ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহতাব খানম দীর্ঘদিন ধরে কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিষয়টি পড়াচ্ছেন। তিনি আপনার মানসিক বিভিন্ন সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান দেবেন। অল্প কথায় আপনার সমস্যা তুলে ধরুন। আপনার সঠিক পরিচয় না দিতে চাইলে অন্য কোনো নাম ব্যবহার করুন। —বি.স.
সমস্যা: আমাদের সমাজে একজন সহজ-সরল ভালো মানুষকে পাগল বলা হয়। সৎ, নিরীহ, শান্তশিষ্ট ছেলেদের ‘মেয়ে মানুষ’ বলে অবহেলা করা হয়। কিন্তু রক্তমাংসে গড়া কোনো মানুষ কারও দ্বারা অবহেলিত বা অপমানিত হতে চায় না। তেমনি আমিও চাই না আমাকে নিয়ে কেউ অবহেলা করুক, ঠাট্টা-বিদ্রূপ বা উপহাস করুক। তাই আমি আমার কথাবার্তায়, আচরণে পরিবর্তন এনেছি। মুখ দিয়ে কোনো দিন বাজে শব্দ উচ্চারণ করিনি। কোনো মেয়ের দিকে মুখ তুলে তাকাইওনি। কিন্তু এখন ওসব অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। প্রথম প্রথম খারাপ লাগলেও এখন আর কিছু মনে হয় না। কিন্তু দিন দিন আমি যেন আরও খারাপ হয়ে যাচ্ছি। বিশ্বাস করুন, আমি এমনটা হতে চাইনি। কিন্তু আমাদের সমাজে বন্ধু নামের নির্দয় নিষ্ঠুর পাষাণ পশুগুলো কাউকে ভালো হতে দেয় না। ওরা চায় না কেউ ভালো হোক। বন্ধু ছাড়াই একা একা থাকতে চেয়েছি, কিন্তু তা সম্ভব নয়। তাই আমি এ পথ বেছে নিতে বাধ্য হলাম। বন্ধ-বিচ্ছেদে আমার মন ভেঙে গেছে। লেখাপড়া হচ্ছে না। এ পথে থাকলে কি মনের মতো বন্ধু পাব, যে চিরদিন ছায়ার মতো আমার পাশে থাকবে। কখনো চলে যাবে না, ওই পশুগুলোর মতো। আমি এখন কী করব?
এস আর সাইদ
কুষ্টিয়া পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট।
পরামর্শ: আমি তোমার সঙ্গে এ বিষয়ে একমত। এ যুগের সমাজে যারা খুব সরল মনের মানুষ, তাদের অন্যদের দ্বারা প্রায়ই কষ্ট পেতে হয়। এর কারণ হচ্ছে, এরা সহজে সবাইকে বিশ্বাস করে এবং যেসব জায়গায় কিছুটা কৌশলী হতে হয় সেখানে তা তারা হতে পারে না। আর সেই সঙ্গে ‘মেয়ে মানুষ’ কথাটিও সহজ-সরল ছেলেদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয় তাদের ছোট করার উদ্দেশে। এই প্রয়োগ থেকে বোঝা যায় শুধু সরল ছেলেরাই নয়, মেয়েরাও আমাদের সমাজে অনেক বেশি নিগৃহীত। এ ধরনের মন্তব্যে তোমার অপমানিত বোধ করা বা আত্মমর্যাদার অভাবে ভোগা খুবই স্বাভাবিক। তবে তোমার সঙ্গে যারা এই আচরণগুলো করছে, এগুলোকে তাদের বিকৃত মানসিক চিন্তার প্রতিফলন হিসেবে দেখতে হবে। আমার মনে হচ্ছে, নিজের পূর্বের ব্যক্তিত্বের ধরনটি নিয়ে তুমি খুব গর্বিত ছিলে না। তাই সেটিকে ধরে রেখে পথচলা বাদ দিয়ে তুমি একটি নেতিবাচক এবং মেকি ব্যক্তিত্বের আবরণে নিজেকে আচ্ছাদিত করেছ। সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী এই চারিত্রিক রূপটি কিন্তু তোমার জন্য বড় ধরনের বিপর্যয় বয়ে আনবে। তবে আমি তোমার প্রশংসা করতে চাই এই কারণে, তুমি বিষয়টি নিয়ে সচেতন হয়ে আমাকে লিখেছ। আর আমি পুরোপুরি বিশ্বাস করছি, তুমি মোটেও এ রকম হতে চাওনি, সম্পূর্ণ ইচ্ছের বিরুদ্ধে তুমি তোমার মার্জিত সত্তাটি লুকিয়ে ফেলতে বাধ্য হয়েছ। তবে একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকে কিন্তু তার কর্মকাণ্ডের বেশির ভাগ দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিতে হয়। আমি অনুরোধ করব, তুমি আবার আগের মতো তোমার সুস্থ চিন্তাধারাটি ফিরিয়ে নিয়ে এসো। তবে মেয়েদের দিকে একেবারে মুখ তুলে না তাকানোর ব্যাপারটি কিন্তু স্বাভাবিক নয়। মেয়েদের দিকে অবশ্যই সরাসরি তাকাবে এবং তার আগে তোমার মানসিকতায় কিছু পরিবর্তন আনতে হবে। একটি মেয়েকে পুরোপুরি শ্রদ্ধার সঙ্গে ঠিক তোমার মতোই আর একটি মানুষ হিসেবে দেখার মনোভাবটি তৈরি করাটা অত্যন্ত জরুরি। যদি এই মনোভাবটি অর্জন করতে পারো, তাহলে অনেকের কাছে সম্মান পাবে এবং সবচেয়ে উপকৃত হবে তখনই, যখন নিজেকেও তোমার ভালোবাসতে ইচ্ছে করবে। কেউ তোমার সঙ্গে সারাজীবন ছায়ার মতো থাকবে এই চিন্তাটিও মন থেকে সরিয়ে দিতে হবে, কারণ এটির কোনো নিশ্চয়তা নেই। তার চেয়ে বরং তুমি নিজের একজন পরম বন্ধু হয়ে নেতিবাচক অভ্যাসগুলো থেকে বেরিয়ে এসো। অন্যরা তোমাকে সবসময় গ্রহণ না করলেও তুমি কখনো নিজের প্রতি গ্রহণযোগ্যতা হারাবে না, এই প্রতিজ্ঞাটি নিজের কাছে কোরো, কেমন?
