ক্যান্সার একটি মরণব্যাধি হলেও কিছু ক্যান্সার আছে, যা প্রতিরোধযোগ্য। তেমনই একটি হলো জরায়ুমুখের ক্যান্সার। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে মেয়েদের ক্যান্সারের মধ্যে জরায়ুমুখের ক্যান্সারের হার সবচেয়ে বেশি।
জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ২০০৫ সালে নিবন্ধিত নারী রোগীদের মধ্যে জরায়ুমুখের ক্যান্সারের রোগীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি (২৪·৬%)। জরায়ুমুখের ক্যান্সারের কারণ হিসেবে হিউম্যান পেপিলোমা ভাইরাস (এইচপিভি) নামের অতি সূক্ষ্ম জীবাণুকে দায়ী করা হয়। এই ভাইরাসটি নারী বা পুরুষের প্রজনন অঙ্গে অবস্থান করে এবং যৌনমিলনের মাধ্যমে তা অন্যকে সংক্রমিত করে।
এইচপিভি ভাইরাসের বিশেষ কতগুলো ধরন (স্ট্রেইন) জরায়ুমুখের কোষকে সংক্রমিত করে কিছু ক্যান্সারপূর্ব পরিবর্তন করে, যা পরে পূর্ণ ক্যান্সার রূপে প্রকাশ পায়। এই পরিবর্তিত কোষগুলো যখন তাদের অবস্থান থেকে ঝরে পড়ে, তখন জরায়ুমুখে বা যোনিপথে নির্গত তরলে সেগুলো পাওয়া যায়। কাচের ্লাইডে এই রস সংগ্রহ করে এবং বিশেষ রঙের মাধ্যমে রঞ্জিত করে অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে পরীক্ষা করার নাম প্যাপ ্নিয়ার পরীক্ষা।
এই পরীক্ষাটির মাধ্যমে জরায়ুমুখের কোষের ক্যান্সার ও ক্যান্সারপূর্ব পরিবর্তন চিহ্নিত করা যায়।
ক্যান্সারপূর্ব অবস্থায় জরায়ুমুখের ক্যান্সার ধরা পড়লে চিকিৎসার মাধ্যমে রোগীকে রক্ষা করা যায়। মেয়েদের ২১ বছরের পর থেকে অথবা বিয়ের তিন বছর পর থেকে (যেটা আগে শুরু) বার্ষিক প্যাপ ্নিয়ার পরীক্ষার পরামর্শ দেওয়া হয়।
এইচপিভি আক্রান্ত রোগীর জরায়ুমুখের ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেক বেশি, তাই উন্নত বিশ্বে এর চেয়েও উপযোগী পিসিআর পরীক্ষা করা হয়। অত্যন্ত ব্যয়বহুল হওয়ায় এগুলো আমাদের দেশের জন্য উপযোগী নয়। এখনো অনেক দেশেই জরায়ুমুখের ক্যান্সারের জন্য প্যাপ ্নিয়ার পরীক্ষাকেই একটি প্রাথমিক স্ক্রিনিং টেস্ট হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
যথেষ্ট পরিমাণ বিশেষজ্ঞ প্যাথলজিস্ট না থাকার কারণে অধিকাংশ দেশে গ্র্যাজুয়েট মেডিকেল টেকনোলজিস্টরা নমুনা সংগ্রহ এবং তার প্রাথমিক পরীক্ষা করেন। পরে সন্দেহজনক বা পজিটিভ ্লাইডগুলো বিশেষজ্ঞ প্যাথলজিস্টরা দেখেন।
প্যাপ ্নিয়ার পরীক্ষাটির সঙ্গে আমাদের দেশের চিকিৎসকেরাও পরিচিত, তবে তা শুধু রোগ নির্ণয়ের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রায় সব মেডিকেল কলেজ ও বিভাগীয় শহরে বিশেষজ্ঞ প্যাথলজিস্টরা এ পরীক্ষাটি করছেন।
কিন্তু সামগ্রিকভাবে জরায়ুর মুখের ক্যান্সারের স্ক্রিনিংয়ের জন্য তা ব্যবহৃত হচ্ছে না বা এ মুহূর্তে সরকারের কোনো প্রকল্পও নেই। জরায়ুমুখের ক্যান্সারের চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল হওয়ায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে আক্রান্ত নারীদের নিশ্চিত মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না।
আমাদের দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা বিবেচনা করে বর্তমান স্বাস্থ্যব্যবস্থায় প্যাপ ্নিয়ারকে জরায়ুমুখের ক্যান্সারের স্ক্রিনিং টেস্ট হিসেবে চালু করার জন্য যে সব প্রস্তাব করা যায়ঃ
