জাতীয় রোগ প্রতিরোধ ও সামাজিক চিকিত্সা প্রতিষ্ঠান (নিপসম)
সোয়াইন ফ্লুর ধকলসামলাতে না সামলাতেই আবারও শুরু হয়েছে ডেঙ্গু জ্বরের মৌসুম। ডেঙ্গু থেকে বাঁচার প্রধান উপায় হচ্ছে একে প্রতিরোধ করা। সবার সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া এই জনস্বাস্থ্য-সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। তাই মশা নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নিতে হবে সবাইকে। আক্রান্ত রোগীর জীবন বাঁচাবে সময়মতো ও যথাযথ চিকিত্সা। মৌসুমি রোগ ডেঙ্গু সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি এবং এ রোগ প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে ‘স্বাস্থ্যকুশল’-এর এই বিশেষ প্রতিবেদন
ডেঙ্গু একটি ভাইরাস
ভাইরাসজনিত রোগের সাধারণত কোনো প্রতিষেধক নেই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে টিকার মাধ্যমে প্রতিরোধ করা যায়। ডেঙ্গু (অভিধান অনুযায়ী ইংরেজি শব্দটির প্রকৃত উচ্চারণ ডেঙ্গি। তবে বহুল প্রচল বলে এই প্রতিবেদনে ডেঙ্গু শব্দটি ব্যবহূত হলো) একটি ভাইরাসজনিত জ্বর।
ভাইরাসজনিত অন্যান্য রোগের মতো এরও কোনো প্রতিষেধক নেই, টিকাও নেই। লক্ষণ অনুযায়ী চিকিত্সা দিয়ে এর মোকাবিলা করা হয়। অন্য ভাইরাল ফিভারের মতো এটিও আপনা-আপনি সেরে যায় সাত দিনের মধ্যে। তবে মূল ভয়টা হচ্ছে এর পরবর্তী জটিলতা নিয়ে। ডেঙ্গু জ্বর যদি সময়মতো যথাযথভাবে মোকাবিলা করা না যায়, তবে রোগীর দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে, দেখা দেয় ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার বা রক্তক্ষরণকারী ডেঙ্গু জ্বর।
কী ঘটে?
সাধারণত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত কোনো রোগীকে এডিস মশা কামড়ালে ডেঙ্গু ভাইরাস এডিস মশার দেহে প্রবেশ করে। সেই ভাইরাসবাহী এডিস মশা কোনো সুস্থ ব্যক্তিকে কামড়ালে ডেঙ্গু ভাইরাস তার দেহে ঢুকে পড়ে এবং আক্রান্ত হয় ওই ব্যক্তি। কাজেই ডেঙ্গু ছড়ানোর ক্ষেত্রে প্রারম্ভিক আক্রান্তকারী (যাকে প্রাইমারি বা ইনডেক্স কেস বলা হয়ে থাকে) শনাক্তকরণ ডেঙ্গু প্রতিরোধের জন্য খুবই জরুরি। যেহেতু এডিস মশা এ রোগের বাহক, তাই আক্রান্ত ব্যক্তির আশপাশের এলাকাজুড়ে বাড়ি বাড়ি মশা মারার দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। এডিস মশার প্রজননক্ষেত্র ধ্বংস করতে হবে।
ডেঙ্গুর লক্ষণ
হঠাত্ করে জ্বর। কপালে, গায়ে ব্যথা। চোখে ব্যথা। চোখ নাড়ালে, এদিক-ওদিক তাকালে ব্যথা। দাঁতের মাঢ়ি দিয়ে রক্ত পড়া। পায়খানার সঙ্গে রক্ত পড়া অথবা কালো কিংবা লালচে-কালো রঙের পায়খানা, এমনকি প্রস্রাবের সঙ্গেও অনেক সময় রক্ত যেতে পারে। ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার খুবই মারাত্মক। মস্তিষ্কেও রক্তক্ষরণ হতে পারে। খুব দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে বিশেষ পরীক্ষার পর প্রয়োজনীয় চিকিত্সার জন্য।
