেই এবারের হার্ট দিবসের স্লোগানটি কিন্তু আসলেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এই স্বাস্থ্যকর কর্মপরিবেশ গড়ে তোলার জন্য কী করা প্রয়োজন
* কাজের সময় শারীরিকভাবে সক্রিয় হোন। দুপুরে খাবারের বিরতির সময় হাঁটুন কিংবা হালকা ব্যায়াম করুন। করপোরেট ও সরকারি অফিসগুলোর উচিত নিজেদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ব্যায়ামের ব্যবস্থা গড়ে তোলা। কারখানাগুলোতেও এটি করা সম্ভব। কাজ শুরু হওয়ার আগে কিংবা কোনো বিরতিতে নিজ নিজ অবস্থানে সবাই মিলে ১০ মিনিট হালকা ব্যায়াম শুধু দৈহিক উন্নতি করবে তা নয়, কর্মস্পৃহাও বাড়াবে বইকি।
* তামাকমুক্ত পরিবেশ গড়ে তুলুন। শুধু বিড়ি-সিগারেট নয়; পানের সঙ্গে জর্দা, সাদাপাতা, খয়ের, গুল—এসবের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কেও সবার জানা উচিত। আপনার সহকর্মীদেরও তামাক ছেড়ে দিতে উদ্বুদ্ধ করুন।
* কর্মস্থলে স্বাস্থ্যসম্মত খাবারের ব্যবস্থার জন্য কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করুন। নানা রকম শাকসবজি, মাছ, ডাল, চর্বিবিহীন মাংস আর ফল খাওয়া উচিত বেশি। আর কমানো উচিত লবণ ও চিনির পরিমাণ।
তরুণদের ফাস্টফুড আর তেল-ঘিয়ে চপচপে মাংসবহুল ‘রিচ ফুড’ খাওয়ার যে অভ্যাস হচ্ছে, এর ফলাফল কিন্তু খুব খারাপ। এদের উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস আর কোলেস্টেরলের বিপজ্জনক মাত্রার আশঙ্কা অনেক বেশি। তারুণ্যের জোয়ারে তারা এসবকে ভাসিয়ে দিতে চায় বইকি। তবে শেষ পর্যন্ত হার মানতে হয় অসময়ে একগাদা ওষুধ খাওয়ার মধ্য দিয়ে। আরেকটি ব্যাপার, আমরা যেসব শাকসবজি খাই, সেটি কেটে, বেছে, ধুয়ে তারপর ভালো করে তেলে ভেজে এর খাদ্যমান খুবই কমিয়ে দিই। সালাদজাতীয় খাদ্য বেশি খাওয়ার অভ্যাস করলে আর শাকসবজি হালকা ভাপে সেঁকে বা হালকা ভেজে খাওয়ার অভ্যাস করলে উপকার বেশি হবে। ফল খাওয়ার কথা শুনলে অনেকে মনে করে আঙুর, আপেল, বেদানার কথা; আর আমি বলি পেয়ারা, আমড়া, কলা, লটকনের কথা। আমাদের হরেক রকমের টক-মিষ্টি দেশি ফল কিন্তু নানা রকম ভিটামিন ও ফাইবারের চমত্কার সোর্স।
খাবারে লবণ কম খাওয়ার কথা বললে সবাই পাতে লবণ না খাওয়ার কথা মনে করে। এটি নিঃসন্দেহে ভালো অভ্যাস। কিন্তু রান্নায় তরকারিতে, বোরহানিতে, চিপসের প্যাকেটের মচমচে ভাজা আলুর সঙ্গে কিংবা লবণ-মরিচমাখা আমড়া খাওয়ার সময় রসাল কামড়ে কতখানি লবণ আমরা অতিরিক্ত খাচ্ছি, তাও কিন্তু হিসাবে নিতে হবে। একইভাবে চিনি কমাতে চাইলে চায়ে চিনির সঙ্গে সফট ড্রিংকস প্রক্রিয়াজাত ফ্রুট জুস আর রসে ভরপুর মিষ্টির কথাও হিসাব করতে হবে।
ধূমপানবিরোধী যে আইন আমাদের দেশে আছে, তা কিন্তু খুব কম দেশেই আছে। কিন্তু শুধু আইন নয়, সামাজিক প্রতিরোধ কিন্তু ধূমপান নিরোধে সবচেয়ে সফল অস্ত্র। আর শুধু ধূমপান নয়, তামাকের যেকোনো প্রকার—সেটি জর্দা, সাদাপাতা, পানবাহার বা গুল যা-ই হোক না কেন—অত্যন্ত ক্ষতিকর।
এ বিষয়ে সবার সচেতন হওয়া প্রয়োজন। আশার কথা এই যে, ধূমপান ছেড়ে দেওয়ার এক বছরের মধ্যেই করোনারি হূদরোগের ঝুঁকি অর্ধেক কমে যায়। কাজেই আজই তামাক বর্জন করুন এবং সহকর্মীদেরও এ কাজে উদ্বুদ্ধ করুন।
প্রতিদিন ৩০ মিনিট শারীরিক পরিশ্রম শুধু হূদরোগ বা মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের ঝুঁকি কমায় তা-ই নয়, ওজন কমে, দেহ সৌষ্ঠব আকর্ষণীয় হয় এবং কর্মস্পৃহা বাড়ে। কাজেই কাজের ফাঁকে হাঁটুন, সিঁড়ি ভাঙুন বা হালকা ব্যায়াম করুন।
নিজের রক্তচাপ, কোলেস্টেরল, রক্তে সুগারের মাত্রা জেনে নিন। ওজন মেপে নিজের অতিরিক্ত ওজন সম্পর্কে সতর্ক হোন। কর্মস্থলে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বছরে অন্তত একবার সব কর্মীদের এই পরীক্ষাগুলো করালে বহু রোগী বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটার আগেই সতর্ক হওয়ার ও চিকিত্সা নেওয়ার সুযোগ পাবে। এতে শেষ পর্যন্ত লাভ হবে শুধু ব্যক্তির নয়, ওই প্রতিষ্ঠানেরও। সরকারি কর্মকর্তাদের এসিআরে স্বাস্থ্য পরীক্ষার একটা প্রক্রিয়া আছে বটে, কিন্তু সেটিতে রক্তের সুগার বা কোলেস্টেরল মাপার কোনো ব্যবস্থা নেই। কাজেই এটির আপডেট অত্যন্ত জরুরি। আমাদের জীবনের একটি বড় অংশই কাটে কর্মস্থলে। কাজেই কর্মক্ষেত্রে সুস্থ পরিবেশ দাবি করুন এবং তৈরি করুন। নিজের স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন হয়ে জীবনযাত্রার ছক সেভাবে সাজান। নিজে সক্রিয় হোন, অন্যকেও সক্রিয় করুন। সুস্থ হার্ট নিয়ে কর্মক্ষেত্র থেকে বাড়িতে ফিরুন।
আবদুল ওয়াদুদ চৌধুরী,সহযোগী অধ্যাপক, কার্ডিওলজি,ঢাকা মেডিকেল কলেজ
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, সেপ্টেম্বর ৩০, ২০০৯
Leave a Reply