খুব ছোটবেলায়, শান্তিনিকেতনে পাঠভবনে পড়ি, বোলপুরে আমাদের একটি বাসা ছিল। দিদিমা (প্রয়াত হয়েছেন) ছোট মামা ও মিষ্টিমাসী- আমরা সে গৃহের বাসিন্দা। ঠিক দুপুরে আমি ও মিষ্টিমাসী যখন ঘরে ফিরতাম তখন দিদিমা ‘মাধুপুরি’ নামে একটি অমৃততুল্য খাদ্য গোলক আমাদের দু’জনের হাতে দিতেন। আমরা পরম তৃপ্তিতে মাধুপুরি খেয়ে দৌড়। মিষ্টিমাসি আমার থেকে বছর পাঁচেকের বড়, অনেকদিন ধরে নিউইউর্কে, লং আইল্যান্ডে এখন নিজের বাড়ি, নিউক্লিয়ার সায়েন্টিস্ট। এখনও ইমেইলে এসব স্মৃতি মেসেজ পারাপর হয় আমাদের মধ্যে। ছোট মামা শোভন সোম রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ফাইন আর্টসের ডীন, তার হয়ত মনে নেই মাধুপুরির কথা। কি ছিল সেই মাধুপুরির মধ্যে? আমাদের গৃহের প্রাঙ্গণে অনেক শাকসবজির গাছ ছিল, সবগুলো যে আদরে বেড়েছিল তা নয়, অনাদরেও বেড়েছিল অনেক ধরনের শাকসবজী। হেলেঞ্চা, কলমী, ঢেঁকি, পুঁইশাক এমনি বাড়তো। অনাদরে পড়ে থাকতো ঝিঙ্গে, করলা, কাকরোলঃ। দিদিমা এদের থেকে কিছু কিছু সংগ্রহ করে শাক সবজী দিয়ে এই চমৎকার খাবার যে কি করে তৈরি করতেন, তাও রহস্য। বড় হয়ে বুঝলাম, রান্নাবান্না সহজ কাজ নয়, সবার কাজ নয়। রন্ধন অবশ্যই একটি আর্ট। একটি শিল্প। সবার হাতে ভাল রান্না হয় না। যেমন সব ডাক্তারের হাতে রোগী ভাল হয় না। বই পড়ে, রেসিপি দেখে, রান্নার অনুষ্ঠান দেখে যে রান্নাবান্না অনেকে করেন তা উদরপরি করে, জিবে স্বাদ অনেক দিন থাকার মত খাবার রান্না করা সবার কম নয়।
শাকসবজীতে ছিল আঁশ। আর আঁশ সমৃদ্ধ খাবার খেলে দেহ সুস্থ সবল, সজীব হয়, ওজন কমে। আঁশ খেলে খাদ্য নলের স্বাস্থ্য ভাল থাকে, এমন খ্যাতি আঁশের তো আছেই বেশ জনপ্রিয়ও আছে খাদ্য আঁশ। বলা হচ্ছে, আঁশ সমৃদ্ধ খাদ্য নানারকম অসুখে যেমন হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসে বেশ হিতকর। শরীরের বাড়তি ওজন হ্রাসে আঁশ সমৃদ্ধ খাবারের জুড়ি নেই। দিন অন্ততঃ ২৫ গ্রাম আঁশ তো থাকা চাই, পশ্চিমা খাবারে যে তা নেই বলা বাহুল্য আমাদের মা-দাদিরা যে রান্না করেছেন এতে যে প্রচুর আঁশ ছিল এতেও সন্দেহ নাই। তাই পশ্চিমা ফাস্ট ফুডের বদলে এদেশের ঐতিহ্যগত খাবার কেলে আঁশ পাবেন ঠিকঠাক। আঁশ নিয়ে প্রথম আলোড়ন উঠে ১৯৮০ সালের শুরুর দিকে। যুক্তরাজ্যের একজন চিকিৎসাবিজ্ঞানী ডাঃ ডেনিস বাকিট দেখালেন যে শাকসবজিতে যে আঁশ এবং যা পাকনল হজম করতে পারেনা সহজে, এই আঁশ জাত খাদ্য খেলে হৃদরোগের ঝুঁকি তো কমেই, পেটের অনেক রোগ যেমন ‘ডাইভারটিকুলাইটিসের’ মত রোগও হয় না। তবে খাদ্যে আঁশের পরিমাণ ও ধরন বিশ্লেষণ যখন সম্ভব হলো তখন থেকে আঁশের গুরুত্ব ও খাদ্য হিসেবে বেড়ে গেল। আগে আঁশ কেবল অদ্রবণীয়, তাই মনে করা হতো। পেটকে সচল রাখতে, বোস্ট পরিষ্কারে এদের ভূমিকা জানা ছিল। লাল চান, আটা, তুষ, কোষ্ট পরিষ্কারে উপযোগী, জানা ছিল। এরপরে সনাক্ত হলো আরেক ধরনের আঁশ (দ্রবনীয় আঁশ)। বিভিন্ন ফলে, সবজিতে ও দানাদার শস্যে আছে দ্রবনীয় আঁশ। দেখা গেল আপেল, মটরশুটি, ভুট্টায় আঁশ অনেক বেশি। কিছু কিছু খাদ্যে দ্রবনীয়, অদ্রবনীয় দু’ধরনের আঁশই থাকে।