কীভাবে বুঝবেন ডেঙ্গু হেমোরেজিক (রক্তক্ষরণী) জ্বর
শকে চলে যাওয়া বা অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, অস্থিরতা, অবসন্নতা, পেটে তীব্র ব্যথা, হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাওয়া, ত্বক কুঁচকে যাওয়া, রক্তচাপ কমে যাওয়া, বেশি বেশি প্রস্রাব হওয়া প্রভৃতি লক্ষণ দেখা দেওয়া মাত্র রোগীকে হাসপাতালে স্থানান্তর করতে হবে। পুনরায় রক্ত পরীক্ষা করাতে হবে।
প্রচুর তরল খাওয়াতে হবে। বিশুদ্ধ পানি যথেষ্ট পরিমাণে পান করাতে হবে। সেই সঙ্গে প্রস্রাবের পরিমাণ পর্যবেক্ষণ করতে হবে। সময়মতো সঠিক ব্যবস্থাপনায় ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বরও সারিয়ে তোলা যায়। বেশি রক্তক্ষরণ হলে ফ্রেশফ্রোজেন প্লাজমা কিংবা কনসেনট্রেটেড প্লেটলেট, অথবা প্রয়োজনে পূর্ণ রক্ত-পরিসঞ্চালনের মাধ্যমে চিকিত্সার প্রয়োজন হতে পারে।
রোগী কেন মারা যায়
অত্যধিক তাপমাত্রার জ্বরের জন্য দেহে পানিশূন্যতা দেখা দেয় দ্রুত। কোষের অভ্যন্তরীণ তরল কমে যায়, আশপাশের রক্তনালিতে চাপ পড়ে, শুরু হয় রক্তক্ষরণ। ইন্টারনাল ব্লিডিং। বেশি মাত্রায় রক্তক্ষরণ চলতে থাকলে অণুচক্রিকা বা প্লেটলেট সংখ্যায় কমে যায়। প্লেটলেট কমে গেলে রক্ত জমাট বাঁধতে পারে না, ফলে ধীরে ধীরে রক্তক্ষরণ আরও বাড়তে থাকে। দেখা দেয় শক সিনড্রম। শরীরের অভ্যন্তরীণ ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। যথাযথ চিকিত্সা-ব্যবস্থাপনার অভাবে রোগীর দ্রুত অবনতি ঘটে। নেমে আসে অবাঞ্ছিত মৃত্যুর অন্ধকার।
রক্তের কোন পরীক্ষা জরুরি
রোগের লক্ষণ দেখে চিকিত্সকের পরামর্শমতো রক্তে বিশেষ অ্যান্টিবডির উপস্থিতি নির্ণয়ের মাধ্যমে সাধারণত ডেঙ্গু শনাক্ত করা হয়। তবে এটি কোনো নিশ্চিত পরীক্ষা নয়। সাধারণ জ্বর হলেই এটি করার দরকার নেই, কারণ এটি ব্যয়বহুল পরীক্ষা। সাধারণ জ্বর যদি উচ্চ তাপমাত্রায় (১০৩ ডিগ্রি ফারেনহাইটের বেশি) হয়, তাহলে প্রথমেই রক্তের একটি রুটিন পরীক্ষা করে অণুচক্রিকা বা প্লেটলেট কাউন্ট দেখে নেওয়াটা জরুরি। যদি প্লেটলেট বা অণুচক্রিকা সংখ্যায় এক লাখের কম হয়, তাহলে পরবর্তী পরীক্ষার জন্য চিকিত্সকের পরামর্শ নিতে পারেন।
চিকিত্সা