সমস্যা: আমার বয়স ২১। অনেক দিন ধরে আমি নানারকম দুশ্চিন্তায় ভুগছি। যেমন আমার কোনো প্রিয় ব্যক্তির মুখ আমি মনে করতে চাইলে মুখটা মনে না এলেও আমি চেষ্টা করি মনে আনতে। বারবার চেষ্টার পর আমি পারি কিন্তু এটার কারণে আমি অনেক মনঃকষ্টে ভুগি। আবার রাস্তাঘাটে কাউকে দেখলে সঙ্গে সঙ্গে তার চেহারা ও অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে আমার মনে দুশ্চিন্তা সৃষ্টি হয়। আর এ দুশ্চিন্তা সঙ্গে সঙ্গে কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। আগে যেসব বিষয় আমাকে আনন্দ দিত, ওই সব বিষয় এখন মনে এলে তা নিয়ে দুশ্চিন্তা করি। কোনো ব্যাপার নিয়ে দুশ্চিন্তা করার পর আবার ওই ব্যাপারটি মাথায় এলে আমি আবারও দুশ্চিন্তা করি। এভাবে যতবার মাথায় আসে ততবার চিন্তা করি। দুশ্চিন্তাটা নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলেও পারি না। মাঝেমধ্যে মনে হয় আত্মহত্যা করি। আমার এ সমস্যা কী ধরনের সমস্যা, এটার চিকিৎসা আছে কি না, থাকলে কোথায় ভালো চিকিৎসা করানো যায়, চিকিৎসার খরচ কত আসবে? জানালে খুবই উপকৃত হব।
অর্ণব
বেগমগঞ্জ, নোয়াখালী।
পরামর্শ: তোমার সুন্দর হস্তাক্ষরে অত্যন্ত গুছিয়ে লেখা চিঠির জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। মনে হচ্ছে, তুমি অবসেশনে ভুগছ, আর অনেক বেশি মনঃকষ্টে আছ। তাই শেষ পর্যন্ত চিঠি লিখতে বাধ্য হয়েছ। তোমাকে ধন্যবাদ, কারণ এতে তোমার মতো আরও যারা এ ধরনের অসুস্থতায় ভুগছে, তারাও বুঝতে পারবে যে এটির জন্য চিকিৎসা প্রয়োজন। অবসেশন হচ্ছে: দুশ্চিন্তা, যুক্তিহীন কল্পনা এবং আবেগের তাড়না, যা অযাচিতভাবে মনের মধ্যে আসে এবং বারবার সেটি ঘটতে থাকে। যে মানুষটির মনে এটি চলতে থাকে তার কাছে অনেক সময় এগুলোকে অযৌক্তিক মনে হলেও তার কিন্তু এগুলোর ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। আর এই প্রচণ্ড বিরক্তিকর ব্যাপারটি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার ফলে মানুষটি ক্রমাগত বিষণ্নতায় ভুগতে থাকে। কোনো কোনো সময় এই মানসিক যন্ত্রণা এতটাই তীব্র হয়ে ওঠে যে মানুষ তখন নিজের জীবনটাকে শেষ করে দেওয়ার কথাও চিন্তা করে। তোমার ক্ষেত্রেও এখন এ ব্যাপারটি ঘটছে। আমাদের অনেকেরই জীবনের কোনো বিশেষ সময়ে মনের মধ্যে নানা চিন্তা স্রোতের মতো বইতে থাকে। তবে অবসেশনে ভোগা মানুষের ক্ষেত্রে চিন্তার স্রোতটি অনেক বেশি দ্রুতগামী হয় এবং এটি ঘটার মাত্রাও এত বেশি থাকে যে এদের জীবনের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়। অবসেশন মানুষকে সন্দেহবাতিকতা, সিদ্ধান্তহীনতা এবং দীর্ঘসূত্রতার মধ্যে ফেলে দেয়। রোগী তার দুশ্চিন্তার বিষয়গুলোতে সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হয় এবং মানসিকভাবে অত্যন্ত ক্লান্ত বোধ করে। তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ তোমার এখানে কিছু করার নেই, কেবল অসুস্থতার কারণেই এটি হচ্ছে। আমি তোমাকে আশ্বাস দিচ্ছি, নিয়মিত চিকিৎসা নিলে তুমি এই অসুবিধা বা অসুস্থতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে। গত সংখ্যায় আমি যে জায়গাগুলোর ফোন নম্বর দিয়েছি, তুমি তার কোনো একটিতে গিয়ে সাইকোথেরাপির সাহায্য নাও। সেখানে কর্মরত সাইকোথেরাপিস্ট যদি মনে করেন তোমাকে কিছুদিন ওষুধও সেবন করতে হবে, তাহলে তিনি তোমাকে মনোরোগ চিকিৎসকের কাছে পাঠাবেন। যত কষ্টই হোক না কেন, কখনো আত্মহননের কথা ভাববে না, কেমন? দোয়া রইল।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, নভেম্বর ০৬, ২০১০
Leave a Reply