১. দ্রবণীয় আঁশ : যেসব প্যাকেট খাদ্যে দ্রবণীয় আঁশ থাকে, সেসব খাদ্যের প্যাকেটের লেভেলে লেখা থাকে পেক্টিন, গামস্ এবং মিউসিলেক, এগুলো আঠালো পদার্থ। এসব রয়েছে শুটি জাতীয় খাদ্যে যেমন কিডনি বীনস্, মটর কলাই, তিল-তিসি, ভুট্টা, রাই, ফল ও সব্জি যেমন আপেল, কমলা। এসব খাবার খেলে দ্রবণীয় আঁশ ফুলে উঠে, জেল সদৃশ বস্তু হয় তৈরি, সেই জেলি সদৃশ পদার্থে আটকা পড়ে চিনিও শ্বেতসারের মত পুষ্টি পদার্থ, সে জন্য অন্দ্র থেকে চিনি ও দেহের ওজন হ্রাসেও এরকম খাদ্য উপকরণ বেশ উপযোগী।
তাই দ্রবণীয় আঁশ সমৃদ্ধ খাবার খেলে পরিপাক ও শোষণ প্রক্রিয়া যেমন ধীর হয়ে উঠে, তেমনি রক্তের সুগার সুমিত মানে রাখতে এধরনের খাদ্যের উপযোগীতা অনস্বীকার্য। যাদের ডায়াবেটিস, বিশেষ করে তাদের জন্য তো বটেই। তাই রক্তের শর্করা মানে চড়াই উৎরাই কম হলে সবারই সুবিধা আর পরিপাক ক্রিয়া মন্থর হওয়াতে ক্ষুধা কমে যাওয়াতে ওজনও শরীরে লাগে কম। প্রাতঃরাশের সময় উটমিল বা ডিনারের আগে মটর কলাই, অংকুরিত ছোলা, রসুন কুচিত তেল দিয়ে মাখা খেলে পরবর্তী বেলার খাবারের সময় ক্ষুধা অনেক কম লাগবে। ক্ষুধাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং রক্তের কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখার ক্ষেত্রে দ্রবণীয় আঁশের হিতকরী ভূমিকা এখন বোঝা গেছে।
২. অদ্রবণীয় আঁশ : খাদ্যে যোগ করা উচিত আঁশ, আঁশ সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। যাই হোক অদ্রবণীয় তবুও এর পুষ্টি আবেদন হারায়নি। এর অন্তর্গত প্রধান জিনিস হলো সেলুলোজ, এ ধরনের আঁশ অন্ডকে সচল করে, মলকে নরম করে, মলের নিষ্ক্রমন দ্রুত করে, এভাবে কোষ্টবদ্ধতা থাকে না। আঁশ-জলের এই সম্পর্কের জন্য, প্রচুর আঁশ, বিশেষ করে অদ্রবণীয় আঁশ, খেলেও পানি খুব কম পান করলে, পেটে ব্যথা হয় কোষ্টবদ্ধতা। প্রচুর পানি পান করলে কোষ্ট পরিষ্কার থাকে।
তবে যেকোন ধরনের আঁশ খুব বেশি হঠাৎ করে খাবারে যোগ করলে পেটে সমস্যা হয়, পেট মোচড়াতে পারে। তাই আঁশ যোগ করতে হয় ধীরে সুস্থে, বিশেষ করে দ্রবণীয় আঁশ সমৃদ্ধ খাদ্য, যা সহজে পেটে গ্যাস উৎপন্ন করে।
খাদ্যে আঁশ কি করে যোগ করা যায়। আঁশ সম্বন্ধে কমবেশি জানলে সম্ভব।
০ তুষ বা ছাতু খেলে হয় প্রাতঃরাশে। লাল চালের ভাত, আটার রুটি, সবজি ভাজি।
০ গোটা দানা শস্য খাদ্য।
০ প্রতিদিন ফল ও সবজির পাঁচটি সার্ভিং।
০ স্যালাভের বাটিতে বকোলি, গাজর, পালংশাক বা অন্য শাক, সঙ্গে কাসুন্দি।
০ একমুঠ বাদাম বা বীজ যোগ করুন স্যালাডে। শুকনো ফলের স্ন্যাকস্।
০ স্যালাডে কিডনি বীনস্, মটরশুটি, সুপে, সসে।
কিছু আঁশের ঠিকানা : ওটমিল হাফ কাপ/৭৫ মিলিলিটার, দ্রবণীয় আঁশ ১.৪ গ্রাম, মোট আঁশ ১.৬ গ্রাম; তুষ হাফ কাপ ৭৫ মিলিলিটার, দ্রবণীয় আঁশ ২ গ্রাম, মোট আঁশ ৭.৮ গ্রাম; কিডনি বীনস্ হাফ কাপ/ ১২৫ মিলিলিটার, দ্রবণীয় আঁশ ২ গ্রাম, মোট আঁশ ১০.১ গ্রাম; আপেল মাঝারি একটি, দ্রবণীয় আঁশ ১ গ্রাম, মোট আঁশ ৩.৫ গ্রাম; কলা মাঝারি একটি, দ্রবণীয় আঁশ ০.৭ গ্রাম, মোট আঁশ ২.৪ গ্রাম; কমলা মাঝারি একটি, দ্রবণীয় আঁশ ১.১ গ্রাম, মোট আঁশ ২.৮ গ্রাম; গাজর মাঝারি একটি, দ্রবণীয় আঁশ ১.১ গ্রাম, মোট আঁশ ২.২ গ্রাম।
অধ্যাপক ডা. শুভাগত চৌধুরী
পরিচালক ল্যাবরেটরী সার্ভিসেস, বারডেম, ঢাকা
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, সেপ্টেম্বর ১৯, ২০০৯
Leave a Reply