বেশির ভাগ ডেঙ্গু জ্বরই সাত দিনের মধ্যে সেরে যায়, অধিকাংশই ভয়াবহ নয়। প্রয়োজন যথেষ্ট পরিমাণে পানি পান, বিশ্রাম ও যথেষ্ট পরিমাণ তরল খাবার। সঙ্গে জ্বর কমানোর জন্য এসিটামিনোফেন (প্যারাসিটামল) গ্রুপের ওষুধ। সাধারণ ডেঙ্গুর চিকিত্সা এ-ই। তবে ব্যথানাশক ওষুধ হিসেবে অ্যাসপিরিন বা ক্লোফেনাক-জাতীয় ওষুধ দেওয়া যাবে না। এতে রক্তক্ষরণ বেড়ে যেতে পারে। হেমোরেজিক বা রক্তক্ষয়ী ডেঙ্গু, যা খুবই কম হয়ে থাকে, বেশি ভয়াবহ। এতে মৃত্যুও হতে পারে। জ্বর, সঙ্গে রক্তক্ষরণের লক্ষণ দেখামাত্র হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে বিশেষ চিকিত্সার জন্য। জ্বর কমানোর জন্য বারবার গা মোছাতে হবে ভেজা কাপড় দিয়ে।
মশা কখন কামড়ায়
ডেঙ্গু মশা, মানে এডিস মশা সকাল-সন্ধ্যায় কামড়ায়। মানে হলো এই, ভোরে সূর্যোদয়ের আধঘণ্টার মধ্যে এবং সন্ধ্যায় সূর্যাস্তের আধঘণ্টা আগে এডিস মশা কামড়াতে পছন্দ করে। তাই এই দুই সময়ে মশার কামড় থেকে সাবধান থাকবে হবে।
ব্লাড কম্পোনেন্ট থেরাপি
রক্তের প্লেটলেটের পরিমাণ দশ হাজারের নিচে না নামলে প্লেটলেট দেওয়ার প্রয়োজন নেই। ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারে প্লেটলেট বা অণুচক্রিকা আর ডেঙ্গু শক সিনড্রমে প্রয়োজন রক্তরস বা প্লাজমা কিংবা প্লাজমা সাবস্টিটিউট। এক ব্যাগ (২০০ মিলিলিটার) প্লেটলেট পাওয়ার জন্য পুরো চার ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন পড়ে। সেল সেপারেটর মেশিনের সাহায্যে অবশ্য একজন ডোনারের কাছ থেকেই এই পরিমাণ প্লেটলেট সংগ্রহ করা যায়।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে তিন-‘ভি’
ডেঙ্গু হবে না, যদি পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন থাকি, দৈনন্দিন স্বাস্থ্য-অভ্যাস পরিবর্তন করি। ভেক্টর (এডিস মশা), ভিকটিম (রোগী), ভাইরাস (ডেঙ্গু ভাইরাস)—এই তিন ‘ভি’ ডেঙ্গু-ব্যবস্থাপনার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এডিস মশা ডেঙ্গুর ভেক্টর বা বাহক।
কাজেই প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে নিজের ঘর, আঙিনায় মশার উত্স ধ্বংস করুন। ফুলের টব, পুরোনো ক্যান বা পাত্র, গামলা, গাছের কোটরে যাতে চার-পাঁচ দিন পানি জমে না থাকে, ছোট আবদ্ধ জায়গায় যাতে বৃষ্টির পানি জমে না থাকে, সেদিকে খেয়াল রাখুন। নিজেই উদ্যোগী হোন, কারও আশায় বসে থাকবেন না। মিউনিসিপ্যালিটির জন্য অপেক্ষা না করে নিজ উদ্যোগে আশপাশের পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখুন। ভিকটিম, অর্থাত্ রোগীর যথাযথ চিকিত্সা করান। কোথাও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সন্ধান পেলে আশপাশের সবাইকে তা জানান এবং এলাকার ঘরবাড়িতে বিশেষ মশকনিধন অভিযান পরিচালনা করুন।
ইকবাল কবীর,সহকারী অধ্যাপক, রোগতত্ত্ব বিভাগ
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, সেপ্টেম্বর ৩০, ২০০৯
Leave a Reply