- পরিবারকল্যাণ কেন্দ্র বা থানা স্বাস্থ্য প্রকল্পের মেডিকেল অ্যাসিসট্যান্ট বা পরিবারকল্যাণ সহকারী অথবা পরিদর্শকদের দুই দিনের ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে প্যাপ ্নিয়ারের নমুনা সংগ্রহ শেখানো সম্ভব।
এর ফলে এসব কেন্দ্রে প্যাপ ্নিয়ারের নমুনা সংগ্রহ করে থানা স্বাস্থ্য প্রকল্পে বা জেলা হাসপাতালে স্টেইনিংয়ের জন্য পাঠানো যাবে। একজন বা দুজন বিশেষজ্ঞ প্যাথলজিস্ট থানা-জেলায় গিয়ে নমুনা সংগ্রহের প্রশিক্ষণ দেবেন। এ ব্যাপারে প্যাথলজি সোসাইটির সহযোগিতা নেওয়া যেতে পারে। - জেলা ও থানা স্বাস্থ্য প্রকল্পের টেকনোলজিস্টদের চার-পাঁচ দিনের প্রশিক্ষণ দিয়ে স্লাইড স্টেইনিং শেখানো সম্ভব। এ ক্ষেত্রে প্রশিক্ষক হিসেবে বিশেষজ্ঞ প্যাথলজিস্ট এবং অভিজ্ঞ মেডিকেল টেকনোলজিস্টরা সহায়তা প্রদান করতে পারবেন। এর ফলে থানা, জেলা ও বড় হাসপাতালগুলোতে স্লাইড স্টেইন করা সম্ভব হবে।
- প্রতি থানা স্বাস্থ্য প্রকল্প এবং জেলা হাসপাতালের একজন বা দুজন স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকে দু-তিন মাসের প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রাথমিক স্ক্রিনারের দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে।
থানা বা জেলা হাসপাতাল থেকে পজিটিভ ্লাইডগুলো রোগীর ঠিকানাসহ জেলা হাসপাতালে বা মেডিকেল কলেজে পাঠাতে হবে বিশেষজ্ঞ প্যাথলজিস্টের কাছে। - থানা বা জেলা হাসপাতাল বা মেডিকেল কলেজগুলো থেকে রিপোর্ট সরাসরি যে কেন্দ্রে নমুনা সংগৃহীত হয়েছে সেখানে পাঠাতে হবে। প্রয়োজনে রোগীর কাছ থেকে ডাকমাশুল বাবদ পাঁচ টাকার দুটি ডাকটিকিটসহ খাম নেওয়া যেতে পারে।
ক্যান্সার রোগের চিকিৎসা যে দেশে অধিকাংশ লোকের আওতার বাইরে, সেখানে ক্যান্সার প্রতিরোধকেই গুরুত্ব দিতে হবে। জরায়ুমুখের ক্যান্সার যেহেতু প্রতিরোধযোগ্য এবং আমাদের জনসংখ্যার অর্ধেকই নারী, তাই এ ব্যাপারে আশু বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
এখন থেকে শুরু করলে পাঁচ বছরের মধ্যে প্রতিটি পরিবারকল্যাণ, ইউনিয়ন ও থানা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এবং জেলা ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোয় প্যাপ ্নিয়ারের নমুনা সংগ্রহের ব্যবস্থা তৈরি হবে। একই সঙ্গে থানা ও জেলা হাসপাতালে স্টেইনিংসহ প্রাথমিক স্ক্রিনিং সম্ভব হবে।
আর ৬০ মাসে আরও অন্তত ৪০ জন বিশেষজ্ঞ প্যাথলজিস্ট পাস করে বের হবে। সরকার যদি প্রতি থানায় মাইক্রোস্কোপ থাকার নিশ্চয়তা প্রদান করে, তবে হাসপাতালের যাবতীয় খরচের সঙ্গে জরায়ুমুখের ক্যান্সার স্ক্রিনিংয়ের এ খরচ খুব বেশি হবে না।
উন্নত বিশ্বে জরায়ুমুখের ক্যান্সারের প্রতিরোধক টিকা আবিষ্কৃত হয়েছে এবং তা বাজারজাতের অপেক্ষায়। অত্যন্ত ব্যয়বহুল হওয়ায় তা আমাদের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর নাগালের বাইরেই থাকবে।
অতএব এখন পর্যন্ত মানসম্পন্ন প্যাপ ্নিয়ার পরীক্ষাটিই শুধু আমাদের অবলম্বন হতে পারে। যে দেশে অর্ধেকের বেশি নারী, আসুন আমরা তাদের কথা ভাবি এবং জরায়ুমুখের ক্যান্সারের মতো প্রতিরোধযোগ্য একটি রোগ থেকে তাদের রক্ষায় সচেষ্ট হই।
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো,
লেখকঃ ডা· মালিহা হোসেন
Leave a Reply